ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : প্রথম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল | প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। বিজয় নগর বধির হাইস্কুলের শ্রেণিকক্ষ। পদাতিকের নাট্যকর্মীরা ব্যস্ত। সব ব্যস্ততা আমাকে ঘিরে। রাত সাড়ে ১০টায় কলকাতার উদ্দেশ্যে কমলাপুর থেকে বাসে উঠবো। রাত ৯টা। পদাতিকের দলনেতা সেলিম শামসুল হুদা চৌধুরী চলে এসেছেন। তিনিই আমার হাতে জাতীয় পতাকা, ব্যানার এবং টি-শার্ট তুলে দেন। সবাই মিলে ছবি তুলে আমাকে বিদায় জানালেন। কামাল ভাই, মিল্টন, আজিজ ও আরো কয়েকজন আমাকে বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত সঙ্গ দিলেন। সময়মতোই বাস যাত্রা শুরু করেছে।

অন্য যাত্রীরা আমাকে কৌতূহল ভরে দেখছে। দেখবেই না কেন? ছোটখাটো একজন মানুষকে এতোগুলো মানুষ বাসে উঠিয়ে দিচ্ছে। বাসের ভেতরে গ্রুপ ছবি তুলছে। শুভকামনা জানাচ্ছে। হলুদ রঙের টি-শার্ট পরা। রুকস্যাক তুলনামূলক বড়। মহাত্মা গান্ধীর মতো হাতে লাঠি। যা হোক, ঢাকা শহরের চিরচেনা জ্যাম ঠেলে এগিয়ে চলছে ছ’চাকার যান।

ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় দেখা যাচ্ছে ফুটপাতে বেওয়ারিশ কুকুরে পাশে আশ্রয়হীন ঘুমন্ত মানুষগুলো। যাদের কাছে ফেব্রুয়ারির শীতও হার মেনেছে সাহেবদের ইট-পাথরের শহরে। গাবতলী হয়ে ঢাকা থেকে বেরিয়ে গাড়ি আপন গতিতে ছুটে চলল। কখনো দ্রুত গতিতে কখনো ধীর গতিতে। যাত্রীরা কেউ ঘুমোচ্ছে কেউ ঘুমে ঝিমাচ্ছে। আমার কিন্তু কোনটাই হলো না। নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কি চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তা এখন না বলি। আস্তে আস্তে আপনাআপনিই আবিষ্কার করতে পারবেন।

shakil1

৮ ফেব্রুয়ারি। রাত পৌনে ২টা। আরিচা ফেরিঘাটে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি কাঙ্ক্ষিত ফেরির অপেক্ষায়। পরিচয় হলো ২৪-২৫ বছর বয়সী সুমন নামের এক ছেলের সাথে। আমার পাশেই বসেছে। বাসা ঢাকাতেই। যাচ্ছে সল্টলেক আত্মীয়ের বাসায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে। প্রথমে আমাকে ভেবেছিল খেলোয়াড়। কোন টুর্নামেন্ট খেলতেই হয়তো যাচ্ছি। আমার কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্য শুনে সে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলো আমার প্রতি।

অপেক্ষার পালা শেষ করে বাস ফেরিতে উঠলো। আমি আর সুমন বাস থেকে নেমে ফেরির ছাদে গেলাম। আমাদের মতো অনেকেই ছাদে এসেছেন। নদীতে ভেসে চলছি আমরা। শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। কুয়াশায় দূরের তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। অপ্রকাশিত ভালো লাগা শিহরতি করছে মন। আমরা দু’জন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। মাঝে মাঝেই হকাররা এসে আমাদের গল্প থামিয়ে দিচ্ছে। জল থেকে স্থলে এসে বাস আবার ছুটে চলল।

