ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

প্রকৃতিই আমার ঘর

জুয়েল থিওটোনিয়াস | প্রকাশিত: ০৪:০১ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

রুমা বাজারে মেঘমেদুর সকালটা মন ভালো করে দিচ্ছিল এই ভেবে যে, আজ যাত্রা শুভ। ওমা! প্রকৃতি যেন কান পেতেই ছিল, মনের কথাটা পড়ে ফেলেই অঝোর বারিধারা। গত রাতও সারা রাত বর্ষণ হয়েছে। তবে দমলাম না। হোটেল থেকে বেরিয়ে, প্যাচপ্যাচে কাদা মাড়িয়ে এক রেস্তোরাঁয় নাস্তা করতে করতে ফন্দি আঁটছিলাম, বৃষ্টি হতে থাকলে কী করবো, না হলে কী করবো? রেস্তোরাঁয় অন্যান্য লোকজন ভয় ধরিয়ে ফিরে যেতে বললেও পাত্তা দেইনি। একসময় বৃষ্টি থামল, তৌহিদ আসলো। জানালো, জিপ যাওয়ার মতো বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কোন মাঝিও নৌকা নিয়ে বেরুতে চাচ্ছে না, প্রমত্তা সাঙ্গুর স্রোতের বিপরীতে উজানের দিকে নৌকা বাওয়া মুখের কথা না। তৌহিদকে অনুরোধ মোতাবেক চেষ্টা চালাতে লাগল, ওদিকে আমরা ভাবছিলাম এগোতে না পারলে হেরে ফিরে গেলে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে সীতাকুণ্ড আর মিরসরাইতে ঝরনা দেখবো। এসব বাজে চিন্তায় ছেদ ঘটালো তৌহিদ। হাতে সদায়পাতি নিয়ে এসে বলল, ‘চলেন সেনাক্যাম্পে নিবন্ধন করে আসি, নৌকা জোগাড় হয়েছে’। আকর্ণ হাসি দিয়ে ক্যাম্পে নিবন্ধনের সময় দায়িত্বরত সেনাসদস্য সাবধান করে দিলো যেন মশা আর হাতিপোকা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখি, অন্যথায় ম্যালেরিয়া বা কালাজ্বর। আরেক সেনাসদস্য কিছু ওষুধ দিয়ে বলল, ‘ওগুলো যেন বগালেক ক্যাম্পে পৌঁছে দেই’। মজার বিষয় হলো, বগালেক পর্যন্ত যেতে রাস্তা এতটাই খারাপ, সেনারা যেতে সাহস না পাওয়ায় আমাদের ওপর ভরসা করলো। এ কথা পরে অনেকেই বিশ্বাস করেনি কিন্তু এটাই সত্যি। নৌকায় উঠে হাতে-পায়ে গলায় সরিষার তেল আর গুল মাখছিলাম, এটা জোঁকের আক্রমণ ঠেকানোর বর্ম। আকাশে মেঘ থাকলেও সূর্য উঁকি দিচ্ছিল মাঝে মাঝেই। তাহলে কি প্রকৃতি সদয় আমাদের প্রতি? মারমা পাড়া মুনলাই পৌঁছে নৌকা বিদায় দিয়ে হণ্টন।

