রাজস্থানে আনন্দ ভ্রমণ : পর্ব ০৪
অরূপ কুমার ভট্টাচার্য
আমরা জয়পুরে ৬ অক্টোবর বিকেল পর্যন্ত থাকব। বিকেল সোয়া ৪টায় জয়পুর থেকে জয়সালমিরের উদ্দেশে রওনা দেওয়া হবে। তাই সকালেই হোটেল ত্রিবেণী রেসিডেন্সি থেকে টিফিন করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু হোটেলের মালিক বললেন, ‘একটা রুমে আপনাদের সকল ব্যাগ রেখে ঘুরে আসুন। আড়াইটা নাগাদ ফিরে এসে ব্যাগপত্র নিয়ে স্টেশনে চলে যাবেন।’ আমরাও রাজি হয়ে গেলাম।
জয়গড় ফোর্ট: হোটেল থেকে বেরিয়ে আজ আমরা প্রথমেই চললাম জয়পুরের জয়গড় ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আগের দিন যে পথে অম্বর ফোর্ট গিয়েছিলাম আজও সেই পথেই গাড়ি চলল। আমাদের সারথি নরেন্দ্র বলল, এই পথেই জয়গড় ফোর্টের রাস্তা। পাহাড়ি পথ, অম্বর ফোর্টের যাওয়ার পথের থেকেও এই পথ এর দু’ধারের দৃশ্য নয়নাভিরাম। পথের দু’দিকে বেশ ঘন জঙ্গল আর সেই জঙ্গলে অনেক ময়ূর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের টিমের কচি সদস্যরা তো গাড়ি থেকে নামবেই, ময়ূর দেখার জন্য। কিন্তু আজ পথে বেশি সময় দেওয়া যাবে না, তাই আমি চোখের ইশারায় নরেন্দ্রকে বললাম গাড়ি না থামানোর জন্য।
গাড়ি সোজা গিয়ে হাজির হলো জয়গড় ফোর্টের তোরণের সামনে। নরেন্দ্র বলল, স্যার আপনাদের আর গাড়ির ভাড়া একসাথে করে নিন। তাহলে গাড়ি সোজা ফোর্টের মধ্যে চলে যাবে। আমি সেই মতই টিকিট কাটলাম। গাড়ি করে ফোর্টের মধ্যে শুধু প্রবেশ নয়, গাড়ি সোজা গিয়ে থামলো ফোর্টের উঁচু একটি চাতালে। যেখান থেকে চারিদিকের পরিবেশ অসম্ভব সুন্দর। গতকাল যে অম্বর ফোর্টে গিয়েছিলাম, সেখানে যতটাই লোকে লোকারণ্য, জয়গড় ফোর্ট ততটাই নিস্তব্ধ ও নির্জন। এত সকালে বলেই হয়তো পর্যটকের ভিড় তখনো হয়নি। সত্যিই এক প্রাচীন দূর্গের মধ্যে এসেছি বলে মনে হলো। অম্বর ফোর্টের মত ঐশ্বর্য ও চাকচিক্যে জয়গড় ফোর্ট ঐশ্বর্যশালী না হলেও অবস্থানগত বিচারে আমার চোখে জয়গড় ফোর্ট সেরা লেগেছে। অম্বর ফোর্ট পদাবলীর বিদ্যাপতির রাজরানি রাধিকা আর জয়গড় ফোর্ট চণ্ডীদাসের সাধিকা রাধা।
গাইডের মুখে শুনলাম অম্বর ফোর্ট আক্রান্ত হলে মহারাজা ও তার রানি এবং পর্ষদবর্গ এই ফোর্টে আশ্রয় নিতেন। এই ফোর্ট কোনদিন শত্রুপক্ষ জয় করতে পারেনি। এখানেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান। যেখান থেকে গোলাবর্ষণ হলে ৪০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়ত। জয়গড় ফোর্ট দেখে আমরা আর নেহেড়গড় ফোর্টের দিকে না এগিয়ে নেমে এলাম জয়পুর শহরের বুকে।
জয়পুর সিটিপ্যালেস: জয়পুর শহরে দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সিটি প্যালেস। এই সিটি প্যালেসের সাথে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে চন্দ্র মহল এবং মুবারক মহল। একসময় জয়পুর মহারাজারা এখানেই বসবাস করেন তারা হলেন কাছওয়াহা রাজপুত গোষ্ঠীর প্রধান। চন্দ্র মহল বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে জাদুঘর হিসেবে। মহারাজা সাওয়াই জয় সিং জুনিয়র ১৭২৯ সাল থেকে ১৭৩২ সালের মধ্যে সিটি প্যালেসটি তৈরি করেন। রাজপুত, মোঘল ও ইউরোপ ঘরানার এই প্রাসাদের স্থপতি ছিলেন বিদ্যাধর ভট্টাচার্য, স্যার স্যামুয়েল সুইন্টন জ্যাকব এবং মহারাজা সাওয়াই জয় সিং জুনিয়র নিজে।
