ঝরনার ঝিরিপথে পলিথিন হাতে
অবসরহীন ব্যস্ততা যতই যান্ত্রিক করে ফেলুক; মনটা তো আসলে পাখি। সেই পাখি সুযোগ বুঝে উড়াল দেবেই। আমাদের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। তবে বিশ্রামও নিতে হবে। ছুটি হলেও এদিক-সেদিক বেড়ানোতে পুরো সময়টা কাটানো এখন অনেকের কাছেই অসম্ভব! কারণ বাসায়ও সময় কাটাতে হয় আবার সামাজিকতাও রক্ষা করতে হয়। এই দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর মতো একটা ট্রিপের ব্যবস্থা করলেন আমাদের তুষার ভাই।
তুষার ভাই অনেক বছর ধরে চেনা-আধাচেনা-অচেনা স্বজন নিয়ে ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। এবারও একদল মানুষ হাজির মাত্র ২৪ ঘণ্টার একটি ট্রিপে; যেখানে চারটি ঝরনার পানিতে ঝাপাঝাপি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এর মাঝে চেনা মুখ বাপ্পা এবং শেষ মুহূর্তে হাজির হওয়া রত্না। আমি তো আছি-ই। আবারও অনেকদিন পর সামান্য কষ্ট করা হবে এ ধরনের ভ্রমণে যাওয়ার ব্যাপারে মনটা একটা দ্বিধায় থাকলেও তুষার ভাই অভয় দিলেন, ‘আরে তুমি পারবা।’ যেটা অবশ্য তিনি সবাইকে বলেন। কারণ টানা ভ্রমণ। কোনো থামাথামি নেই- কোনো রেস্ট হাউজ বা রিসোর্ট নেই। বাস থেকে নেমে ঝরনা- ঝরনা থেকে বাস। বাসে রাত এবং বাসেই কাৎ।
চট করে বসা, জলদি চলা- টাইপ এ ভ্রমণ শুরু করলাম রাত সাড়ে ১১টার বাসে। কলাবাগান থেকে রওনা দিয়ে সবাইকে তুলতে তুলতে এবং ঢাকা ছাড়তেই বেজে গেল রাত ১টা। তা-ও তুষারের মুখে হাসি। কারণ আমাদের গন্তব্য চট্টগ্রামের মীরসরাই। তাই খুব কম সময়েই পৌঁছে যাওয়া যাবে। ‘যেহেতু কোথাও বিশ্রাম নেয়ার অবকাশ নেই। অন্তত নাশতা খাওয়া যাবে তেমন সময় পৌঁছলেই ভালো।’ বলছিলেন তুষার। সাথে আছে চঞ্চল। এবারের উদ্দেশ্যটা শুধু যে ঝরনা দেখা- তা নয়। এবারের উদ্দেশ্য ছিল ট্রেইল সাফ করা। এর আগেও যেকোনো ভ্রমণ স্পটে দেখা গেছে, স্পট ভরা চিপসের প্যাকেট বা এমন সব আবর্জনা ফেলা, যা পরিবেশকে শুধু দূষিতই করে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেও একেবারে হাতে ধরে মেরে ফেলার মতো অবস্থা! যার জলজ্যান্ত উদাহরণ- হামহাম ঝরনা। এমনকি নাফাখুমের মতো দুর্গম ঝরনা দেখতে গিয়েই আমরা দেখেছি যে, সেখানে আছে ভরপুর ‘বিরিয়ানির প্যাকেট’। আশ্চর্য হলেও সত্য- যারা বিরিয়ানি খেয়েছেন; তারা ভরা প্যাকেট নিয়ে গেছেন কিন্তু খালি প্যাকেটটা বহন করে ফেরত আনেননি। তাই নাফাখুম দেখার আগেই আমাদের চোখে পড়েছিল খালি বিরিয়ানির প্যাকেটের স্তূপ।
আরও পড়ুন- নৌপথে ভ্রমণের সঙ্গী ময়ূরী
যা হোক- আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এবার এ ধরনের যত আবর্জনা পাব, সেগুলো আসা-যাওয়ার পথে তুলে এনে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলব। তাই ব্যাগে যা-ই থাকুক না কেন- দুটো করে বড় বড় পলিথিন নিতে কেউ ভোলেননি।
ফিরে আসি যাত্রায়। হিসাব অনুযায়ী, বাস ঠিকই উড়ে চলল মীরসরাইয়ের পথে। যাত্রাপথে নিয়মিত বিরতিতে চেনাজানা হলো বাকিদের সাথে। একেক পরিসর থেকে আসা বারো রকমের মানুষ। অথচ শত অমিলের মাঝে মিল একটাই। আমরা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। পথে-প্রান্তরে। চেনা-অচেনা গলিতে।
ঠিক ঠিক সূর্য উঁকি দেয়ার সাথে সাথে নামলাম বড়দরগার হাট বাস স্টপেজে। এবার সেই একই প্রশ্ন। একটু ফ্রেশ হওয়া বা নাশতা খাবারও অবস্থা নেই। পুরো এলাকা তখনও ঘুমিয়ে। হাঁটাহাঁটি আর ছবি তোলার ফাঁকে একটা দোকান খুলতেই পুরো দল হাজির। নাশতা শেষে তড়িঘড়ি করে ঝরনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পালা। কারণ গোটা দিনের পরিকল্পনা, একটু সুযোগ নেই সময় নষ্ট করার।
