সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য উপেন্দ্র সরোবর!
টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ‘উপেন্দ্র সরোবর’ সৌন্দর্যের এক স্বর্গরাজ্য! জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ধলেশ্বরী বিধৌত নদীবেষ্টিত নাগরপুর উপজেলার কাঠুরি শিব মন্দিরের পাশে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন উপেন্দ্র সরোবর। তবে যথাযথ সংস্কার ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সরোবরটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আটিয়া পরগনার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য উপেন্দ্র সরোবর স্থানীয়দের কাছে ‘বার ঘাটলা দীঘি’ নামে পরিচিত। আজ থেকে ৮৪ বছর আগে ১৩৪১ সালে (মতান্তরে ১৩৬৮ সাল) নাগরপুরের তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর সতীশ চৌধুরী তার বাবা উপেন্দ্র মোহন রায় চৌধুরীর নামানুসারে ১১ একর জমির ওপর এ সরোবর খনন করেছিলেন। উপেন্দ্র সরোবরের চারপাশজুড়ে ১২টি সুপ্রশস্ত ঘাটলা রয়েছে। সরোবরের তলায় রয়েছে ৬টি সুগভীর কূপ বা কুয়া। স্বচ্ছ পানি নিশ্চিত করার জন্য কূপগুলো খনন করা হয়েছে। চারপাশের খেজুরসহ অন্যান্য সবুজ গাছ-গাছালি রয়েছে। দিনের অধিকাংশ সময় হরেকরকম পাখির মিষ্টি ডাক আর কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকে এ সরোবর। দীঘির স্বচ্ছ পানি রুক্ষ্ম-কঠিন মনকেও করবে বিমোহিত।
- আরও পড়ুন
- মন হারায় ধরন্তির ঘোলা জলে
কথিত আছে, এক জোৎস্না রাতে জমিদার রায় বাহাদুর চৌধুরী তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নিজের বৈঠকখানায় জোৎস্না দেখছিলেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন রাতের আঁধারে তার এলাকার কিছু মানুষ দূরে বিল থেকে পানি নিচ্ছে। পরে তিনি খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে, তার এলাকার প্রজারা সুপেয় পানির কষ্টে রাতে পানি সংগ্রহ করেন। এ ঘটনায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে সরোবরটি খনন করার উদ্যোগ নেন। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তা বাস্তবায়ন করেন। তার প্রজাদের সুপেয় পানি নিশ্চিত করার জন্য সরোবরে ১২টি ঘাটলা এবং ৬টি কূপ (ইন্দারা) খনন করেন। সৌখিন মৎস্য শিকারিদের জন্য দীঘিতে মাছ চাষও শুরু করেন। সরোবরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য চারপাশে সুদৃশ্য খেজুর গাছ লাগান।
এ কারণে নাগরপুর উপজেলার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান উপেন্দ্র সরোবর। ভ্রমণপিপাসু ও মৎস্য শিকারিদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। উপেন্দ্র সরোবরের প্রধান প্রবেশপথ উপেন্দ্র সরোবরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। উপেন্দ্র সরোবরের চারদিকে ঘুরলে প্রকৃতির অপরূপ শোভায় মন ভরে যায়। সরোবরের পশ্চিম পাশে প্রধান ঘাট সংলগ্ন মাথায় বিশাল বট গাছ। এ গাছের বিস্তীর্ণ ছায়া আর শীতল বাতাস গ্রীষ্মকালে ভ্রমণপিপাসু ও স্থানীয়দের হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। সরোবরটির উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি গাছ। এসব গাছের নিচে দাঁড়ালে এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিটি পার্বণে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীরা ভিড় করেন উপেন্দ্র সরোবরে।
- আরও পড়ুন
হাজারিখিল অভয়ারণ্যে একদিন
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এক সময় পর্যটকরা আসতেন। দেশজুড়ে পিকনিক স্পট হিসেবে এর সুখ্যাতি ছিল। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সৌখিন মাছ শিকারিরা মাছ শিকার করতে আসতেন। প্রায় দিনই বিকেলে সরোবরে জমে উঠতো তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। কালের বিবর্তনে সংস্কার ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহ্যবাহী উপেন্দ্র সরোবরটি সৌন্দর্য ও জৌলুস হারাতে বসেছে। মুছে যাচ্ছে জমিদারদের স্মৃতিচিহ্ন। সরোবরটির উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে মাঝে মাঝে মাটির বাঁধ ভেঙে দীঘিপাড় সরু হয়েছে। ২-৩টি ঘাট ভেঙে দীঘিতে পড়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ঘাট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী দীঘিটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
নাগরপুরের ঐতিহ্যবাহী উপেন্দ্র সরোবর শহরের চার দেয়ালের গণ্ডি আর যান্ত্রিক একঘেয়েমী ব্যস্ততামুখর জীবন থেকে প্রশান্তির জন্য ঘুরে আসার মতো একটি স্থান। ঢাকা ও টাঙ্গাইল থেকে খুব সহজেই উপেন্দ্র সরোবরে যাওয়া যায়। ঢাকার মহাখালী থেকে বাসযোগে সরাসরি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বাসযোগে সাটুরিয়া পর্যন্ত এসে সেখান থেকে ব্যাটারি চালিত থ্রি হুইলার বা সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে পাটুরিয়া, এরপর সেখান থেকে রিকশা নিয়ে এলেই উপেন্দ্র সরোবর বা বারো ঘাটলা দীঘি। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে উপেন্দ্র সরোবরে যে কেউ বেড়াতে আসতে পারেন।
আরিফ উর রহমান টগর/এসইউ/আরআইপি