হাওর দেখা : চাঁদের আলিঙ্গনে টাঙ্গুয়ার ভরা যৌবন
আজকাল যাকে নিয়ে এত লেখালেখি সে সৌন্দর্যের জলদেবী টাঙ্গুয়ার হাওরকে যেন ছুঁয়ে না গেলেই নয়। বহুদিনের বাসনা ছিল হাসন রাজার বসতবাটি দেখার। তাই সুযোগ যখন এলো এক ঢিলে দুই পাখি। অর্থাৎ বেড়ানো হল আর সে সাথে মনের তথ্য ভাণ্ডারে কিছু খোরাক জমানো গেল।
হাজবেন্ড সরকারি চাকুরে হওয়ায় তার বদলির সুবাদে ঘুরে ফিরে দেখার সুযোগ হয়েছে বাংলার আনাচে কানাচে। এবং এর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, ঘুমিয়ে-ঝিমিয়ে, লুকিয়ে-ঢিমিয়ে থাকা সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম স্নিগ্ধতাও মেখে নিয়েছি সবটুকু। তাই তার সুনামগঞ্জ পোস্টিং শুনে বেশ আনন্দিত হলাম। ছাতকের কমলায় রসনা তৃপ্ত করে পুরো সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘুরে বেড়ানো, টেকের ঘাঁট চুনাপাথর প্রকল্প দেখা আর জৈন্তা খাসিয়ার কোল ঘেঁষে ছুটে চলা হাওর-বিলের তাজা মাছের সুঘ্রাণে পুরোদস্তুর মাছে-ভাতে বাঙালি! সুরমার জলে জলকেলি! এত্তসব ভালোলাগা ভাবতেই চনমনে হলো মন। যেন এতদিনে পূর্ণ হতে যাচ্ছে মনের সুপ্ত বাসনা। তাই ডুবে গেলাম টাঙ্গুয়ার রূপ রহস্যের জলাধারের মোহনীয়তায়। মেঘালয়ের পাদদেশে বিশাল জলরাশির খেলা, যেদিকে চোখ যায় পাহাড়ে ঘেরা চারিধার, স্বচ্ছ আকাশ-স্বচ্ছ জল যেন আকাশের সবটুকু নীল মিশে গেছে স্বচ্ছ জলধারায়। ভরা বর্ষায় চোখেরও ভুল হয়; এ কি তবে কোনো শান্ত সমুদ্র! আর দূরে দূরে ভেসে থাকা গ্রামগুলো যেন একেকটা দ্বীপ। দূরন্ত বেগে স্পিডবোটের ছুটে চলায় যেন এক ভালোলাগার অভূতপূর্ব শিহরণ খেলে গেল । যারা ইতোমধ্যে অবলোকন করেছেন এ হাওর তারা নিশ্চয়ই স্মৃতিখুঁড়ে রোমাঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপর ও ধর্মপাশা উপজেলার ভারত সীমান্তের জৈন্তা খাসিয়ার কোলঘেঁষে এর দখলদারিত্ব। দৈর্ঘ্য ১০ কিমি আর প্রস্থে ৭ কিমি জুড়ে এর বিস্তৃতি। মোট ৫১ টি বিল নিয়ে এ জলাশয় বিশালাকার জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর পাশ ঘেঁষে রয়েছে ৪৬টি গ্রাম আর গড়ে উঠেছে শতাধিক কান্দা। ভরা বর্ষায় এর আয়তন হয় ২০ হাজার একর আর শীত মৌসুমে ৭ হাজার একর। বর্ষায় গ্রামগুলো ভেসে থাকে দ্বীপের মতো আর শুষ্ক মৌসুমে জলাধারে চাষাবাদ হয়ে ধানের। এ এক রূপ বৈচিত্র্যের খেলা। এখানকার মানুষের জীবিকা মাছ ধরা এবং কৃষিকাজ করা।
সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে হাওরে যেতে হলে রয়েছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিডবোট।
স্পিডবোটে চড়ে হাওরে যেতে সময়ের তারতম্য একক মৌসুমে একেক রকম। বর্ষা মৌসুমে দূরত্ব ৪০কিমি এবং সময় লাগে ১ ঘণ্টা। শীত মৌসুমে পানি কমে যায় বলে পথের দূরত্ব ও সময় দুই বাড়ে। তখন সময় লাগে ৩ ঘণ্টারও বেশি।
বিশাল জলরাশির মাঝে ঘুরে ঘুরে কীভাবে যে সময় পার হয়ে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে বোঝাই যায় না তাই এখানে ঘুরতে হলে হাতে পর্যাপ্ত সময় নিতে হয়। মাছের ছোটাছুটি, পাখির ওড়াউড়ি, নীলাভ জলে আকাশ মাটির মিতালি, জলে ভেসে থাকা নানা নামের নানা জাতের জানা অজানা জলজ উদ্ভিদ, কখনো হিজল করচের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া যেন এক চরম ভালোলাগা।
কখনো দেখা যায় গারো জাল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরা কিংবা ছোট ছোট ডিঙি বেয়ে জীবিকার সন্ধানে দূরে ছুটে চলা। তবে এখানে অবাধে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। মাছের প্রাচুর্য থাকায় জেলেদের মাছ ধরার প্রবণতা বেশি। কিন্তু এ হাওর মাছের এবং পাখিদের অভয়াশ্রম। সুন্দরবনের পর এটি দ্বিতীয় রামসার এলাকা ঘোষিত হবার পর এর আন্তর্জাতিক গুরুত্বও বেড়েছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর একমাত্র সর্বশেষ জলাধার এটি যেখানে মাছ, পাখি আর জলজ উদ্ভিদের পরস্পর ভারসাম্যতা বজায় রয়েছে।