রাস্তা পার হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর এগিয়ে চট করে দলনেতা ঢুকে গেলেন ভেতরের গ্রামের দিকে। দলনেতা এখন থেকে পাভেল। স্থানীয়- ডানপিঠে এবং তুখোড় সাইক্লিস্ট।
চমকের ওপর চমক আমার জন্য উপস্থিত। জানলাম, খুব বেশি না- মাত্র ২৪ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে রূপসী ঝরনার। হাঁটা শুরু। প্রথমেই কিছুদূর আগানোর পর সামনে এলো ছোট্ট ঝিরিপথ। খুব বেশি হলে হাঁটুর উপরে পানি। সেই পানি আসলে ঝরনারই অংশ। ঝিরি ধরে সামনে এগোচ্ছি আর পাচ্ছি এর আগে আসা ভ্রমণকারীর খালি খাবারের প্যাকেট, যা ভীষণ দুঃখজনক। সেগুলো তুলতে তুলতে আগাচ্ছি। আর কানে আসছে ঝরনার অঝোর ধারার ধ্বনি। ঝিরি বলেই হয়তো ক্লান্তি ছিল না অতটা। আর রোদও ছিল সহনশীল। সব মিলিয়ে ২৪ মিনিটের পথ কেটে গেল আনন্দেই। এরপর প্রথম চমক। কোন রকমের ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই রূপসী ঝরনা ঠিক হাজির একেবারে সিনেমায় হঠাৎ করে আবির্ভাব হওয়া নায়কের মতো।
এরপর সেখানে চললো মিনিট ৪০ ঝাপাঝাপি। ততক্ষণে দুই পলিথিন ভরা আবর্জনা হাতে চঞ্চল এবং তুষার এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে ডাস্টবিনের খোঁজে। ডাস্টবিন না থাকায় এবার রওনা দিলাম আরেক ঝরনার দিকে। নাম ছাগলকান্ধা। এটা একটু উপরের দিকে। সামান্য চড়তে হবে পাহাড়ের মতো উঁচু অংশ। খুব বেশি উঁচু নয়। বেশ রোমাঞ্চকর অবস্থায় চার হাত-পা কাজে লাগিয়ে চড়তে হলো শুরুর অংশটা। ফের শুরু নতুন ঝিরিপথ। এই পথ ছবির থেকেও সুন্দর। আরও সুন্দর প্রকৃতির নিজস্ব আলাপ। এই পাখি ডাকছে- ওই কলকল ধ্বনি। মাঝে পানিতে ছোপ ছোপ আওয়াজ তুলে হেঁটে যাওয়া একদল ঝরনাপ্রেমিক। কখনো সিঁড়ির মতো পানি পড়ছে কয়েকটি ধাপে। কখনো আবার একটু ফাঁকে তৈরি করছে মৃদু ঘূর্ণিপাক। ঘণ্টাক্ষাণেকের হাঁটা শেষে এবার দেখা মিললে আমার দেখা সেরা ঝরনার। নাম ছাগলকান্ধা। কিন্তু সেই ঝরনার পানিতেই যেন সব আবেগ ‘বান্ধা’। এবার আর কোনো কথা নেই। ঝটপট ফটোসেশন সেরে ঝুপঝাপ পানিতে।
আরও পড়ুন- ঢাকার কাছেই মোহাম্মদী গার্ডেন
সবমিলিয়ে গলা সমান পানি। তার নিচে আবার পাথরের সারি। ইচ্ছামতো ডুবাতে লাগালে কেউ। কেউ ক্লান্তি ধুয়ে নিল ঝরনার ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে। এরপর পানির নিচে জেগে থাকা পাথরে বসে কাটলে আরও কিছুটা সময়। ঘড়ি তাড়া দিলেও মনটা একেবারেই সায় দিচ্ছিল না। তবে দলনেতার তাড়ায় এবার উঠতেই হলো।
একই ঝিরিপথ ধরে ফিরে চলা। এবার আর পা পিছলে যাওয়ার ভয় নেই। সবুজ সীমানা এবং জলের মেলবন্ধনে রাস্তাটা তখন হয়ে উঠেছে আরও অনেক আপন।
একই সময় ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাজির বড় সড়কের পাশে। কে বলবে এই রাস্তা ছেড়ে একটু এগোলেই প্রকৃতি আমন্ত্রণ জানায় নির্মল অবগাহনে। আর মাথা উঁচু করে আছে দুটি অপরূপ ঝরনা! আমরা মানুষ, তারা কী প্রকৃতিকে আগলে রাখছি! না কি নষ্ট করছি প্রতিনিয়ত নিজের একটু খামখেয়ালিতে?
এরপর সীতাকুণ্ড হয়ে রাতের বাসেই ফিরে চললাম ঢাকায়! মাত্র ২৪ ঘণ্টায় মিটলে মনের ক্ষুধা। ফের যাত্রা শুরু নিয়মিত জীবনের পথে।
যা যা নিতে হবে
এমন ভ্রমণে গেলে প্রয়োজনীয় পোশাক, ক্যাপ, পানির বোতল, স্যালাইন, আনুষঙ্গিক এবং অবশ্যই গ্রিপওয়ালা জুতা।
যা প্রয়োজন
ঘোরার মতো মন, হাঁটার মতো মানসিকতা আর উপভোগ করার মতো হৃদয় হলেই যেতে পারেন ঝরনার সান্নিধ্যে।
যা করবেন না
ঝরনায় ভ্রমণে গেলে অযাচিত ময়লা ফেলা একদমই উচিত নয়। যদি কেউ ময়লা ফেলে যায়, তা তুলে আনাও আমাদের কর্তব্য।
এসইউ/পিআর