যেখানে পাহাড় ও সমুদ্রের মিতালি
মো. ইয়াকুব আলী
সিডনি শহর গড়ে উঠেছে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে। সমুদ্রের ঠিক পাড়েই রয়েছে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি। দেখলে মনে হবে, অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি শহররক্ষা বাঁধ। সিডনির দক্ষিণের শহর ‘ওলংগং’ যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানেই সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ সব পাহাড়। এসব জায়গায় পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখার জন্য রয়েছে একাধিক লুকআউট। বুলাই এবং সাবলাইম পয়েন্ট ঠিক তেমনি দুটি লুকআউট। জায়গাগুলোয় দাঁড়ালে পুরো ১৮০ ডিগ্রিতে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। মাঝে মাঝেই মেঘেরা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মেঘেদের দেশে। মেঘ সরে গেলেই আবার সামনের সবুজের পরের অবারিত নীল জলরাশি শরীর এবং মনকে শান্ত করে দেয়।
একদিন পরিকল্পনা করে আমার মেয়ে তাহিয়া এবং ছেলে রায়ানসহ বেরিয়ে পড়লাম সাবলাইম পয়েন্টের উদ্দেশে। আমাদের সবার্ব মিন্টো থেকে ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। সিডনি শহর থেকে যেতে চাইলেও ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। সাবলাইম লুকআউটের পাশেই গাড়ি পার্কিং আছে। তাই গাড়ি পার্ক করার ঝামেলা নেই। গাড়ি পার্ক করে আমরা নেমে হেঁটে লুকআউটের গ্রিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাতাস আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সামনেই সমুদ্রের তটরেখা দেখা যাচ্ছে। দেখলে মনে হবে, শিল্পী তার নিপুণ তুলির আঁচড়ে আঁকাবাঁকা সমুদ্রের তটরেখাটি এঁকে দিয়েছেন।
সেখানে গ্রিলের বাইরে চেইন ঝুলিয়ে মানুষ তাদের ভালোবাসার তালা ঝুলিয়ে গেছেন। মোট চারটা স্প্যানের চেইনে অনেকগুলো বাহারি রঙের এবং আকৃতির তালা ঝোলানো। সেখান থেকে একটু ডানদিকে হাঁটার পর দেখলাম, একটি কাঠের নামফলকে লেখা সাবলাইম পয়েন্ট ওয়াকিং ট্র্যাক। দূরত্ব সাতশ মিটার এবং এটা ওয়ান ওয়ে। আর এটি শিশুদের জন্য উপযোগী নয়। ওয়াকিং ট্র্যাকগুলো হাঁটার এবং পথের কাঠিন্যের ওপর ভিত্তি করে মোট পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। গ্রেড এক থেকে শুরু করে বেশি কাঠিন্যের ক্রম অনুসারে পাঁচে গিয়ে শেষ। ওয়াকিং ট্র্যাকটির গ্রেড চার, তাই বলা হয়েছে অভিজ্ঞ মানুষের জন্য উপযোগী। আমাদের সামনে দিয়ে দুই ভদ্রলোক ট্র্যাকটির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন দেখে গল্প জুড়ে দিলাম।
বললাম, আমরা প্রতি শনিবার হাঁটতে বের হই। আজ এখানে এসেছি। এখন বুদ্ধি দেন, বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না? কারণ এখানে লেখা আছে বাচ্চাদের উপযোগী নয়। তারা বললেন, হ্যাঁ এটি আসলেই বাচ্চাদের উপযোগী নয়। তোমার মেয়ে পারলেও ছেলেটার জন্য অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ ঢালগুলো একেবারে খাড়া। পা ফেলতে হয় খুবই সাবধানে। তোমরা এক কাজ করো, আমাদের পিছুপিছু মই পর্যন্ত চলো। তারপর ফিরে এসো। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট সাতটি মই আছে। অগত্যা আমরা তাদের পিছুপিছু মই পর্যন্ত গেলাম। রাস্তাটুকু মোটামুটি সহজ। পাথরের কোল ঘেঁষে আবার কখনো পাথরের নিচ দিয়ে হেঁটে গেলাম।