এ প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকের দরজাটির নাম পিকক গেট বা ময়ূর দরজা। অপূর্ব সুন্দর এ দরজাতে অঙ্কিত আছে অসংখ্য ময়ূরের প্রতিকৃতি। শরতের প্রতিকৃতি হিসেবে অভিধাযুক্ত দরজাটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে ভগবান বিষ্ণুকে।
বেশ আধুনিকতা আর ঐশ্বর্যের মোড়কে তৈরি সিটি প্যালেস। জয়পুরের বর্তমান রাজপরিবারের লোকজন এখনো এখানেই বসবাস করেন।
হাওয়া মহল: হাওয়া মহল অর্থাৎ প্যালেস অব উইন্ডস, জয়পুর শহরের একটি প্রাসাদ। এটি লাল এবং গোলাপি বেলেপাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছে। প্রাসাদটি সিটি প্যালেস প্রান্তে অবস্থিত।
ভবনটি ১৭৯৯ সালে মহারাজা সাওয়াই প্রতাপ সিং দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। তিনি খেত্রীয় মহলের অনন্য কাঠামোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং এই ঐতিহাসিক প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি লাল চাঁদ উস্তাদ দ্বারা নকশা করা হয়েছিল। এর অনন্য গঠনশৈলী বড়ই আকর্ষণীয়। বহির্ভাগের ৯৫৩টি ছোট দরজা একটি মৌচাকের সমতুল্য, যা জোরোখাস নামে পরিচিত। হাওয়া মহল তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজপরিবারের নারীদের দৈনন্দিন জীবন এবং উৎসব উদযাপন করার জন্য। যা তারা লোকসম্মুখে পালন করতে পারত না। কারণ তারা ‘পর্দা প্রথা’র কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করতেন।
আমরা বেশ কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে হাওয়া মহলের শীর্ষ দেশে গিয়ে পৌঁছলাম। সেই স্থান থেকে জয়পুর শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার দৃশ্য সত্যিই অতুলনীয়।
সিটি প্যালেস, হাওয়া মহল আর যন্তরমন্তর- এ তিনটি দর্শনীয় স্থান খুবই কাছাকাছি। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময়ের অভাব এবং বিশেষ আকর্ষণ না থাকায় জয়পুরের যন্তরমন্তর না দেখেই সারথি নরেন্দ্রকে বললাম একটা ভালো হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য আমাদের নিয়ে যেতে। নরেন্দ্র নিয়ে গেল হাওয়া মহলের ঠিক উল্টো দিকে শ্রী বালাজি ভেজ ভোজনালয়ে। আগের দিন হোটেল রয়াল সেরাটন নামক যে হোটেলে আমরা মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে ছিলাম তার তুলনায় এটা যথেষ্ট সাদামাটা। তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং খাওয়ার পাতে এক বাটি যে পায়েস দিয়েছিল, সেটা বড়ই সুস্বাদু।
মধ্যাহ্ন ভোজন সম্পন্ন করেই আমরা ত্রিবেণী রেসিডেন্সির দিকে চললাম। মাত্র ১০ মিনিটেই হোটেলে পৌঁছে ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলেই আমরা চললাম জয়পুর স্টেশনের পথে। বিকেল সোয়া ৪টায় জয়পুর থেকে লেলন এক্সপ্রেসে করে আমরা চললাম জয়সালমিরের পথে। পৌঁছাব পরের দিন ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে। একরাতের ট্রেন জার্নি।
চলবে...
লেখক: সহকারী শিক্ষক, বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম শিক্ষায়তন, হলদিয়া, কলকাতা।
এসইউ/এমকেএইচ