বাস থেকে একটি কলা, দু’টুকরো রুটি, একটি মিষ্টি, একটি সেদ্ধ ডিম ও এক বোতল পানি দেওয়া হয়েছিল। তা দিয়ে পেট পূজো করে নিলাম। বাস থেকে দেওয়া কম্বল মুড়িয়ে সবাই ঘুমিয়ে বাসের সাথে সাথে দুলছে। কিন্তু আমার চোখে ঘুমের শূন্যতা। চোখে শুধুই স্বপ্নের কৌতূহলী উছ্বাস। গাড়ির হর্ন, অন্ধকারে বৃক্ষরাজির উল্টোপথে ছুটে চলা, জনশূন্য গ্রাম, বাজার পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছি। দেখতে দেখতে অন্ধকার থেকে পৃথিবীকে আলোকিত করে সূর্য স্বাগত জানাল পুবাকাশে।

shakil2

যশোরে শুরু হয়েছে জামাত-শিবিরের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। রাস্তায় চলছে পুলিশের টহল। এর মাঝে আবার সড়ক দুর্ঘটনা। গাড়ি চলাচল বন্ধ। দীর্ঘ যানজট। বাসের আর কেউ জানতে বাকি রইল না- আমার কলকাতা যাত্রার উদ্দেশ্য। কাজটি অবশ্য সুমনই করেছে। এখন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলাম। একেক জনের একেক রকম মন্তব্য। কেউ বাহাবা দিচ্ছে, কেউ নিছক পাগলামী বলছে, কেউ ভয়ও দেখাচ্ছে। এতোটা পথ একা হাঁটা কিভাবে সম্ভব? তাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন খেলা করছে। তবে সবাই আমাকে অন্যরকম মূল্যায়ন করছে। যা আমাকে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

দুপুর ১২টায় আমরা বেনাপোল পৌঁছলাম। সেখানেও সুমন আমার মার্কেটিং করেই চলছে। যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই। একটি টি স্টলে দু’জন চা-রুটি খেলাম। দোকানদার চা-রুটির দাম রাখলেন না। কারণ এখানেও সুমনের মার্কেটিং।

ইমিগ্রেশন শেষে ভারতের সীমানায় বাসের চাকা ঘুরছে। বিকেল ৫টায় কলকাতা নিউমার্কেট। বাস থেকে নেমে দেখি কৃষ্ণ দা দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিলো। তাই চিনতে কষ্ট হয়নি। সাধারণ কথাবার্তা শেষে ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। আগে কৃষ্ণ দাকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই- তিনি খুবই মজার মানুষ। তার সাথে আমার পরিচয় ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। তখন আমরা পদাতিকের ত্রিশতম প্রযোজনা ‘সে’ নাটকটি কলকাতার ঐতিহাসিক মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ করি। যার আয়োজনে ছিলো ‘মিতালী ইন্দো-বাংলা’। সে সময় কৃষ্ণ দা আমাদের গাইড করেছিলেন। আজও কৃষ্ণ দা, মিতালী ইন্দো-বাংলা।

shakil3

ডা. শিশিরের গেস্ট হাউজে আমাকে রেখে কৃষ্ণ দা চলে গেলেন। যাওয়ার আগে হাউজের কর্মচারী আলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সে বাংলাদেশি। বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে তার বাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে সে এখানে কাজ করছে। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় চেঞ্জ করলাম। রাত ৯ টায় কমলেশ সেনগুপ্ত ও অনুপ ঘোষ আসলেন। আমার জন্য মিষ্টি ও লাড়ু এনেছেন। কমলেশ সেনগুপ্ত অনুপ ঘোষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কমলেশ সেনগুপ্তের শেকড় বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে। তিনি ‘মিতালী ইন্দো-বাংলা কালচারাল সোসাইটি’র জয়েন সেক্রেটারি। তিনি আমার এ প্রোগ্রামের কলকাতার আয়োজক। আর অনুপ ঘোষের বাসা বারাসাত। তিনি একজন নাট্যকার ও সাহিত্যিক। তিনি আমার এ প্রোগ্রামের বারাসাতের আয়োজক।