hill

২০১৫ সালের ভরা বর্ষা। সেবার প্রবল বর্ষণে পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক ধসে পাহাড় একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছিলো, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ। যাওয়ার বেশ আগে থেকেই খোঁজখবর নিচ্ছিলাম যাওয়া যাবে কিনা। গাইড তৌহিদও বারবার বিবেচনা করতে বলল আমরা আদৌ পারবো কিনা। আমরা জেদ করেছি যাবই। সানভী, আমি, মিতু, ইশরাক আর হাসিব। যাওয়ার আগে ঘূর্ণিঝড় কোমেনের বাড়তি বিভ্রাট। গুষ্টি কিলাই তার। চট্টগ্রাম শহর পেরিয়ে বান্দরবান যেতে যেতে চোখে পড়ল, বৃষ্টি আর বন্যায় অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। বান্দরবান শহরে প্রবেশের আগে আচমকা বাস থামল, বেইলি সেতু ভাঙা। অ্যাডভেঞ্চার শুরু। হেঁটে পেরিয়ে চান্দের গাড়ি ঠিক করলাম। সঙ্গী হলো আরেক দল, যারা ঢাকা থেকে আমাদের সাথে এক বাসেই ছিল, তারাও রুমা যাবে তবে নিরুদ্দেশ ট্রেকিং। দু’পক্ষই খুশি হলো খরচ কমলো বলে। শহর পেরিয়ে চড়াইয়ে উঠে কিছুদূর পরপর চোখে পড়ল, বর্ষার উপর্যুপরি আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পাহাড় নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুইয়ে ফেলছিল। একপর্যায়ে রাস্তা এমন ভাঙা পেলাম, চান্দের গাড়ি বিদায় দিয়ে বহু কায়দা কসরত করে ভাঙা রাস্তা আর কাদা পেরিয়ে (কাদায় সানভী তার এক জোড়া স্যান্ডেল হারিয়েছিল) উচ্চমূল্যে আরেকটা চান্দের গাড়ি ঠিক হলো। পুরো পথের কোথাও উদ্ধত খাড়া, কোথাও আবার ধা করে অধঃপতন। আর প্রতিটা মোড় শ্যামল সুন্দরের অবগুণ্ঠন খুলে নিজেকে মেলে ধরে। উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢেউ তো আছেই, আছে সান্দ্র মেঘের আনাগোনা। রাস্তা আটকে বিশাল গাছ পড়ে থাকতে দেখে দলবেঁধে হেঁইয়ো বলে গাছ সরিয়ে আবার চলা। কিছুদূর যেতেই মুশকিল। এবার পাহাড় ধসে পুরো পথের ওপর টিলা হয়ে আছে। অগত্যা হাঁটা, পথ ম্যালা বাকি, ২১ কিলোমিটার। চিন্তা লাগল এতো কষ্ট করে ছুটি পেলাম, এসব ঝঞ্ঝাটে একদিন চলে গেলে কেমনে কী? প্রকৃতি এতটাই বিরূপ? মনে পড়ল তার উক্তি, ‘আমি আমার মতো করে নিজেকে তোমার কাছে মেলে ধরব এবং সেটাই তোমাকে গ্রহণ করতে হবে তা যেমনই হোক’। জয়তু প্রকৃতি। সবসময়ের মতো এবারো সানভী সবার আগে দলছুট হনহন। আমরা বাকিরা কখনো নিজেরা, কখনো সেই দলের সাথে। স্থানীয় মানুষ নিশ্চয়ই আমাদের পাগল ভাবছিল; এমন মারমুখী বর্ষায় এই পাহাড়ে! চা দোকানে কেউ কেউ সরাসরি জিজ্ঞেস করলে স্মিত হেসেছিলাম। এক জায়গায় বিশ্রামের সময় এক মুরং দিদি কী মনে করে আমাকে একটা ফুল দিলো, শুভ কামনা বোধ হয়। তবে সঙ্গীদের ঘন ঘন জিরিয়ে নেওয়াটা পিছিয়ে দিচ্ছিলো। ওদিকে নেটওয়ার্ক কাজ না করায় সানভীকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। বাস পাচ্ছিলাম না, পেলেও ভরপুর। কতক্ষণ হাঁটবো? পথে মাটির বিশাল এক চাঁই দেখে আমরা হেসেছিলাম এই ভেবে যে, সানভী এর নিচে না তো আবার। কৈক্ষা ঝিরি ঘাটে পৌঁছে আবারও চড়াদামে নৌকা ঠিক করলাম রুমা বাজার পর্যন্ত। এবারও সঙ্গী সেই দলটি। নৌকা ছাড়তেই তুমুল বৃষ্টি। অকস্মাৎ বিকট আওয়াজে নৌকার ঠিক মাঝখানের তলা ভেঙে পানি ঢোকা শুরু করলো। চটজলদি পাড়ের কাছে নিয়ে মেরামত করে, পানি সেচে আবার রওনা। ওদিকে সানভীর নম্বর বন্ধ পাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ছিলো, বন্ধ পাচ্ছিলাম তৌহিদের নম্বরটাও। রুমা সেতুর কাছাকাছি গিয়ে তৌহিদের নম্বর খোলা পেয়ে কথা হলো তার সঙ্গে, জানলাম সানভী তার পাশেই। দুপুরে রুমা ঘাটে নেমে তৌহিদকে জড়িয়ে ধরলাম। গত হেমন্তে কেওক্রাডং-তাজিনডং ট্রেকিংয়ে সদ্য কৈশোর পেরোনো তৌহিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। তৌহিদ জানালো, রাস্তার যে অবস্থা তাতে ৪টার ভেতর বগালেকে পৌঁছানো অসম্ভব। ওই সময়ের ভেতর সেখানে না পৌঁছলে প্রবেশ বা বাহির বেসম্ভব। বাধ্য হয়েই একটা কম দামি হোটেলে উঠলাম। ভোরে উঠে নাকে-মুখে খেয়ে না খেয়ে রওনা দিতে হবে, এই বলে রাতের খাবার সন্ধ্যায় খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো তৌহিদ। আমাদের গাইড কাম রাঁধুনি। ঘুমানোর আগে সানভীকে প্রাণভরে সবাই বকলাম আমাদের রেখে একা এগিয়ে যাওয়াতে, সে-ও পাল্টা বকল আমরা পিছিয়ে পড়াতে।

