শত বছরের ঘাটকুড়ি হাটে যা দেখবেন
প্রায় শত বছরের একটি পুরোনো বাজার। নাম ঘাটকুড়ি হাট। অবস্থান গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, শত বছরের পুরোনো হাটটি এখনো টিকে আছে প্রায় পুরোনো চেহারাতেই। মাটি দিয়ে তৈরি হাটের অধিকাংশ স্থাপনা টিকে আছে এখনো। যেন চারপাশের নগরায়নের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে মনে করিয়ে দিচ্ছে হারিয়ে যাওয়া অতীতের। বিস্তারিত জানাচ্ছেন নয়ন আসাদ-
ঘাটকুড়ি হাটে প্রবেশের সাথেই পাওয়া যায় ষাটের দশকের এক টুকরো গ্রামীণ হাটের আবহ। গাজীপুরের অরণ্যময় শান্ত নিরিবিলি গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত হাটটিতে সারি সারি মাটির দোকান ঘর, পাশ দিয়েই বয়ে যাওয়া ঘাটকুড়ি খাল। বাজারের ধ্বংস হতে থাকা পুরোনো স্থাপনাগুলো মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেবে হাটটির ঐতিহ্য।
সেই সারি সরি ঘরগুলোতে এখন আর হাটের জমজমাট মেলা বসে না। কিংবা ঘাটকুড়ি খালেও দেখা মেলে না কোনো নৌকার। অথচ প্রবীণদের কাছ থেকে জানা গেল, এ খাল একসময় মুখরিত থাকত ছোট-বড় নৌকার আনাগোনায়। কিন্তু এখন এ খাল মৃতপ্রায়। এ খালের ভাগ্যের সাথে যেন মিশে গেছে ঘাটকুড়ি হাটের ভাগ্যও। কারণ খালটিই ছিল হাটের মূল পণ্য সরবরাহের ও পরিবহনের মূল পথ।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ঘাটকুড়ি হাট চালু হয়েছিল মোটামুটি ১৯৩০ সালের দিকে। বাজারের একজন প্রবীণ দোকানি মোসলেমউদ্দিন বলছিলেন, তিনি নিজে প্রায় চল্লিশ বছর থেকে এখানেই বসছেন। তবে হাটটির বেহাল দশায় এখন ব্যথিত তিনি। তিনি জানালেন, হাটটি সবচেয়ে বেশি সচল ছিল স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে।
তবে স্বাধীনতার পরেও বেশ কয়েক বছর হাটটি ছিল জমজমাট। প্রচুর গরু আর তালকাঠ বিক্রি হতো এখানে। কাঁঠাল, খেজুরের গুড়, শীতলক্ষ্যার মাছ ছিল এ হাটের বিখ্যাত পণ্য। প্রত্যেক হাটের দিনে আয়োজন করা হতো হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ নানাবিধ খেলাধুলা। শীতলক্ষ্যা তীরের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের মধ্যে এ হাট ছিল মিলনমেলা।
এত কিছুর পরও কেন হাটটির করুণ দশা তা জানতে চাইলে প্রবীণ দোকানি জানালেন, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাটকুড়ি খালটির উপর স্লুইস গেট হওয়ায় হাটের পাশের খালটি দিয়ে নৌকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে লোকসমাগম আর জৌলুস হারায় হাটটি। সেইসাথে ইজারাদারদের মধ্যে ঝামেলা আর নানাবিধ কোন্দলে হাটটি থমকে দাঁড়ায়।
ঘাটকুড়ি বাজারের পুরোনো জৌলুস ফিকে হয়ে গেলেও বাজারটি এখনো ব্যতিক্রম। কারণ এর টিকে থাকা পুরোনো রূপ। তবে এ রূপ আর কতদিন টিকে থাকবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কারণ দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ইতোমধ্যেই বাজারটির পুরোনো স্থাপনাগুলো ভেঙে পড়তে বসেছে।
ঘাটকুড়ি হাট এখন আর নিয়মিত নয়। প্রতি সোম আর শুক্রবার হাট বসে। কৃষিপণ্য, তালকাঠ, হাঁস-মুরগি, মাটির তৈজসপত্র, মুড়ি-মুড়কিসহ নানা ধরনের বৈচিত্রময় জিনিসের সম্ভার নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। দূর-দূরন্ত থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে শতবর্ষী এ হাট। আগের মত জমজমাট না হলেও হাটের দিনগুলোতে হঠাৎ ফিরে আসে প্রাণ।
একটি গ্রামীণ হাটের সৌন্দর্য যতটুকু থাকা দরকার অনেকটাই লক্ষ্য করা যায় এখানে। ঘাটকুড়ি বাজার হয়তো একদিন কংক্রিটের আবরণে পাল্টে যাবে। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাটির স্থাপনাগুলোও হয়তো মিশে যাবে মাটিতেই। তার আগেই কোনো একদিন আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এ ঘাটকুড়ি হাট থেকে। হারিয়ে যেতে পারেন শত বছর পেছনের একটি আবহে।
লেখক: সহকারী ব্যবস্থাপক, হাবিতুস ফ্যাশন লিমিটেড, রাজেন্দ্রপুর, গাজীপুর।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