সর্পিল পথ পেরোলেই ‘স্বপ্নের সাজেক’
‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ/ আমার মন ভুলায় রে,/ ওরে কার পানে মোর হাত বাড়িয়ে/ লুটিয়ে যায় ধুলায় রে আমার/ মন ভুলায় রে’ অথবা ‘রাঙ্গামাটির রঙে চোখ জুড়ালো/ সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো/ রূপের মধু সুরের যাদু কোন সে দেশে’- এমন সব গানের মাধ্যমেই রাঙ্গামাটির রূপ-সৌন্দর্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এ সৌন্দর্যকে বহুমাত্রিক রূপ দিয়েছে বিধাতার অনন্য সৃষ্টি সবুজ প্রকৃতিতে মোড়ানো সাজেক ভ্যালি। পৃথিবীর এ যেন এক মনোরম ভূ-স্বর্গ। বাংলাদেশের পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনা ‘বাংলার দার্জিলিং’।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে থেকে যাত্রা করে দীঘিনালা উপজেলা সদর ছাড়িয়ে বাঘাইহাট। বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট এন্ট্রি পয়েন্ট থেকে ৩৪ কিলোমিটার সবুজে মোড়ানো সর্পিল পথ পেরোলেই দেখা মিলবে নানা বয়সী পর্যটকের স্বপ্নের সাজেক। যেখানে আকাশ ছুঁয়ে গেছে মাটিকে, মেঘ ছুঁয়েছে পাহাড় আর ঝরনা ছুঁয়ে গেছে নদীকে। প্রকৃতি যেন বাড়িয়ে দিয়েছে তার দু’হাত।
সবুজে মোড়ানো উঁচু-নিচু পাহাড়ি সড়কের দু’পাশে স্থানীয়দের বাঁশের মাচাং ঘর, আবার কোথাও কোথাও দেখা যাবে রঙিন টিনের পাকা বাড়ি। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম চাষ, পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া সর্পিল নদী চলে গেছে দূরের পথ ধরে। সবুজ প্রকৃতির বুক চিড়ে চলা সরু সড়কজুড়ে মাঝে মাঝেই দেখা যাবে পাকা সেতু। রাস্তার দু’পাশে ছুটে চলছে কৃষক-কিষাণী বা শিশুর দল। সব কিছুই আপনাকে আন্দোলিত করবে। বন্ধুর পথের দু’পাশেই আকাশচুম্বী পাহাড়। আর পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। দীর্ঘজীবী বৃক্ষের দেখা মিলবে এ পথে।
দীঘিনালা থেকে বাঘাইহাট পর্যন্ত পাহাড়ি সড়কটি এতটা ভয়ংকর না হলেও বাঘাইহাট সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট পার হতেই বিপদশঙ্কুল রাস্তায় গাড়ির ছুটে চলা। গাড়ি যতো সমানে যাবে ভয় আর আতঙ্কও যেন তত কাছে আসবে। পাহাড়ের গাঘেঁষে দু’পাশে সবুজে মোড়ানো সরু পিচঢালা রাস্তা। একটু পরপরই আচমকা মোড়। ঢালু পাহাড় আর বিপজ্জনক মোড় দেখলে পর্যটকদের যে কেউ ভয় আর আতঙ্কে আঁতকে উঠবেন। ভয় আর আতঙ্কের মধ্যেই সবুজে মোড়ানো সর্পিল আর উঁচু-নিচু সড়ক ধরে ছুটে চলছে পর্যটকবাহী মাহেন্দ্র, সিএনজি, সাজেক পরিবহন বা মোটরবাইক।
বাঘাইহাট থেকে ছোট-বড় পাহাড় ডিঙিয়ে পৌঁছাতে হয় মাচালং বাজারে। মাচালং বাজার থেকে ১৮ কিলোমিটার দুর্গম আর সর্পিল পথ শেষে আপনি পৌঁছবেন সমদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরের সাজেকে। সবুজে ঢাকা আঁকাবাঁকা সড়ক ধরেই একবার পাহাড়ের উঁচুতে আবার নিচে নামবেন। যা আপনার দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় এক ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। আপনাকে করে তুলবে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়।
নোয়াখালী থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে সাজেক ঘুরতে আসা পর্যটক মো. ইসমাইল হোসেন রনি জানান, বাঘাইহাট এন্ট্রি পয়েন্ট থেকে সাজেক পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক সরু, উঁচু-নিচু আর সর্পিল। এ সড়ক অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের ভিন্ন স্বাদ দেবে।
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই সাবধানতার সঙ্গে মোটরবাইক চালাতে হবে। মোড়ে মোড়ে হর্ন বাজাতে হবে। সবুজে মোড়ানো আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলার সময়টুকু আপনার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চারদিকে সারি সারি পাহাড় আর সবুজের সমারোহ আপনাকে ভুলিয়ে দেবে দুর্গম পথের সব ক্লান্তি।’
ভয়, আতঙ্ক আর মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করেই সবুজে মোড়ানো প্রকৃতির মাঝে আঁকাবাঁকা সর্পিল পথের দুঃসাহসিক অভিযাত্রা শেষে পৌঁছে যাবেন সাজেকের মূল কেন্দ্র রুইলুইপাড়ায়। পাহাড়ের বাঁক নয়, যেন স্বর্গসিঁড়ি মাড়িয়ে ছবির মতো এক অনন্য দৃশ্যপট ভেসে আসবে আপনার চোখের সামনে। মুহূর্তেই ভুলে যাবেন ভয় আর আতঙ্কে শেষ করা জনমানবহীন উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা সর্পিল সড়কের কথা।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এসইউ/এমএস