শুভ্রতার স্পর্শে : পর্ব ০১
ক্যাথে প্যাসিফিকের ফ্লাইট যখন ঢাকা থেকে উড়াল দিলো, বিমানের ছোট্ট জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরে দেখছিলাম, প্যাসিফিকের বিমানের ডানাগুলোর আকৃতি অনেকটাই বিশাল পাখির পাখনার মতো! আমরা নিশ্চয়ই সবাই আরব্য রজনীতে বিশাল রক পাখির কথা পড়েছি, সিন্দাবাদের সাত সমুদ্র যাত্রার এক পর্বে এর উল্লেখ আছে। দেখে মনে হচ্ছিল পুষ্পক রথে চেপে বসেছি, শ্রীরামচন্দ্র-সীতা যখন লঙ্কা বিজয় শেষে ফিরছিলেন, তখন এতেই ফিরেছিলেন। উপর থেকে ছোট ছোট খেলনার মতো মনে হচ্ছিল সবকিছু। প্রসঙ্গত, এটাই অধমের প্রথম বিমান যাত্রা! তাই হয়তো আবেগের আতিশয্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে!
সকাল ১০টা ২০ মিনিট, টরেন্টো, পিয়ারসন এয়ারপোর্ট।
ইমিগ্রেশনের কারণে ভেতরে ছিলাম বলে বাইরের তুষারের এমন শুভ্রতা চোখে পড়েনি! পুরোটাই শ্বেতবর্ণের এয়ারপোর্ট মনে হচ্ছে সেই সাথে অবিরাম তুষার ঝরছে! প্রথমবারের মতো দেখার রোমাঞ্চ তো ছিলই, এদিকে আবার টার্মিনাল ১ এ পৌঁছানোর তাড়া! এটা টার্মিনাল ৩, প্রথমবার বলে সবকিছুই এলোমেলো হওয়ারই কথা! হলোও সেটা কিন্তুু পথিমধ্যে বাংলা ভাষাভাষিদের সাথে দেখা হচ্ছিল, ওদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করছিলাম। ওরা অধিকাংশই আমার মতো, প্রথম অভিজ্ঞতা!
> আরও পড়ুন- ভ্রমণবিষয়ক লেখালেখি করতে চাইলে
কতদূর পথ গেলাম চারজন যুবকের সাথে, ওদের গন্তব্যস্থল ওন্টারিও। কতদূর পথ পাড়ি দেওয়ার পর ওরা অন্যদিকে চলে গেল, আমি ছুটলাম আমার পথে। এরপর ছোট ছোট কানেক্টিং ট্রেন (লিংক ট্রেন) আছে, ২২.৫ কি.মি. দৈর্ঘ্যের এই বিশাল এয়ারপোর্টের জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার! আরও অনেক উপায়েই যাওয়া যায়- বাস, গাড়ি, ট্যাক্সি আছে, এর জন্য পকেটের পার্সটা একটু হালকা করলেই চলবে! ওখানে ওঠার পর দুই তরুণির সাথে দেখা হলো। ওদের সাথে চললাম কতদূর পর্যন্ত, যেখানে গিয়ে লাগেজগুলো জমা দিতে হয়- ওটাকে ‘চেক ইন’ বলে। দুই তরুণির একজন অবশ্য এসবের সাথে পরিচিত, পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে, ও-ই আমাকে নিয়ে গেল। আমি মোটামুটি রকম পথ হারিয়ে দিশেহারাই হয়ে পড়েছিলাম, অবস্থা বেগতিক দেখে ও ছুটে এলো। সবকিছু দেখিয়েও দিলো, তারপর একসাথেই আসছিলাম, হঠাৎ ওদেরও হারিয়ে ফেললাম। ওরা পিছিয়ে পড়েছিল কোথাও।
অবশ্য অতটা তাড়া নেই ওদের, ফ্লাইট রাত ৮টা ৩০ মিনিটে। আমাকে তো ৪টা ৩০ মিনিটের ফ্লাইটেই উঠতে হবে। তাড়াহুড়োর মধ্যে ওর নামটাই জানা হলো না, ধন্যবাদ জ্ঞাপনও করা হলো না। বিধাতাই জানেন আর কোনোদিন দেখা হবে কি না?
