পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : তৃতীয় পর্ব
অনুষ্ঠান শেষে অনুপ ঘোষ ও ইচ্ছে হ’লোর সদস্যরা আমাকে হোটেল পলাশে নিয়ে গেলেন। এখানেই আজ আমার রাত্রিবাস। সবাই আমাকে শুভকামনা জানিয়ে চলে গেলেন। আমার থাকা ও খাবার ব্যবস্থা তারাই করেছেন। কমলেশ সেনগুপ্ত ও কলকাতা থেকে যারা এসেছিলেন; তারাও চলে গেলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর গোসল করে এসে হোটেলের রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষে রুমে এসে কলম আর ডায়েরি নিয়ে বসলাম। সারাদিনের অভিজ্ঞতা লিখে ফেললাম। ক্যামেরার ছবিগুলো একটি একটি করে দেখলাম। শরীর এতো ব্যথা হয়েছে বসলে উঠতে কষ্ট হয়, আবার বসতেও কষ্ট হয়। দু’পায়ে বেশ কয়েকটি ফোসকাও পড়েছে। সারা শরীরে ব্যথানাশক লাগিয়ে কম্বলের উষ্ণতায় ঢুকে পড়লাম। সেলিম ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলে সারা দিনের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
১১ ফেব্রুয়ারি। আজকের সকালটা সুখের না। শরীর একদম জমে আছে। সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। খুব কষ্ট করেই সকালে কর্ম শেষ করে প্রস্তুতি নিলাম। কমলেশ সেনগুপ্ত ফোন করে আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন। তিনি জানালেন আজ বেশকয়েকটি পত্রিকায় খবর ছেপেছে। আমি বারাসাত বাসস্ট্যান্ড থেকে যেসব পত্রিকায় খবর ছেপেছে সেগুলো সংগ্রহ করলাম। আনন্দবাজারের এবেলা, নিউজ বাংলা, দ্য স্টেটম্যানসহ আরো কয়েকটি পত্রিকায় খবর প্রকাশ করেছে এবং এএনআই টেলিভিশন আমার একটি সাক্ষাৎকারও প্রচার করে।
> আরও পড়ুন- সাইকেলে চড়ে চন্দনের হিমালয় জয়
আজ অনুপ ঘোষ আমার সাথে হাবড়া পর্যন্ত যাবেন। সকাল আটটায় অনুপ ঘোষ ও ইচ্ছে হ’লোর কয়েকজন সদস্য এলেন। সবাই মিলে সকালের নাস্তা করলাম। নয়টার সময় আমরা হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার পাশের একটা চশমার দোকান থেকে অনুপ ঘোষ আমাকে একটা সানগ্লাস কিনে দিলেন। পুলিশের গাড়ি ও সংগঠনের গাড়ি চলে এলো। প্রথম দিন যারা আমার সাথে কলকাতা থেকে এসেছিলো। তারা কিছু সময় হেঁটে কিছু সময় গাড়িতে এভাবে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। আজও প্রথমে সবাই আমার সাথে হাঁটছে। শুরুতে হাঁটতে কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে মানিয়ে নিচ্ছে শরীর।
দত্তপুকুর বাজারে আমরা বিশ্রাম নিতে থামলাম। আমাদের দেখে বাজারের প্রায় সব মানুষ আমাদের ঘেরাও করে ফেললো। সবাই এসেছে কৌতুহল নিয়ে। একটি চায়ের দোকানে বসেছি। ভিড় ঠেলে কেউ একজন একটি পত্রিকা হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার সাথে পত্রিকায় ছাপা ছবি মিলিয়ে তিনি বললেন, ‘একদম মিলে গেছে’। মনে হলো তিনি শব্দজট খেলায় জয়ী হলেন। এমন আনন্দ পেলেন। তিনি বললেন, ‘দাদা সকালে যখন এই খবরটি পড়ছিলাম; তখন মনে হলো তোমাকে যদি একবার দেখতে পারতাম। এখন তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। ভগবান আমার মনের আশা পূরণ করেছেন। এখানে যত টাকা বিল হয় সব আমি দেব।’ কথাগুলো বলে উঠে চলে গেলেন। কিছু বলে গেলেন না। আমি মনে মনে ভাবলাম আজব মানুষ তো! এইমাত্র বললেন সব বিল তিনি দেবেন আর এখন না বলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। কয়েক মিনিট পর তিনি আবার এলেন। একহাতে কাটা ডাব আর একহাতে একটা মিষ্টি। দাদা রোদের মধ্যে হাঁটছো, এই ডাবের পানি খেয়ে নাও ভালো লাগবে। আর এই মিষ্টি পুরোটা খাবে। দত্তপুকুরের সেরা মিষ্টি। আমাদের চায়ের দোকানের বিলটা তিনিই দিয়েছেন।