hill

ইট বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছি বগালেকের উদ্দেশ্যে। কাঁচা রাস্তায় পা রাখার সময় থেকে শুরু হলো জোঁক সতর্কতা। তাতে কী? কম-বেশি সবাইকে হানা দিচ্ছিলো। বাংলা জোঁক, চীনা জোঁক, টাইগার জোঁক; টাইগার জোঁক দেখতে খুব সুন্দর তবে আকার আকৃতিতে বড় ও তার কামড়েও খুব জোর। বেশি নাড়া দিলো কিছুদূর পরপর পাহাড় ধ্স দেখে, সেসব জায়গা কোমর পর্যন্ত কাদা, প্রায় সাঁতরে পার হচ্ছিলাম। কাদাসহ ধসে পড়ে গেলে গিরি সমাধি। একেই সানভী বারবার অভিযান বলছিল। অথচ সেই বারবার আগবাড়িয়ে কাদায় নেমে আটকে যাচ্ছিল আর পরে কাদাকে গালি দিচ্ছিল। অবাক করলো পথের সাথী এক বম পরিবার, ওদের বাচ্চাটার এক মুহূর্তের জন্যও বিরাম নেই। শইরতন পাড়ায় নাস্তা খেয়ে আবার ছোটা। বগালেকের আগের চড়াইয়ে আমার আঁতকা শ্বাসকষ্ট আর পায়ের রগে টান পরায় পিছিয়ে পড়ছিলাম, দলটাকেও পিছিয়ে দিচ্ছিলাম। কষ্টেসৃষ্টে বগালেক সেনাক্যাম্পে নিবন্ধন ও ওষুধ হস্তান্তরের সময় সেনারা অবাক যে, কীভাবে আমরা আসলাম। আমরা গর্ব করিনি তবে ওটাই সত্য ও বাস্তব। শিউলি বমের বাড়িতে অপরাহ্ন ভোজ, কাঁচা-পাকা আম দিয়ে শুঁটকি ভর্তা, গরুর মাংস, বাঁশের কোড়ল, ডাল আর বাংলা কলা। চাঙা হয়ে কেওক্রাডংগামী ট্রেইলে, এই পথটা অতি সহজ ও দারুণ। কেওক্রাডংয়ে তো শখের মানুষ জিপে চড়েও যায়, থাক সে কথা। চিংড়ি আর পাতা ঝরনার সঙ্গে পুনর্মিলন আর নব মিলন পাহাড়ের খাঁজ থেকে উৎসারিত মৌসুমি ঝরনাগুলোর সঙ্গে। বিশেষ করে চিংড়ি ঝরনা। গত হেমন্তের বুড়িয়ে যাওয়া কলকল পানি বর্ষায় মত্ত যৌবনের ঘোলা প্রসবণ। সামনের দিক ছাড়া ৩ দিক দিয়ে পাহাড় ও গাছপালায় ঘেরা বিশ্বাস্য সুন্দর। সমস্ত দিনের শেষে পাহাড়েও সন্ধ্যা নামে তবে ঝুপ করে। ঝরনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেইলে। টর্চ জ্বলল। পথচলা শুধুই পথচলা ছিল না, ছিল হাসি, গুলতানি, গান, গল্প। একসময় খেয়াল হলো, আমার দুই উরু চটচটে লাগছে। হাত দিয়ে ধরে হাতে টর্চ মেরে দেখি রক্ত, প্যান্টের ভেতর আলো ফেলে দেখলাম আমার যৌনাঙ্গের গোড়া থেকে রক্ত ঝরছে। জোঁক বাবাজি কাজ সেরে সটকে পড়েছে। তৌহিদকে জানাতে সে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝোঁপ থেকে বুনো লতাপাতা পিষে আমার হাতে দিয়ে বলল রক্ত ঝরার স্থানে লাগিয়ে রাখতে। লাগালাম তবে রক্ত পড়া বন্ধ হলো না, কারণ রগে কেটেছে। ধুর, ঠিক হয়ে যাবে ভেবে সামনে এগিয়ে চললাম। দার্জিলিং পাড়ায় মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঁকি মারলো। কেওক্রাডং পৌঁছলে লাল মুন থন বম (লালা বম) দাদা একটা ক্রিম দিলো, আমি সেটা তুলায় মেখে জায়গামত লাগিয়ে গজ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলাম। তবে খুব আনন্দিত হয়েছিলাম লালাদার পরিবার আমাদের চিনতে পেরেছিল বলে। সেনাক্যাম্পে নিবন্ধন সেরে, স্নান করে, ধুমসে রাতের খাবার খেয়ে নিদ্রায় শায়িত হলাম।