প্রতীক্ষায় রইলাম! এজন্যই যে, পৃথিবীটা গোল। সব গন্তব্যেই পুনরায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ আসে। সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতীগণ সেটা পেয়ে যান! জানি না ললাটের লিখন কী?
ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এসে পৌঁছলাম কানাডা এয়ারওয়েজের ওয়েটিং লাউঞ্জে। ৪২ নম্বর। বসে পড়লাম এক জায়গায়। কোনো এশীয় লোকজন চোখে পড়লো না, বাংলাদেশি তো দূরের কথা! অধিকাংশই খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। আমার ক্ষুধা পেয়েছিল আগেই। শুধু লাউঞ্জটা খুঁজে পাওয়ার তাড়া ছিল। গিয়ে দেখি, স্যান্ডুইচ বা পিৎজা জাতীয় কিছু পাই কি না যাতে অন্তত ঘণ্টা খানেক কিছু না খেয়েও যেন চালিয়ে দেওয়া যায়! অবশ্য সবকিছু ছিল, খুঁজেও পেলাম, খাওয়ার ইচ্ছে হলো না! ডোনাট আর পানি কিনেই সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে এলাম, এত বড় আকারের ডোনাট আগে দেখেছি বলে মনে হয় না! অর্ধেকই খেলাম। এরপর কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করলো, আবহাওয়া প্রতিকূলতার কারণে ফ্লাইট তিন ঘণ্টা দেরি হবে। অগত্যা আর কী করা!
> আরও পড়ুন- মালয়েশিয়ার বাতু কেভসে পর্যটকদের পদচারণা
টরেন্টো থেকে যাব হ্যালিফ্যাক্সে, তারপর চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল সিডনি। এটা কানাডার সিডনি, অস্ট্রেলিয়ার না। শহর সিডনি, প্রদেশ নোভা স্কসিয়া।
ঘুরে দেখতে লাগলাম আশেপাশে। একপাশে ব্যাংকের এক বুথে গেলাম, ওরা ফ্রি অ্যাকাউন্ট করে দেবে এমনটাই বলছিল। করে ফেললাম, কিছু ফায়দাও হলো। বিশ ডলারের গিফট কার্ড পেলাম। ফোনের চার্জও শেষ হওয়ার পথে, প্রতি টেবিলেই বেশ কয়েকটি করে চার্জিং পোর্ট লাগানো। চার্জ করার সময় দেখছিলাম বিমানের সূচিতে আর কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না।
পূর্বঘোষিত সময়ানুযায়ী দেরিতেই বিমান ছাড়লো। গিয়ে বসলাম। উড্ডয়নের সময় শুধু এটাই বোঝা যায়, শূন্যে উঠছি আর নামার সময় মৃদু ঝাঁকুনি জানিয়ে দেবে আপনি ভূতল স্পর্শ করেছেন!
হ্যালিফ্যাক্সে পৌঁছানোর পর আবার আগের মতো কাউন্টার খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে পেলাম কিন্তুু কানেকটিং ফ্লাইট ততক্ষণে উড়াল দিয়েছে, এখন উপায়? আমি যখন কাউন্টারে কথা বলছিলাম, তখন অভি দাদার সাথে কথা হচ্ছিল। উনিই আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। আমার স্কুলের ম্যাডামের ছেলে আবার মা-ছেলে দু’জনই আমার বাবার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী! দাদা রেজিনা প্রদেশে থাকেন, বহুদূরে! উনিও কথা বললেন। তখন ওখানে আরেকজন ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম, তখনও জানি না দু’জনের গন্তব্যস্থল একই জায়গায়! এয়ার কানাডা কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে ও খরচে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলো। দু’জনই একসাথে যাব। মার্কিনি ভদ্রমহিলা- হ্যালি ব্যাটি। পরিচয় দিলেন এবং আলাপ শুরু হলো। আমরা প্রথমেই লাগেজগুলো নিতে নিচে চলে গেলাম, উনিই আমাকে দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তুু লাগেজ কই?
চলবে...
এসএইচএস/এসইউ/আরআইপি