যশোর রোড ধরে হাঁটছি। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছ কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কত রকমের স্মৃতি তাদের জীবনে। যদি মানুষের মতো কথা বলতে পারতো! হয়তো তাদেরও কথা বলার ভাষা আছে। তারাও বলে সুখ-দুঃখ, অভিযোগের কথা। শুধু আমরা সে কথা শুনতে পাই না। বুঝতে চাই না। দিনের পর দিন কালো পিচঢালা পথিক চলা রাস্তা ছাঁয়া দিয়ে ঢেকে রাখছে। ক্লান্ত পথিককে বিশ্রাম দিচ্ছে। আমি আজ এই পথ ধরে হাঁটছি। আমার পায়ের চিহ্ন থেকে যাবে এই পথের বুকে। কত রকমের পায়ের ছাপ এই পথ পুষে রাখছে। কত পায়ের ছাপ পড়বে এই পথে- কেউ বলতে পারবে না।
জয়পুল-বিরা লিঙ্ক রোড থেকে কিছুটা সামনেই কেদারনাথ আদর্শ বিদ্যাপীঠ। এই বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আমার সাথে থাকা একজনের পরিচিত। সেই কারণে তিনি আগেই খবর পেয়ে যান আমাদের আসার কথা। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান এবং আমাদের স্বাগত জানান। আমাদের বিদ্যাপীঠের ভেতরে নিয়ে যান। শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ছাত্রছাত্রীদের খেলার মাঠে ডেকে আনেন। ছাত্রছাত্রীদের সামনে কিছু বলার সুয়োগ করে দিলেন। আমার কথা শুনে এবং আমাকে দেখে তারাও খুব উৎসাহিত হলো।
আবার হাঁটা শুরু। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার মজার একজন। তার একা একা গাড়িতে ভালো লাগতো না বলে তিনি গাড়ি নিয়ে আমাদের সামনে চলে যেতেন। সামনে গাড়ি রেখে আমাদের কাছে চলে আসতেন। তারপর আমাদের সাথে হাঁটতেন। আবার গাড়ি সামনে রেখে এসে আবার হাঁটতেন। এভাবে প্রায় সারা রাস্তায় তিনিও আমাদের সাথে হেঁটেছেন। রাস্তার পাশে একটি হোটেলে আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাত্রা বিরতি করলাম। আমরা হোটেলের ভেতরে না বসে বাহিরে বসেছি। খাবার চলে এলো।
> আরও পড়ুন- পাহাড়-ঝরনাকে বাঁচতে দিন!
খাবার শেষে আবার আমাদের পদযাত্রা শুরু করলাম। হাঁটা থামিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যখন হাঁটা শুরু করি তখন বুঝতে পারি যে শরীরের কোথায় কোথায় কি পরিমাণ ব্যথা। আর পায়ের কথা কি বলবো, ফোসকা পড়ছে আবার সাথে সাথে সেগুলো ফেটে যাচ্ছে। যার ফলে সেগুলোর যন্ত্রণায় ভালোভাবে হাঁটতেও পারছি না। সাথে ইচ্ছে হ’লোর গাড়ি আছে, পুলিশের গাড়ি আছে। আমার সাথের মানুষগুলো কিছু সময় গাড়িতে, কিছু সময় হেঁটে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। কখনো আমাকে একা রাখছে না। সাথে গাড়ি থাকা সত্ত্বেও আমার কাঁধে প্রায় পনেরো ষোল কেজি ওজনের রুকস্যাক। এর ভেতরেই আমার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এই রুকস্যাকটি কখনো গাড়িতে দেইনি। প্রথমে বেশ কষ্ট হয়েছে। পরে তা শরীরের সাথে মানিয়ে গেছে।
