১৪ শতকে নির্মিত প্রাচীন স্থাপনা
আম, কাঁসা, পিতল, লাক্ষ্মা, নকশী কাঁথা, রেশমসহ গম্ভীরা, আলকাপ, মেয়েলীগীতের মতো লোক উপাদানে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ জেলার অতীত ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়। ইসলামী স্থাপত্যকলার অজস্র নিদর্শন বুকে ধারন করে আছে। যা এক সময় ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের এক উল্লেখযোগ্য জনপদ। শুধু ঐতিহাসিক নিদর্শনেই সমৃদ্ধ নয়, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখানকার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসও অত্যন্ত গৌরবময়।
গৌড়
প্রাচীন বাংলার রাজধানী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে এ প্রাচীন নগরী। ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ১৪ শতকে নির্মিত অসংখ্য স্থাপনা।
এখানে রায়েছে সোনামসজিদ, তোহাখানা, তোহাখানা তিনগম্বুজ মসজিদ, দারসবাড়ি মসজিদ, খঞ্জন দীঘির মসজিদ, ধনাইচক মসজিদ, কোতোয়ালী গেট (নগর দ্বার), হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহর মাজারসহ বেশ কয়েকটি দীঘি।
সোনা মসজিদ
প্রথমেই চোখে পড়বে ছোট সোনা মসজিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ স্থলবন্দর মহাসড়কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি। ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহের আমলে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। সুলতানী আমলের স্থাপনাগুলোর শিল্প ভাস্কর্যের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন। এই মসজিদে চৌচালার মত ৩টি এবং দুই পাশে ১২টি গোলাকৃতির গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলোর তলদেশে বিভিন্ন ফল-ফুলের গুচ্ছ, লতাপাতার নকশা করা আছে। এই মসজিদ চত্ত্বরেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও মেজর নাজমুল হকের সমাধি।
তিন গম্বুজ মসজিদ
ছোট সোনা মসজিদ থেকে কয়েকশ’ গজ দূরেই রয়েছে তিন গম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদটি শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ) ১৬৩৯-৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে ১১৬ ফুট ও প্রস্থ ৩৮ ফুট।
শাহ নেয়ামতুল্লাহর মাজার
তিন গম্বুজ মসজিদের পাশেই রয়েছে শাহ নেয়ামতুল্লাহর মাজার। ১২ দরজা বিশিষ্ট চতুষ্কোনায়তন সমাধিটির পাশেই রয়েছে আরো কয়েকজন সাধক পুরুষের সমাধি।
পহেলা মহররম হযরত শাহ নেয়মাতুল্লাহর জন্ম ও মৃত্যুর দিন বলে এই দিনে প্রতিবছরই এখানে ওরস পালন করা হয়। এছাড়া ভাদ্র মাসের শেষ শুক্রবারও এখানে ওরস পালন করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত থেকে অনেক ভক্ত সেদিন ওরসে উপস্থিত হয়।
দারসবাড়ি মসজিদ
ছোট সোনা মসজিদ ও কোতয়ালী দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরে দারসবাড়ি মসজিদ অবস্থিত। স্থানীয় জনসাধারণ এই স্থানকে দারসবাড়ি বলে থাকেন। দারস শব্দের অর্থ শিক্ষা। বর্তমানে এই স্থানটি জনশূন্য। ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের আমলে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। এই মসজিদের অভ্যন্তর দুই অংশে বিভক্ত। এর আয়তন ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি ও ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ রয়েছে। এখন শুধু মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। দারসবাড়ি মসজিদের বাহির এবং অভ্যন্তর দেয়ালে টেরাকোটা খচিত। আশপাশের যে ক’টি মসজিদ আছে সে সবের চেয়ে এ মসজিদটি অধিকতর সুন্দর।
একসময় মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা ছিল এখানে। মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
খঞ্জনদীঘির মসজিদ
দারসবাড়ী মসজিদের দক্ষিণ দিকে প্রায় আধা কিলোমিটার দুরে বল্লাল সেন খননকৃত বালিয়া দীঘির দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে পূর্বদিকে কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ে খঞ্জনদীঘির মসজিদ। এক প্রাচীন জলাশয়ের পাশেই অবস্থিত খঞ্জনদীঘির মসজিদটি অনেকের নিকট খনিয়াদীঘির মসজিদ নামে পরিচিতি। আবার অনেকে একে রাজবিবি মসজিদও বলে থাকেন।
এই মসজিদের আয়তন ৬২x৪২ ফুট। মূল গম্বুজটির নিচের ইমারত বর্গের আকারে তৈরি। এই বর্গের প্রত্যেক বাহু ২৮ ফুট লম্বা। ইটের তৈরি এ মসজিদের বাইরে সুন্দর কারুকাজ করা রয়েছে।
খঞ্জনদীঘির মসজিদ কখন নির্মিত হয়েছিল এবং কে নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তবে মসজিদ তৈরির নমুনা দেখে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে এটি ১৪ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
ধনাইচকের মসজিদ
খঞ্জনদীঘি মসজিদের অদূরেই রয়েছে আরও একটি প্রাচীন মসজিদ। এই মসজিদটির নাম ধনাইচকের মসজিদ। এটিও ১৪ শতকে নির্মিত হয়েছে। এর দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন কারুকার্য।
এছাড়াও এ উপজেলায় রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর।
যেভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকা থেকে বাসযোগে সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে অথবা শিবগঞ্জে যেতে পারেন।
যেখানে থাকবেন
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ও শিবগঞ্জ বাজারে এসি, নন এসি আবাসিক হোটেল, সোনামসজিদের সামনে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডাকবাংলো ও সোনামসজিদ স্থলবন্দরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো রয়েছে।
এসইউ/এমএস