hill

ভোরে উঠে দৌড়ের উপর থাকতে হবে কারণ একদিন পিছিয়ে পড়েছি। তৌহিদ পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি গত কয়েকদিন বৃষ্টির সঙ্গে লড়াইয়ের পর সুরুজ মিয়া আজ হেসেছে। জোঁকের কামড়ের জায়গার রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে তবে প্যান্ট আর বিছানা রক্তে ভিজেছিল। দ্রুত নাস্তা খেয়ে, পানি আর বাংলা কলা নিয়ে ছুট। আজ সবাই ফিট, পয়লা দিন ট্রেকিংয়ে হ্যাপা যায়। গৌরবান্বিত দেশের সর্বোচ্চ গ্রাম মেঘপল্লী পাসিং পাড়ায় জীবনে জীবন মেলাবার আয়োজন। দূরে নিচে চোখে পড়ল সাংসুং পাড়া আর রুমনা পাড়া, দেখে মনে হয় এই তো কাছেই অথচ ওই আর কী। মাঝে মেঘের অনেক স্তর আর দূরে আকাশ সমান নীল পাহাড়ের সারি। এখন আমরা নামছি। পথে জোঁক, মশা আর হাতিপোকার ভালোবাসা তো আছেই। ভালোবাসা আছে একটানা বা থেমে থেমে ঝিঁ-ঝিঁর ডাক, পাখির কলকাকলি আর বর্ষাস্নাত বৃক্ষরাজির। জাদিপাই পাড়া পৌঁছে দেরি না করে আবার নামা, ঝিরি পেরিয়ে প্রান্তর। ট্রেকারদের ভাষায় ‘জোঁকের স্বর্গরাজ্য’। কানে এলো তৌহিদের সাবধানবাণী, সামান্য দেরি বা অসাবধান হলেই জোঁক আপন করে নিবে।