মইয়ের কাছে গিয়ে তারা মই বেয়ে নিচে নেমে গেলেন আর আমরা ফিরে আসতে শুরু করলাম। ফিরে সাবলাইম পয়েন্ট ক্যাফে এবং ফাংশন সেন্টারে নাশতা সেরে নিলাম। এখানে নাশতা এবং দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। প্রত্যেক টেবিলে সাদা কাগজ বিছিয়ে দেওয়া হয়। সাথে দেওয়া হয় রং-পেন্সিল। যাতে বাচ্চারা খেতে খেতে আঁকিবুকি করতে পারে। আমরা জানালার ধারে একটা টেবিলে বসলাম। এখানে নাশতা করতে করতেও নিচের ভিউ দেখা যায়। এরপর থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম, একদিন একা একা গিয়ে পুরো ওয়াকটা শেষ করবো। সেটা শুরু করতে হবে নিচ থেকে। তাহলে নামার সময় আর কষ্ট হবে না।
এরপর একদিন সকাল সকাল ছেলে-মেয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একা একা বেরিয়ে পড়লাম। সাবলাইম পয়েন্ট ওয়াকের অন্য প্রান্ত শুরু হয়েছে ফুটহিল রোড থেকে। ফুটহিল রোডেই গাড়ি পার্কিং করা যায়। তবে বেশি শব্দ না করাই ভালো। কারণ পাহাড়ের কোলে সেটা একটি আবাসিক এলাকা। আমি যতবারই ওখানে গেছি; ওখানকার মানুষকে মনে মনে ঈর্ষা করেছি। বেশিরভাগ বাড়ির পেছনের বারান্দা বনের মধ্যে প্রসারিত। সেখানে ইজি চেয়ারে বসে থাকার চেয়ে জীবনে শান্তির আর কাজ নেই। বনের নিজস্ব একটা গুঞ্জন আছে। তার বাইরে অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডেকে চলা, বিভিন্ন রকমের পাখপাখালির ডাক পুরো পরিবেশটিকে একটা অতিপ্রাকৃতিক রূপ দেয়। ঘরে ফিরতে আর ইচ্ছে করে না।
গাড়িটা পার্ক করেই হাঁটা শুরু করলাম। শুরুতে কিছুদূর সমতলে যাওয়ার পর রাস্তাটা উঁচু পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে। প্রথম ধাপটা অতিক্রম করার পর রাস্তাটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে বা’দিকে সমতল বরাবর। যেটা আবার শেষ হয়েছে ফুটহিল রোডে এসেই। এই ট্র্যাকটির নাম ‘গিবসন ট্র্যাক’। সোজা উপরে চলে গেছে সাবলাইম পয়েন্ট ট্র্যাক। আমি সমতল জায়গায় পাতা কাঠের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এভাবে কিছুদূর ওঠার পর বিশ্রাম নেওয়ার কাঠের বেঞ্চ আছে। খাড়া পাহাড়ে ওঠার জন্য দমের দরকার হয়। আমি বেঞ্চগুলোয় বিশ্রাম নিয়ে আবার ওঠা শুরু করলাম। আমি প্রথমবার উঠছিলাম, তাই বেশি ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল।
বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাঁটা শুরু করলাম। আসলে হাঁটা না বলে সিঁড়ি ভাঙা বলাই ভালো। পাহাড়ের উঁচু খাঁজে খাঁজে কাঠের ছোট ছোট পাত বসিয়ে সিঁড়ির আকার দেওয়া হয়েছে। কিছুদূর ওঠার পর দেখলাম চারজন বৃদ্ধা নেমে আসছেন। এসব কঠিন কাজেও এখানে বৃদ্ধদের দেখা যায়। আসলে উন্নত দেশগুলোয় বয়স্ক মানুষেরও একটা আলাদা জীবন আছে, সেটা খুব পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কতদূর আর কতটাই বা কঠিন। তারা জানালেন, তোমার ওঠার সময় কষ্ট হবে কিন্তু নামার সময় মনে হবে ওঠার কষ্টটা সার্থক। আর শোনো, শরীরের ওপর চাপ নিও না। একবারে যতটুকু উঠতে পারো, উঠবে। তারপর দরকার হলে সে জায়গায়ই বসে বিশ্রাম নেবে। তাদের একটি কথা আমার খুব পছন্দ হলো ‘লিসেন টু ইউর বডি’।
আমি আবারও নব উদ্যমে উপরে ওঠা শুরু করলাম। চারপাশের পরিবেশ অনেক সুন্দর কিন্তু ওঠার সময় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার ফুরসৎ মিলবে না। কারণ সিঁড়িগুলো একে তো খাড়া আর বেশ সরু। আর সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আপনি এতটাই ক্লান্ত হয়ে যাবেন যে, আশেপাশে তাকানোর কথা মনে পড়বে না। এভাবে উঠতে উঠতে অনেকের সাথেই দেখা হলো। সবার সাথেই হালকা কুশল বিনিময় হচ্ছিল। একজন আমার দুরবস্থা দেখে বললেন, তোমার সাথে এক বোতল পানি রাখা দরকার ছিল। তুমি চাইলে আমার বোতলটা নিয়ে যেতে পারো। আমি বললাম, না। আজকে আর পানি খাচ্ছি না। আসলে সকালে পেটভরে নাস্তা খেয়ে এসেই ভুল করেছি। তা না হলে এতো কষ্ট হতো না। অবশ্যই একটু ভালো মানের কেডস পরে নিতে হবে। তাহলে সিঁড়ি ভাঙার কষ্টটা অনেকখানি লাঘব হয়ে যাবে।
এভাবে উঠতে উঠতে একসময় মইগুলোর গোড়ায় চলে এলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, এক বাবা তার ছয় বছর এবং চার বছর বয়সী দুই বাচ্চাকে নিয়ে নামছে। আমি ছোট বাচ্চাটাকে দেখে বললাম, তোমার তো অনেক সাহস। উত্তরে বলল, কী যে বলো না তুমি, আমি তো এর চেয়ে আরও কঠিন কাজ করতে পারি। আমি তাকে বললাম, তুমি সিঁড়িতে একটু দাঁড়াও তোমার ছবি তুলে নেই। আমার ছেলেকে দেখাবো। তাহলে এরপর আমি তাকেও নিয়ে আসতে পারবো। তোমাকে দেখে অনেকটা উৎসাহ পাচ্ছি। এরপর ওরা আমাকে হাই ফাইভ দিয়ে এবং শুভ কামনা জানিয়ে নিচের দিকে যাওয়া শুরু করলো। আমি মইয়ের সিঁড়ি ভাঙা শুরু করলাম। একসময় উপরে পৌঁছে গেলাম। উপরের সৌন্দর্যের বর্ণনা তো আগেই দিয়েছি। উপরে এসে আমি পাবলিক টিপকল থেকে পানি নিয়ে চোখেমুখে দিয়ে কিছুটা খেয়ে আবার নিচের দিকে নামা শুরু করলাম।
নিচে নামার সময় বুঝতে পারলাম, মানুষ এতো কষ্ট করে হলেও উপরে ওঠে। শারীরিক ব্যায়াম ছাড়াও নিচে নামার সময় মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করে। নিচে নামার প্রক্রিয়াটা আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি যেন পাখি হয়ে উড়ে উড়ে নামছি। মাঝে মাঝেই কোমল ঠান্ডা বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আর বন-বনানীর ফাঁকা দিয়ে কাছেই সমুদ্রকে দেখা যাচ্ছিল। নামার সময় আমিও অনেককে উৎসাহ দিলাম। বিশেষ করে যারা সেদিনই প্রথম এসেছে। আপনিও চাইলে চলে যেতে পারেন সিডনির অদূরে সাবলাইম ওয়াকিং ট্র্যাকে। যেখানে সাগর এবং পাহাড় মিতালি করে।
লেখক: অস্ট্রেলিয়ার সিডনি প্রবাসী।
এসইউ/এমকেএইচ