বানীপুর হাবড়া থানার একটি ইউনিয়ন। যশোর রোডে ছোট একটি বাজার। এখানে একটি চায়ের দোকান আছে। নাম ‘দেবদাস চায়ের দোকান’। মনে পড়ে গেল- শরৎচন্দ্রের দেবদাসকে। ‘দেবদাসের আপাত-বৈরাগ্য দেখিয়া এবং কথাবার্তা শুনিয়া তাহার (পার্বতীর) চোখে জল আসিতেছিলো, কহিল, দেবদা, আমিও যাবো। কোথায়? আমার সঙ্গে? দূর তা কি হয়?’ নিজের ভেতরে আর হাসিটা আটকে রাখতে পারলাম না। তবে হাসিটা নিজের মধ্যেই রাখলাম। হাসির কারণ হলো, আমিও আজ বৈরাগ্য নিয়েই পথে নেমেছি। দোকানদার আমাদের চা দিলেন। চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, পার্বতী আছে তো?’ পান খাওয়া লাল মুখে মুচকি হাসি দিয়ে আর একটা পান মুখে গুঁজলেন।
এখানেই পরিচয় হলো প্রশান্ত দত্তের সাথে। তিনি জুট কর্পোরেশন আব ইন্ডিয়ার একজন কর্মচারী। তিনি আমাদের তার অফিসে নিয়ে গেলেন। তার সহকর্মীদের সাথে পরিচয় করালেন। তারা আমাকে দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত। একজনকে পাঠালেন আমাদের জন্য গরম গরম জিলেপি আনতে। সেখান থেকে গরম জিলেপি খেয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম।
সন্ধ্যার একটু আগেই আমরা হাবড়া এসে পৌঁছলাম। হাবড়ার থানায় ডিউটি অফিসারের কাছে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমার সাথে আসা পুলিশ চলে গেল। থানা থেকে বের হয়ে দেখি সাংবাদিকরা ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সাথে কথাবার্তা শেষ করে ইটিভির সাংবাদিক উৎপল রায়ের বাড়ি চলে গেলাম। থানার পাশেই তার বাড়ি। উৎপল রায় অনুপ ঘোষের পরিচিত। দোতলা বাড়ি। বাড়ির বাইরে ছোট্ট বাগান আছে খুব সুন্দর। বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমার থাকার ব্যবস্থা আজ এখানেই। আমাকে উপরের রুমটা থাকতে দিয়েছে। সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম রুমে।
উৎপল রায় বাহির থেকে ঘুরে এসে জানালেন, বাইরে সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছেন। তাদের সাথে কথা বলতে হবে। দু’টি পত্রিকা ও একটি টিভির সাংবাদিক রুমের ভেতরে ঢুকলেন। এরা সবাই হাবড়ার প্রতিনিধি। আনন্দবাজার প্রত্রিকার সাংবাদিক তার ফোনে চিফ-রিপোর্টারের সাথে ধরিয়ে দিলেন। তার সাথে প্রায় চল্লিশ মিনিট কথা হলো। তার জন্মভিটা বাংলাদেশে। কথা শেষে টিভি সাংবাদিক বললেন, তাদের নিউজের জন্য একটু ভিডিও ফুটেজ লাগবে। তাই আবার তাদের গাড়িতে করে রাস্তায় আসতে হলো শুটিংয়ের জন্য।
> আরও পড়ুন- অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয়
বাসায় এসে রুকস্যাক রেখে উৎপল রায়ের সাথে মোটরসাইকেলে করে তার শ্বশুর বাড়ি এলাম। এখানে তার বউ- তাই তার সাথে দেখা করতে আর রাতের খাবার খেতে এসেছি। তাদের দু’টি সন্তান। বড় ছেলেটির নাম উৎসুক রায়। বয়স ৮ বছর। আর ছোটটির বয়স ৪ মাস। খাবার শেষে আবার তার বাসায় চলে এলাম। সাথে উৎসুকও এলো। সে খুবই কৌতুহলী। রাতে আমার সাথে অনেক গল্প করেছে। তারমধ্যে এতো প্রশ্ন, আমাকে জানার জন্য। আমি শুধু তাকে উত্তর করে যাচ্ছি। একসময় তার বাবা এসে তাকে নিয়ে গেলো।
আজ পায়ে আরো ফোসকা পড়েছে। পা ব্যথায় টনটন করছে। আজ একটু বেশিই চাপ গেছে। কমলেশ সেনগুপ্তর সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন, সকালে তিনি আসবেন এবং বেনাপোল পর্যন্ত যাবেন। তবে তার আসতে একটু দেরি হবে। উত্তম ঘোষ নামের কেউ একজন ভোর থেকে আমাকে সঙ্গ দেবেন। তার ফোন নম্বরটাও দিলেন। আমি রাতেই উত্তম ঘোষের সঙ্গে কথা বললাম। সেলিম ভাইয়ের সাথেও কথা বললাম। শরীরে মুভ লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল অনেক বেশি পথ হাঁটতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
এসইউ/আরআইপি