প্রান্তর পেরিয়ে শুনতে পেলাম উদ্দাম জলধারার রব। উত্তেজনায় হৃদস্পন্দনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পায়ের গতি বেড়ে গেলো। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জংলা মাড়িয়ে অবশেষে দেখা পেলাম তার। সুন্দরতমা অন্যতমা। জাদিপাই। যৌবনের সমস্ত বাঁধ খুলে দিয়েছে সে। দুধসাদা পানি নিচে আছরে পড়ে আবার লাফিয়ে উঠছে ওপরে। সেখানে রবির কিরণছটা জলবিন্দুতে মিশে রংধনু সৃজনে ব্যস্ত। পারিনি যেতে জাদিপাই এর কাছে, পাহাড় ধসে সব পথ বন্ধ, যেতে হবে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে। দূর থেকে প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে তার সৌন্দর্যের আস্বাদ নিয়ে বিদায়। ফেরার পথে যতো দ্রুত সম্ভব জোঁক প্রান্তর পেরিয়ে, চড়াই উৎরাই ডিঙিয়ে জাদিপাই পাড়ায় খানিক বিশ্রাম। আজ অন্তত আরও একটা ঝরনা। মোট ৩টি বুনো ঝরনা দেখব। পাসিং পাড়া হয়ে আবার নামা। অনেকখানি নেমে আবার ওঠা, এরকম কয়েকবার। সাংসুং পাড়ার কারবারির বাড়িতে ব্যাগ বোঁচকা রেখে পানি ও শুকনো খাবার নিয়ে রওনা, পথে সেনাক্যাম্পে নিবন্ধন করে রুমনা পাড়া পেরিয়ে, চড়াই উৎরাই মাড়িয়ে পুনরায় যৌবনের গান।

সেকি তেজ তার। তবে তার আসল রূপ সদা সর্বদা কান্নাঝরা। বিরহ বেদনাবিধুর কিশোরী জিংসিয়াম এখান থেকে পরে আত্মাহুতি দেওয়ার পর ঝরনা হয়ে বেঁচে রইলো, নাম নিল জিংসিয়াম সাইতার। বম ভাষায় সাইতার অর্থ ঝরনা। আমরা যাব প্রথম ধাপে, তার আগে তৌহিদের সহযোগিতায় উদ্ধত স্রোতধারা পেরোলাম তবে তৌহিদ তার স্যান্ডেল হারালো। এরপর সাথে আনা পাটের দড়ি নিয়ে তৌহিদ গেল ওপরে, আমাদের ওঠার পথ সুগম করতে। দড়ি, গাছের ডাল-শেকড়কে আশ্রয় করে ভেজা পিচ্ছিল সরু রিজ ধরে উঠে তাজ্জব বনে গেলাম। এতো সুন্দর সে! হা হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, ওই হা-করা মুখ আর বোকা দৃষ্টি দিয়ে আলিঙ্গন করলাম তার শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ।

hill

রুমনা পাড়ায় পৌঁছার আগে আঁধার ঘনিয়ে আসলো। বনপথে ঊর্ণনাভ সরাতেই খেয়াল হলো এপিটাফগুলো হয়ে উঠছে আদিভৌতিক। মুচকি হেসে পৌঁছে গেলাম সাংসুং পাড়ায়। ঝিরি থেকে পাইপলাইনে আনা পানি দিয়ে স্নানের পর তৌহিদের রান্না করা খিচুড়ি আর মুরগি যেন অমৃত। রাতে চাঁদ ওঠে, আমার চোখে ঘুম নেই, তবু জোর করে শুতে গেলাম।

