মেঘের রাজ্য মেঘালয়ে যা যা দেখবেন
এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
কিছুটা পথ এগিয়ে আমাদের গাড়ি বাঁক নিয়ে উঠে গেল পাহাড়ি রাস্তা ধরে ভেতরের দিকে। দীর্ঘ পথ চলতে চলতে একসময় চোখে ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙার পর দেখি উঁচু-নিচু ছায়াঘেরা পথ ধরে এগিয়ে চলছে আমাদের বাহন। দুপাশে বৃক্ষরাজি আর পাখ-পাখালির ডাক। মাঝে মাঝে দেখা মেলে পাহাড়ি লোকালয়ের ঘর-বাড়ি আর মানুষজন, স্থানীয়দের বাজার, দোকান। খুব ভালো লাগা একই বিষয় লক্ষ্য করলাম কিছু দূর পরপর রাস্তার ধারে ও মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে বাঁশের তৈরি ময়লার ঝুড়ি বা ডাস্টবিন। পুরো মেঘালয়জুড়ে রাস্তার পাশে কোথাও কোনো চিপসের প্যাকেট, পানি-জুসের বোতল, ছেঁড়া কাগজ বা দৃশ্যদূষণ সৃষ্টিকারী কোনো ময়লা দেখিনি।
যেতে যেতে কথা হচ্ছিল ড্রাইভার আলিম মজুমদারের সাথে। তার বাড়ি আসাম। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন শিলংয়ে। স্ত্রী শিলংয়ে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশের সিলেটে তাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ ও নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে। আমাদের বন্ধু জুলহাসের সাথে কিভাবে সম্পর্ক জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘জুলহাস ভাই অনেকবার শিলং এসেছেন, প্রথমবার পরিচয় থেকেই প্রতিবারই উনি এলে আমাকে আগেই ফোন দিয়ে জানান। আমি ডাউকি বর্ডারে এসে ওনাকে নিয়ে ঘুরাই, যে কদিনই থাকেন সব সময় ওনার সাথে আমাকে রাখেন। অন্যরকম একটি আন্তরিকতার সম্পর্ক, যা আত্মীয়তার চেয়ে বেশি। জুলহাস ভাই কিছু বললে আমি ফেলতে পারি না। ওনার পরিচিত যে কেউ এলেই আমাকে আগে ফোন করে জানিয়ে দেন। ওনার কথামত আমি সবাইকে সেবা দিয়ে যাই।’
গল্প করতে করতে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম রিওয়াই গ্রামে। লিভিং রুট ব্রিজ নামে পরিচিত সেতুটি দেখার জন্য ছবির মত সাজানো গোছানো রিওয়াই গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে। শিলং থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে রিওয়াই গ্রাম। গ্রামের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে রাস্তা ধরে হাঁটলেই পেয়ে যাবেন সাইনবোর্ডে লেখা নির্দেশনা। সে অনুযায়ী হেঁটে যেতে যেতে পাহাড়ি সিঁড়ি খুঁজে পাবেন। সেই সিঁড়ি ধরে বেশ কিছু দূর ট্রেকিং করে নামার পরই চোখ আটকে যাবে আশ্চর্য এই সেতুতে। এখানকার এন্ট্রি ফি ৪০ রুপি। গ্রামের পাহাড়ি নদী থাইলংয়ের উপরে প্রাকৃতিকভাবে গাছের শেকড়ে তৈরি সাঁকোটি দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমান অসংখ্য পর্যটক। বিশাল দুটি গাছের শেকড় জড়াজড়ি করে আছে ঝিরির উপরে। একটু একটু করে বেড়ে প্রাকৃতিক সেতু তৈরি করেছে গাছ দুটি। সেই সেতুর উপর দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারবেন। ঝিরির পাশে থাকা বিশাল পাথরের উপর বসে গাছের সঙ্গে গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি অভূতপূর্ব এই সেতু। ব্রিজে উপর দাঁড়াতে দেওয়া হয় না এর যথাযথ সংরক্ষণের খাতিরে।