মৎস্য সম্পদ রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণার্থে টাঙ্গুয়ার হাওর আজ মাছেদের এবং পাখিদের নিরাপদ বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ সম্পদ রক্ষা তথা বন উজাড় না করা আর অবাধে মৎস্য নিধন না করার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ক্যাম্প। নিয়মিত টহল দিচ্ছে আনসার, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের নজরদারির ফলশ্রুতিতে টাঙ্গুয়ার মিঠা পানির মাছ বিভিন্ন নদীনালা, খালবিলের মাধ্যমে সারাদেশের জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশবাসীর প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে জলের মধ্যে মাথা উঁচু করে জেগে আছে হিজল করচপার বন। পানিতে ভেসে আছে নীল শাপলা, পানি ফল হেলেঞ্চাসহ নানা উদ্ভিদ আরো রয়েছে নলখাগড়া, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, চাইলা, ছন বনতুলসী, শতমূলী ইত্যাদি নানা জাতের দুশো প্রজাতিরও বেশি গাছগাছালি। অভাবী মানুষের জীবিকা আর জ্বালানি চাহিদা মেটাতে, সৌখিন শিকারির থাবা ভরে দিতে আমরা হারিয়েছি প্রকৃতির স্তন্যপায়ী অকৃপণ দানকে, তবু হারিয়ে যেতে যেতেও বিলুপ্ত প্রায় দশ প্রজাতির পাখি, ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী, চার প্রজাতির সাপ, তিন প্রজাতির কচ্ছপ, দুই প্রজাতির গিড়গিটি, এক প্রজাতির উভচর, পঞ্চান্ন প্রজাতির মাছ এবং একান্ন প্রজাতির পাখি তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে এ হাওরকে।
বর্তমানে এখানে রয়েছে ছোটবড় ১৪১ প্রজাতির মাছ। আছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, যার মধ্যে দেশি ১১০ প্রজাতি আর অতিথি ৯৮ প্রজাতি। হাওর পাড়ের হিজল করাচের ডালে ডালে এসব পাখিদের আবাস। তাদের কলকাকলিতে মনে হয় এ এক পাখিদের পৃথিবী। কখনো সাদা বক আকাশে সাদা মেঘের মতো ভাসে কখনো ডাঙায় কানিবক, গুজিবক খাবার খোঁজে। কালিম পাখির ছোটাছুটি, পানকৌড়ির ডুব সাঁতার, ছোটাছুটি পাতিহাঁস আর রাজহাঁসের লুটোপুটি এ যেন নিত্যকার খেলা । শীতকালে সকাল সন্ধ্যায় দেশি পাখির সাথে লাখ লাখ অতিথি পাখির ঝাঁকে যেন নুয়ে পড়ে আকাশ! এখানকার তাপমাত্রা সহনশীল বলেই বাড়ে পাখিদের আনাগোনা। বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রায় বিরল প্রজাতির প্যালাসাস ফিশ ঈগল উড়ে চলে এ জলাধারে। আবাসস্থল খুঁজে পায় করচের বনে, হিজলের ডালে।
শীত মৌসুমে বাড়ে পর্যটকের ভিড়। তবে শুধু শীত নয় সব মৌসুমে এখানে মাছেদের আর পাখিদের সাথে বিচরণ করে উপভোগ করা যায় এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কোন ভরা বর্ষায় নেমে পড়ুন না বোটিং-এ। নতুন পানিতে মাছেদের মতো, নদীর মতো মনের মাঝেও জলস্রোত বাড়বে, বাড়বে ভালো লাগার উন্মাদনা । হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় ভারত বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের উত্তরের শেষ সীমান্ত মেঘালয় রাজ্যের পর্বতমালা। পাশেই বড়ছড়া নদী, মনাইর টিলা আর জুদুঘেরা দৃষ্টি নন্দন জাদুকাটা নদী। বর্ষা আর শরতে এ নদী যেন হয়ে যায় অপরূপা। জাদুকাটার পূর্বপাশে প্রাচীন লাউর রাজ্য, ঝর্ণা আর শাহ আরেফিনের দরগা ঘুরে আসা যায়। বেড়াতে আসার সময়টা যদি চৈত্রমাসে হয় তবে ধর্মপিপাসুরা ওরস দেখে আসতে পারেন। আর সময়টা যদি হয় রাসপূর্ণিমার তবে জোছনা স্নাত হয়ে চাঁদের আলিঙ্গনে টাঙ্গুয়ার ভরা যৌবনের স্রোতে ভেসে ভেসে মিশে যেতে পারেন সুরমার জলে।
এইচআর/আরআইপি