অন্ধকার থাকতে ঘুম তাড়িয়ে আবার ছুট। জুম ক্ষেত পেরিয়ে আঙুল উঁচিয়ে দূরে তৌহিদ দেখাল কপিতাল চূড়া। ততক্ষণে জীবন পূর্ণ করা সোনালি দীপ্তি ছড়াচ্ছে সূর্য। পড়ে যাওয়া গাছ ডিঙিয়ে দেখা হলো জমজের সাথে। জোড়া ঝরনা ত্লাবং বা ডাবল ফলস। রেমাক্রি খালের উৎস। এখানেও পাহাড় ধ্স হওয়ায় পথ চরম মাত্রায় দুর্গম। অগত্যা দূর থেকেই ভালোবাসলাম জমজ সুন্দরকে। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। বিদায় বেলায় বুকের ভেতর অগ্নোৎপাত। বেঁচে থাকলে আবার আসবো। উহু। বেঁচে থাকবো এবং আসবো। হুড়াহুড়ি না, লম্বা সময় নিয়ে আসবো।

যে পথে আগমন, সে পথেই নির্গমন। দার্জিলিং পাড়ায় নুডলস দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে পথে নামতেই গগন ভাঙা বারিধারা। সানভীর হদিস পেলাম না। বগালেকে পৌঁছে দেখি শিউলির বাড়ির বারান্দা থেকে বৃষ্টির জলের সঙ্গে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, উৎস সানভীর পায়ের রগ। জোঁক বাবাজির কারসাজি। তৌহিদ দ্রুত বুনো লতাপাতা লাগিয়ে দিলো ক্ষতে। বৃষ্টির থামার সঙ্গে রক্ত পড়াও বন্ধ হলো। তৌহিদ জানালো আজ এখানেই যাত্রাবিরতি। একদিন পিছিয়ে পড়ায় একদিন বেশি লাগল, অফিসে ফোন করে একদিন বেশি ছুটি নিলাম। এরপর সবাই মিলে বগালেকে ঝপাঝপ, গভীর শান্ত স্নিগ্ধ টলটলে জলে অবগাহনের সময় মাছেরা সুড়সুড়ি দিলো। বাঁশের কোড়ল, জুমের মরিচ ভর্তা আর মুরগি দিয়ে সান্ধ্যভোজের পর তৌহিদের কণ্ঠে স্বপ্নসারথি সুর। ডানা ঝাপটে অংশ নিলো নিশাচর পাখি, ঝিঁ-ঝিঁ পোকা, ইন্দু তারকা আর দখিন হাওয়া। আমরা বন্দী হয়ে পড়লাম অদ্ভূত মায়াজালে।

প্রাতরাশ সেরে বগালেককে বিদায় জানালাম। এবার পথের সাথী মিষ্টি মেয়ে আবেক, সে যাবে বান্দরবান শহরে নিজ বাড়িতে, বগালেকে এসেছিলো বোনের শ্বশুর বাড়িতে। হাসিবের সঙ্গে বেশ খাতির জমলো। আবার সানভী তার স্যান্ডেল হারালো কাদায়। তৌহিদ তারটা সানভীকে দিয়ে বাকি পথ খালি পায়ে চলল। শইরতন পাড়ার পর তৌহিদের ঠিক করা জিপ পেলাম। দ্বিতীয় দিন পশলা পশলা বৃষ্টি ছাড়া পরের ২ দিন রোদেলা থাকায় রাস্তা অনেকটাই জিপ-সুগম। রুমা পৌঁছে অনেকক্ষণ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য হজমের পর, তৌহিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাবলিক সিস্টেমে বান্দরবান শহরগামী নৌকায় চড়লাম।

