পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো সৌন্দর্য
বান্দরবান হচ্ছে শৈল শহর। আমাদের দার্জিলিং। পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য লুকানো। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসাবস। চোখে পড়বে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। যেতে যেতে ভাসে বিভিন্ন উপজাতিদের গান। মজার না? আবার রোমাঞ্চ! পাহাড় পেরিয়ে বিভিন্ন লোকেশনে প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোরম। পাহাড়ের ভাঁজে পাহাড়ি ফুল। রং-বেরঙের ফুল মোহিত করে। দেয় দৃষ্টিসুখ।
মেঘলা ও নীলাচলের মত নান্দনিক আরও কিছু ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে শহরের আশেপাশেই। ৬-৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেই। পাহাড়ি সাঙ্গু নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে শহরের মধ্যদিয়েই। পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মিলনমেলা বান্দরবান শহর। বাজারে উভয় জনগোষ্ঠীর ভিড়। বেচাকেনাও করে একই সাথে। দারুণ সম্প্রীতির শহর এটি। আমি তো অভিভূত এ সম্প্রীতি দেখে। ফুটপাতের ছোট ছোট বাজারগুলোও চমৎকার দেখতে। রাতে পাহাড়ের ভাঁজে আলো জ্বলে। দূর পাহাড়গুলো মিটমিট করে। ম্রোদের বাসও শহরের কাছাকাছি; পাহাড়ের খাঁজে।
মেঘলা-বান্দরবান সড়কে চোখে পড়ল আনারসের বাগান। মেঘলা স্পটে প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। নানারকম ফুল। হ্রদে বিভিন্ন রকম জলজ পাখি। ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পাহাড়ের দেয়াল। হ্রদে নৌভ্রমণ আনন্দকে দ্বিগুণ করে। এ হ্রদের উপর দিয়ে ক্যাবল কার দার্জিলিংয়ের ক্যাবল কারের কথাই মনে হয়ে যায়। এখানে থাকার জন্য ব্যবস্থাও আছে। ওয়াচটাওয়ার থেকে পাহাড়ের দৃশ্য কী চমৎকার। নিচে বাচ্চা ও পর্যটকের চলাচল-খেলাধুলা কী চমৎকার।
এরপর যৌথ খামার হয়ে টাইগার পাড়ায়। উঁচু-নিচু কালো পিচের রাস্তা। সাঁইসাঁই করে পাশ দিয়ে যায় চান্দের গাড়ি, মোটরবাইক ও যন্ত্রযান। টাইগার পাড়ার প্রায় প্রবেশমুখেই সড়ক প্রবেশ ফি দিতে হয়। চান্দের গাড়িপ্রতি ৬০ টাকা। বাইক বা সিএনজি ৩০ টাকা। এরপর দেখি ন্যাড়া পাহাড়। মাঝেমধ্যে আগুন বা কালো ছাই। পাশের সহযাত্রী বললেন, এগুলোকে বলে জুম চাষ। পাহাড়ের লোকজনের চাষপদ্ধতি। টাইগার পাড়া দিয়ে নীলাচল যেতে রোমাঞ্চকর আঁকা-বাঁকা ও উঁচু-নিচু রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিচ্ছি। মোড়ে মোড়ে পাহাড়িদের কাঁচা বাড়ি। অল্প পরিমাণ পাঁকা বাড়িও দেখলাম। পাঁকা বাড়ির বেশিরভাগই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন দোকান বা পর্যটকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা আছে। এরপর পৌঁছে গেলাম নীলাচল। বান্দরবান থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে।