সেতুর নিচ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী থাইলং। ব্রিজের উপর দাঁড়াতে না পারলেও নদীর পাড়ে বসে কিংবা পাহাড়ের উপর থেকে এর সৌন্দর্য দেখতে পারবেন। লিভিং রুট ব্রিজের নিচের পাহাড়ি নদীর হিমশীতল পানিতে পা ভিজিয়ে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসার সময় পথের পাশের দোকান থেকে তাজা পাহাড়ি আনারস, জাম্বুরা, পেঁপে কিনে তিন জনে খেলাম। গ্রামটি পরিষ্কার গোছানো ও সুন্দর। এখানকার সব গ্রামেই পর্যটকদের জন্য রয়েছে হোমস্টে ব্যবস্থা, কয়েক জায়গায় দেখলাম বড় বড় গাছের ডালে বাঁশ-কাঠ দিয়ে মাচাং টাইপের ঘর বানিয়ে পর্যটকদের থাকার জন্য আকৃষ্ট করা হয়। সেগুলোতে ওঠার জন্যও তারা বাঁশ-কাঠ দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে রেখেছেন। সহজে বললে, পরিবেশবান্ধব পর্যটন। সেখানে ঘুরেফিরে গাড়িতে উঠলাম, এবার আমাদের মাওলিননং গ্রামে যাওয়ার পালা।
মিনিট পাঁচেক গাড়ি চালিয়েই পৌঁছে গেলাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং। ৫০ রুপি জনপ্রতি এন্ট্রি ফি দিয়ে টিকিট করলাম। প্রথম দর্শনেই গ্রামটি খুব ভালো লেগে যায়। সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত চারপাশ। কোথাও লতাবৃক্ষ, কোথাও পাতাবাহার, কোথাও রঙিন ফুলের গাছ। ঝকঝক করছে রাস্তাঘাট। একবিন্দু ময়লা পড়ে নেই কোথাও। এতই পরিচ্ছন্ন এখানকার রাস্তায় জুতা পায়ে হাঁটতেও মায়া লাগে।
শিলং শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিবাস গ্রামটি। পূর্ব খাসি পাহাড়ের এ গ্রামকে বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব বাগান’। ২০০৩ সালে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গ্রামের মানুষরাই সমিতির মাধ্যমে একে অনুকরণীয় গ্রামে পরিণত করেছেন। যেখানে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের ব্যবস্থা রয়েছে। সবার চেষ্টায় ছবির মতো গ্রামটি তৈরি সম্ভব হয়েছে। এখানকার সব বাড়িই ঘিরে রেখেছে সবুজ। কোথাও কোথাও পর্যটকদের জন্য বসেছে ছোট দোকান। স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। গ্রামে পাহাড়ি শিলাখণ্ডও চোখে পড়ে। যেগুলো একটির ওপর আরেকটি গায়ে গায়ে লেগে আছে। গ্রামটি পাহাড়ের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেছে।
গ্রামের পথ পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামা করেছে। পথের ধারে বাঁশের তৈরি ডাস্টবিন রয়েছে। পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামার সময় বাঁশের মাচায় একটু জিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। সেখানে চায়ে চুমুক দেওয়া যায়। সঙ্গে বিস্কুট বা হালকা নাস্তাও জুটবে। এ গ্রামে শিক্ষার হার শতভাগ। সর্বত্র রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। পর্যটকদের সেবা দিতে অভিজ্ঞ ছেলে-যুবক-বৃদ্ধ সবাই কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো ইংরেজিতেও দক্ষ। আমাদের ড্রাইভার জানালেন, এ গ্রামে প্রতিদিনই আসেন অসংখ্য পর্যটক। পর্যটকদের জন্য রয়েছে হোমস্টে সুবিধাও। সাধারণত ইউরোপীয়ানরা এখানে এসে বেশ কিছু দিন থাকে। হয়তো নিরিবিলি প্রকৃতিতে একটু শান্তি ও নিজেকে খুঁজে পেতে। গ্রামের একটি হোটেলে লাঞ্চ সারলাম। এবার আমাদের গন্তব্য শিলং।