hill

দু’পাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি মনঃকষ্টে ভুগলাম, ঢলে পাড় ভেঙে বসত বৃক্ষ বিলীন হওয়াতে। বান্দরবান শহরে দুপুরের আহার আমাদের সঙ্গেই খেলো আবেক। খাওয়ার পর বিদায় সম্ভাষণে হাসিব নিজের ফোন নম্বর আবেককে দিলো। পরবর্তীতে আবেক কোনদিন হাসিবকে কল দিয়েছিল কিনা আমরা জানতে চাইনি, হাসিবও আমাদের জানায়নি। বাস সেই রাতে, বিকেলটা আশপাশে কোথাও বেড়ানোর পরিকল্পনা মোতাবেক গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। রাতে পেটপূর্তি করে বাসে চড়ে মনে হলো, ‘ফিরবো ঘরে কোথায় এমন ঘর’। অন্তত আমার জন্য মিথ্যে। নগরের প্রবাস জীবনে হাঁপিয়ে উঠলে এই প্রকৃতি-আলয়েই আমার ত্রাণ মিলবে।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা-বান্দরবান বাসভাড়া তো জানাই আছে। অসংখ্য বাস যায় বান্দরবান। নন এসি ৬২০ টাকা, এসি ৯০০-১৫০০ টাকা। বান্দরবান নেমে রুমা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত অটো ভাড়া ২০ টাকা, সেখানে থেকে টিকিট কেটে সদরঘাট ২শ’ টাকা। এরপর চান্দের গাড়িতে ৩০-৪০ টাকা।

কোথায় থাকবেন
রুমায় গাইড অফিসে যোগাযোগ করে গাইড ঠিক করতে হবে। কেওক্রাডং পর্যন্তই যাওয়া যায় এখন, এর বেশি যেতে দেয় না সেনাবাহিনী নিরাপত্তার কারণে। চাইলে প্রথম দিনই কেওক্রাডং যাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে রাতেও ট্রেক করতে হবে। নয়তো বগালেক পর্যন্ত। আদিবাসীদের বাড়িতে লজিং ব্যবস্থায় থাকা ১৫০ টাকা, খাওয়া ৮০-১২০ টাকা। ৪-৫ দিন লাগে ওই ৩ ঝর্ণা দেখে ফিরে আসতে। গাইডের খরচ আলোচনা সাপেক্ষে ৫-৬ হাজার।

সঙ্গে যা রাখবেন
জাতীয় পরিচয়পত্র, না থাকলে জন্মনিবন্ধন সনদ; গাইড অফিসে ও সেনাক্যাম্পে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজন। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও পানি। পানির জন্য বোতল। ঝরনা, ঝিরি, গ্রাম বেশ দূরে দূরে, সেক্ষেত্রে যথেষ্ট পানি ও শুকনা খাবার সঙ্গে রাখতে হবে। মশা, মাছি তাড়াতে ওডোমস। জোঁকের জন্য সরিষার তেল-গুল অথবা কেরোসিন। ওষুধ রাখতে হবে সাধারণত যা লাগে সেগুলো- ব্যান্ডেজ, তুলা, অ্যান্টিসেপ্টিক। অপচনশীল কিছু ক্যারি করার জন্য পলিথিন নিতে হবে। ট্রেক শেষ করে বান্দরবান শহরে এসে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে ময়লাগুলো। গরমে গেলে জার্সি পরা ভালো, তাতে ঘামলে জামা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যাবে না। শীতে গেলে শীতের পোশাক থাকবে। বর্ষায় ছাতা বা বর্ষাতি। পায়ে ট্রেকিং স্যান্ডেল যেটা রুমাতেই কিনতে পাওয়া যায়, ১২০ টাকা।

যা দেখবেন
বলা হয় দেশের অর্ধেক সৌন্দর্যের আধার বান্দরবান। বান্দরবানে প্রবেশেই পাহাড়ি রাস্তা দূর করে দিবে সারা রাতের ধকল। এরপর রুমা পর্যন্ত আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পথে মাথা কিছুটা দোলালেও চারপাশের সবুজ গাছগাছালি আর নীল আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে পৌঁছে যাবেন রুমায় টেরই পাবেন না। রুমা থেকে বগালেক, কেওক্রাডং পুরো পথ সেই পাহাড়ি সবুজ, নীল আকাশ। পাখপাখালি আগের মতো নেই। আর আদিবাসী গ্রাম। পথে পড়বে ঝিরি, ঝরনা। গান গাইলেও হইহল্লা করা একেবারেই উচিত না। আর স্থানীয় মানুষ আপনার কাছ থেকে ভালো ব্যবহার আশা করে।

এসইউ/আইআই

আরও পড়ুন