৫০ টাকার প্রবেশ ফি দিয়ে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া! কী অপরূপ গো তুমি! দার্জিলিংয়ের চেয়ে কম কিসে! ওই দূরের শহর, জুম চাষ, পাহাড়িদের ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে! সবুজ কলাপাতা আর বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে দূরের স্বর্ণমন্দির দেখা যায়। পাহাড়ি রঙিন ফুলে মুগ্ধ হতেই হয়। নিচের দিকে পাহাড়ি পথ যেন পেন্সিলে আঁকা ধুসর চিকন বক্রপথ। খেলার মাঠ। পাশ থেকে কেউ কেউ বলছেন, ‘না, এটা জুম চাষ!’ চারিদিকে নীল পাহাড়। যেন শাড়িপরা বান্দরবানের আঁচল; নীল রঙের। মিষ্টি বাতাসে পর্যটকদের চুল ওড়ে। তাদের বিভিন্ন রঙের ড্রেসে পাহাড় সেজেছে অন্যরকম। পাহাড়-নারী-ঝরনা-নদী অপূর্ব সাজ! কী করে ভুলি তোমায়! সুন্দরী বান্দরবান, চোখ ইশারায় ডাকে সব সময়।
উপজাতীয় বাজার: দুপুরের পর জমজমাট হয়। সন্ধ্যারাত পর্যন্ত চলে। কিছু কিছুর সময়ের হেরফের হয় বলে জানা যায়। দেখা গেল ক্রেতা বাঙালি কিন্তু বিক্রেতা পাহাড়ি। উল্টাও হয়। আবার একই গোষ্ঠীর ক্রেতা-বিক্রেতাও আছে। সম্প্রীতির দারুণ বন্ধন। সন্ধ্যারাতে যেন জমকালো অনুষ্ঠান চলে শহরে। লাল-নীল-বেগুনি আলোয় মায়াময় রূপ ধরা দেয় শহর ও আশেপাশে। সাঙ্গু নদীর দু’তীরে আলোর খেলা। পাহাড়ের ভাঁজে আলো-আঁধারির খেলা।
থাকা-খাওয়া: থাকা-খাওয়ার জন্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয় আবাসিক ব্যবস্থা পাবেন। খাবারের ব্যবস্থাও আছে। কম খরচে থাকলে শহরের সাঙ্গু নদীর তীরের বিভিন্ন হোটেল পাবেন। বাস স্টেশন ও শহরজুড়ে থাকা-খাওয়ার প্রচুর হোটেল, লজ, রিসোর্ট পাবেন।
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সকাল ও রাতে বান্দরবানগামী বাস পাবেন। বিভিন্ন কোম্পানির বাস পাবেন। কিছু নরমাল কোম্পানিরও পাবেন। নন-এসির ভাড়া ৫২০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ১০০০ টাকা থেকে শুরু। প্রথমে চট্টগ্রাম যেতে পারেন। এসব গাড়ি ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী থেকে পাবেন। ট্রেনে গেলে কমলাপুর থেকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। এরপর চট্টগ্রামের বদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে প্রতিঘণ্টায় পুর্বানী গাড়ি যায়। ভাড়া ১২০ টাকা।
এরপর বান্দরবান গিয়ে চান্দের গাড়ি বা সিএনজি রিজার্ভ করতে হবে। বাস স্টেশনের কাছেই এসব পাওয়া যাবে। দরদাম ঠিক করে নিতে হবে। চিম্বুক পাহাড় বা নীলগীরি যেতে ৫০০০-৬০০০ টাকা ভাড়া নেবে। মেঘলা-নীলাচল, শৈলপ্রপাত বা আশেপাশের স্পটগুলোয় যেতে ৭০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা নেবে। এক্ষেত্রে অবস্থানের সময়ের ওপর ভাড়া নির্ভর করে। চান্দের গাড়িতে ১০-১২ জন আরামেই যাওয়া যাবে। ৩-৪ জন হলে সিএনজি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে চান্দের গাড়ির চেয়ে ভাড়া কিছুটা কম পড়বে। অথবা দুই বা তিনটি গ্রুপ একত্রে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করলে খরচ কম হবে। ভ্রমণ আনন্দপূর্ণ ও আরামদায়ক হবে।
লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