মেঘালয় ভ্রমণের অন্যতম আনন্দময় অভিজ্ঞতা হলো এখানকার সড়কপথে ভ্রমণ। মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশের সাথে সাথেই আবহাওয়ারও পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এ গরমেও তখন শীত লাগে। ঠান্ডা শীতল আবহাওয়া চলার পথের ক্লান্তি দূর করে দেয়। মেঘ আচ্ছাদিত পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলতে চলতে যাওয়া যায় একস্থান থেকে অন্য স্থানে। হুট করে ছুটে আসা মেঘ কখন যে জড়িয়ে ধরে টেরই পাওয়া যায় না। আবার একহাত দূরেই গেলেই মনে হয় মেঘের লেশমাত্র নেই। চলতি পথে দেখা মেলে অসংখ্য ঝরনা। মেঘালয়ের পাহাড়গুলো যেন একেকটা ঝরনার খনি। পাহাড়ের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকে উন্মাতাল সব ঝরনা। আবার বৃষ্টির কারণেও অস্থায়ী সব ঝরনার জন্ম হয়। মেঘালয়ের বিশাল সব পাহাড়ের সৌন্দর্য তো আছেই। পুরো মেঘালয় যেন সারিসারি পাইন গাছের স্বর্গ। চলতি পথের সৌন্দর্যের কারণে আনমনে মেঘালয়কে ভালোবাসে ফেলা যায়। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। শিলং শহরে প্রবেশের কিছু আগে রয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তর ও ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া।
শেষ বিকেলে শিলং এসে পৌঁছলাম। শিলং এসে প্রথমে হোটেল ঠিক করলাম। হোটেলের নাম ইডেন রেসিডেন্সি, তিনটি সিঙ্গেল বেডের একটি রুমের ভাড়া চাইল ৩০০০ রুপি ব্রেকফাস্টসহ। ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করে সকাল ৮টায়, আইটেম পরোটা, ডিম ও ডাল। আমরা সকাল ৭টার আগেই হোটেল থেকে চেকআউট করবো। তাই দরদাম করে ব্রেকফাস্ট ছাড়া ২০০০ রুপিতে ঠিক করলাম। শিলং সেন্টার পয়েন্টের ঠিক পেছনে ৫-৬টি বিল্ডিংয়ের পরে এর অবস্থান। ভালো মানের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর পরিপাটি রুম। রুমে রয়েছে তিন জনের জন্য তিনটি টাওয়েল, ক্যাবল টিভি, ইলেক্ট্রিক কেটলি, টি-ব্যাগ, বাথরুমে গিজার, সাবান। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। তারপর একটু ঘোরাঘুরি, কিছু শপিং ও রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বের হলাম। কারণ রাত ৯টার মধ্যে মোটামুটি ৯৯% দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে এখানে। আমরা পুলিশ বাজার ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে চলে আসলাম পুলিশ বাজার মসজিদ সংলগ্ন সাভেরা হোটেলে, এটি মূলত একটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট। রাতের খাবার খেয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে পৌনে দশটায় হোটেলে ফিরলাম। কিছুক্ষণ আড্ডা-গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম এগারোটায়। কারণ আমাদের সকাল ৬টার মধ্যে উঠতে হবে।
ভোর ৬টায় মোবাইল অ্যালার্মে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ ঘোছাতে শুরু করলাম। সাড়ে ৬টায় ড্রাইভার আলিম মজুমদার ফোন দিয়ে জানাল, সে হাজির। সাতটার কিছু আগে চেকআউট করে সেন্টার পয়েন্ট মোড়ে পার্কিং করে রাখা গাড়িতে ব্যাগগুলো রেখে রাস্তার পাশে একটি স্ট্রিট ফুডের দোকান থেকে রুটি, ডাল, ডিম ও চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সকালের ঠান্ডায় রোদে দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্ট করতে ভালোই লাগলো। এখন আমাদের আবার ভ্রমণ শুরুর পালা, গন্তব্য এলিফ্যান্ট ফলস। পথে যেতে যেতে আলিম মজুমদার শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলো। বিশাল বিশাল পাইন গাছের সারি দেখে মন ভরে যায়। কৈশোরে পাইন গাছ সম্পর্কে বেশি পড়েছি সম্ভবত মাসুদ রানা সিরিজে। চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে একসময় গাড়ি চলে এলো এলিফ্যান্ট ফলসের পার্কিংয়ে।
চলবে...
লেখক: কলাম লেখক।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