পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : দশম পর্ব
কাশিয়ানী উপজেলার নামকরণ নিয়েও ভিন্নমত আছে। তার মধ্যে যে দু’টি বেশি গ্রহণযোগ্য তা হলো- নওয়াব আলীবর্দি খাঁর আমলে এই গ্রামের জমিদার ছিলেন বাবু দর্পনারায়ণ সেন। তিনি নিজ গ্রামে কাশীনাথ দেবের পাঁচটি মূর্তিসহ পাঁচটি সুদৃশ্য মন্দির স্থাপন করেছিলেন। কাশীনাথ দেবের নামানুসারে দর্পনারায়ণ সেনের গ্রামটির নাম হয়ে যায় কাশিয়ানী। অন্যমতে শোনা যায় যে, এ অঞ্চলে পূর্বে প্রচুর কাশফুল হতো, এজন্য এ উপজেলার নাম হয়েছে কাশিয়ানী। ভটিয়াপাড়া ও ফুকরা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। ১৯০৮ সালে মুকসুদপুরকে ভেঙ্গে কাশিয়ানীকে সতন্ত্র থানা করা হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের সনামধন্য পরিচালক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং অভিনেতা কাজী হায়াৎ, প্রখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসানসহ আরো অনেক কৃতি সন্তানের জন্ম এই কাশিয়ানীতে।
আজ যাবো ভাঙ্গা পর্যন্ত। আজকের পথটা আরো বেশি লম্বা। প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। তাই খুব ভোরেই রওনা হলাম। এখনো দিনের আলো ফোটেনি। অপরিচিত জায়গা ও রাস্তা। গ্রামের রাস্তা, বাঁশঝাড়, গাছপালা থাকায় অন্ধকারটাও একটু বেশি। তাই ভয়ও ছিল একটু বেশি। তবু হেঁটে চলছি। দিনের আলো চারপাশ আলোকিত করে তুললো। আজ কুয়াশা নেই, তাই হাঁটতেও ভালো লাগছে।
দিন বাড়ার সাথে সাথে নতুন একটা ভয় দেখা দিচ্ছে। ভয়টা হলো আকাশ মেঘে ভরে গেছে। যদি বৃষ্টি শুরু হয়, তাহলে হাঁটতে পারবো না। তার মধ্যে আজকের পথটাও লম্বা। মনে হচ্ছে আবার সন্ধ্যা নামছে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। বাতাসও শুরু হচ্ছে। ঠাণ্ডার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। যে ভয়টা বুকের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে তা আর বেশি সময় নেয়নি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সাথে ঝড়ো বাতাস। হাইওয়ে ধরে হাঁটছি। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। কোথাও আশ্রয় নেবো এমন কিছু পেলাম না। ঠাণ্ডা বাতাস আর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই এগিয়ে চললাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি তেলের পাম্প পেলাম। সেখানেই বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলাম।
প্রায় বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মকসুদপুর এসে পৌঁছলাম। আগেও একবার এখানে এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর সাথে। এখানে একটি মেয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো- আমিই শাকিল কিনা। তার সাথে তার এক ভাইও আছে। তারা নাকি সকাল থেকে আমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছে। তারা রাতে কোনো এক টিভি নিউজে দেখেছে। তাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাথে পিঠাও এনেছে। একটি চায়ের দোকানে আমরা বসলাম। তিন-চার ধরনের পিঠা খাচ্ছি আর তাদের সাথে গল্প করছি। মনে মনে ভাবলাম, যাক বাবা, আজকের দুপুরের খাবারে কিছুটা হলেও ভিন্নতা এসেছে। পিঠা দিয়েই লাঞ্চ হয়ে গেল। মেয়েটির নাম কেয়া। সে বন্ধুসভার মকসুদপুর শাখার সদস্য। গায়ে একটা চাদর জড়ানো। বেশ মিষ্টি দেখতে। কেন যেন মনে হলো- আগে থেকেই চেনা। তবে এটাও নিশ্চিত যে, তাকে আগে কখনো দেখিনি। তবে মাঝে মাঝেই এমনটা মনে হয়। অপরিচিত কাউকে দেখলে মনে হয় তাকে আগে কোথাও দেখেছি। এটা কি কোনো রোগ কিনা জানি না। আর যদি রোগ হয়েই থাকে তাহলে এ রোগের নামটা কী?
ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ধরে হাঁটছি। এখনো প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ বাকি আছে। আজ আর সূর্যের দেখা পেলাম না। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ও বাতাস থেমে থেমে হচ্ছে। ছোট একটি নদীর তীরে একটি বাজার পেলাম। ব্রিজটা পাড় হয়ে বাজারের ভেতরে ঢুকে একটি ছাতা কিনে নিলাম। সন্ধ্যায় যদি বৃষ্টি বেশি হয় সেই ভয়ে। আজ আমাকে রাত পর্যন্ত হাঁটতে হবে। আজ যেন তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসছে। মেঘের কারণে অন্ধকারও হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। রাস্তায় কোনো মানুষজন নেই। সবাই দিন থাকতেই ঘরে ফিরেছে হয়তো। আমার ভেতরে ভয়টা আস্তে আস্তে বেড়ে চলছে। গলাটাও শুকিয়ে আসছে। সাথে যে পানি ছিল, তা-ও শেষ। বৃষ্টিও বেড়ে চলছে। বাতাসে ছাতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমাকেসহ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। রাস্তার পাশের গাছগুলোও বাতাসে সামনে এসে পড়ছে। মনে হচ্ছে কোন সিনেমা দেখছি। সাথে টর্চ লাইট নেই। তাই মোবাইলের টর্চেই পথ দেখে এগিয়ে চলছি। মোবাইলের চার্জ তেমন নেই। ভয় আরো বেড়ে যাচ্ছে। সামনে আরো কতটুকু পথ যেতে হবে বুঝতে পারছি না। রাস্তায় কোনো মাইলফলক নেই। এমন সময় ঢাকা থেকে আইভি আপা ফোন করেছেন আমার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। পরে আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য ও আমি যেন কথায় কথায় এগিয়ে যেতে পারি, সেজন্য তিনি আমার সাথে ফোনে সংযুক্ত ছিলেন ভাঙ্গা পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত।
রাস্তার পাশে একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। মোবাইলের আলোতে দেখলাম সেখানে লেখা- চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের বাড়ি। তারেক মাসুদ ছিলেন একজন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার। ২০০২ সালে নির্মাণ করেন তার প্রথম ফিচার চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’। যার জন্য তিনি ২০০২ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট’সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে তার পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সোনার বেড়ি’ এবং সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’ মুক্তি পায় ২০১০ সালে। চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। তিনি ১৯৫৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই নূরপুর গ্রামে যাওয়ার তিন রাস্তার মোড়ে। পাবনার ইছামতী নদীর তীরে ‘কাগজের ফুল’ নামক চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের কাজের জন্য তারেক মাসুদ তার সহকর্মীদের নিয়ে যান। লোকেশন নির্বাচন শেষে ঢাকায় ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তারেক মাসুদসহ বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরও নিহত হন।
ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে। বৃষ্টিও যেন অলসভাবে ঝরছেই। পায়ের জুতা ভিজে চ্যাঁপচ্যাঁপ করছে। হাঁটতে মোটেও ভালো লাগেছে না। তারপরেও পৌঁছতে হবে ভাঙ্গা। সাড়ে আটটার দিকে ভাঙ্গা এসে পৌঁছাই। এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদক। এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা তিনিই করেছেন। তিনি আমাকে সওজ পরিদর্শন বাংলোতে নিয়ে গেলেন। আমার জন্য একটা রুম আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।
শরীরের উপর দিয়ে আজ সব ধরনের ধকল গেছে। তাই সময় নষ্ট না করে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। ভোরে আবার নতুন পথে হাঁটতে হবে। তবে ঘুমানোর আগে ভাঙ্গা সম্পর্কে পাঠকদের কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। ভাঙ্গা কুমার নদীর পাড়ে অবস্থিত। কথিত আছে- কুমার নদীর পাড়ে কুমারহাট নামে একটি বড় হাট বসতো। কোনো এক সময় হাটকে কেন্দ্র করে কুমার নদীর এপার ওপারের লোকজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে ওপারের লোকজন কুমারহাট ভেঙে ওপারের একটি হাট চালু করে। চালুকৃত হাটই ভাঙ্গার হাট নামে পরিচিত হয়। আর হাটকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলের নাম হয় ভাঙ্গা। জনশ্রুতি আছে- এই ভাঙ্গার ঘাড়ুয়া ইউনিয়নের উত্তর চানপট্টি গ্রামে সাতটি গায়েবি গাছ আছে। এই গাছগুলোর শরীর কাটলে নাকি এখনও রক্ত বের হয়। কতটা সত্য বা মিথ্যা, তা বলতে পারবো না। তবে আমার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। সময় নেই বলে আর দেখা হলো না। এছাড়াও ভাঙ্গায় দেখার মতো বেশকিছু স্থান আছে। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। নূরপুরে তারেক মাসুদের বাড়ি, পাতরাইল মসজিদ ও দীঘি, মজলিশ আব্দুল খানের মাজার, খাটরার বাসুদেব মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী নাট্যমঞ্চ উল্লেখযোগ্য।
এসইউ/এমএস