তাদের সাথে আমার বেশকিছু সময় কথাবার্তা হলো। তারপর তারা চলে গেলেন। আমি যে রুমটিতে ছিলাম তা অনেকটা গোছানো ছিলো। মনে হলো এখানে কোন এক দম্পত্তি থাকে। দেয়ালে টানানো নানা রঙের পেইন্টিং। ফুলদানি, টেলিভিশন, টেলিফোন, সোফা, শো-কেসে সাজানো নানা ধরনের ক্রিস্টাল, ডা. শিশিরের বিভিন্ন সম্মাননা ইত্যাদি। এসব দেখতে দেখতে একসময় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

shakil4

৯ ফেব্রুয়ারি। সকাল ৬টা। ঘুম থেকে জেগে বাইরে গিয়ে দেখি ডেকোরেশনের লোকজন বাড়ি সাজাচ্ছে। প্রধান গেট থেকে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত লালগালিচা, রঙিন বাতি, প্যান্ডেল করে সাজানো হচ্ছে। কিছু বুঝতে পারলাম না। প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলাম। দেখলাম সকালের কলকাতা। সবাই ছুটে চলছে নিজ নিজ কর্মস্থলে। হাঁটাহাঁটি শেষ করে ফিরে এলাম।

বাড়িতে লোকজনের সংখ্যাও আস্তে আস্তে বেড়েই চলছে। পরে আলীর কাছে জানতে পারলাম সন্ধ্যায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠান আছে। কমলেশ সেনগুপ্তের সাথে ফোনে কথা হলো। তিনি জানালেন, সকাল ৯টার সময় কৃষ্ণ দা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। অবশ্য কমলেশ সেনগুপ্ত রাতেই আজকের কর্মসূচি জানিয়েছিলেন। গোসল করে আলীর দেওয়া সকালের নাস্তা সেরে রেডি হয়ে কৃষ্ণ দার জন্য অপেক্ষা করছি। ৯টার আগেই দাঁত বের করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে কৃষ্ণ দা এসে হাজির। তার সাথে টি কে সেনগুপ্তের বাসায় যাব। টি কে সেনগুপ্ত মিতালী ইন্দো-বাংলা’র প্রেসিডেন্ট।

বাস থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কৃষ্ণ দা সামনে আর আমি পেছনে। রাস্তার দু’পাশের সবুজ বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ কালো পিচ ঢালা পথে শিল্পকর্ম করছে। যেহেতু ফেব্রুয়ারির শীত; সেহেতু সকালের রোদটা একটু বেশিই মিষ্টি। কিছুদূর হাঁটার পর সরু একটি গলি পথে ঢুকে গেলাম। গলিটি এতোই সরু যে দু’জন একসাথে পাশাপাশি হাঁটা যায় না। দু’পাশের ইট-সিমেন্টের বাড়িগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পুরনো। তারা নিজেরাই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তারা বার্ধক্যের ভারে রূপ হারিয়েছে। দেয়ালে শ্যাওলা আর অসংখ্য স্মৃতিময় ছাপচিত্র।

shakil5

ছোট একটি গেট দিয়ে ঢুকেই অন্ধকার সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। কৃষ্ণ দা কলিং বেল চাপলেন। দরজা খুললেন কমলেশ সেনগুপ্ত। ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরের একটি ছোট রুমে বসতে দিলেন। রুমটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি একটি অফিস রুম। প্রথমে ভেবে ছিলাম এটি কমলেশ সেনগুপ্তের বাড়ি। এটি যে টি কে সেনগুপ্তের বাড়ি তা জানতে দেরি হলো না।

ছোট রুম। বেশ গোছানো। দেয়ালে টানানো বিভিন্ন ছবি, সনদপত্র। বড় করে বাঁধানো একটি ফ্রেমে টি কে সেনগুপ্ত একটি বাঘের বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। টি কে সেনগুপ্ত এসে তার চেয়ারে বসলেন। সামনের দু’টি চেয়ারে আমি ও কমলেশ সেনগুপ্ত এবং কৃষ্ণ দা আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে। কথাবার্তার শেষে মিষ্টিমুখ করে কমলেশ, কৃষ্ণ দা এবং আমি একটি লোকাল বাসে চেপে চলে এলাম কলকাতা প্রেস ক্লাবে। ১০ তারিখ সকালে একটি প্রেস কনফারেন্সের জন্য হল ভাড়া করার উদ্দেশ্যে। হল খালি পেলাম না। কমলেশ সেনগুপ্ত আমাকে ও কৃষ্ণ দাকে কিছু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মিলন মেলায়।

একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ট্যাক্সি করে মিলন মেলায় যাচ্ছি। ট্যাক্সির ভেতর থেকে বেশ কিছু ছবি তুললাম ক্যামেরায়। মিলন মেলার বিশাল রঙিন গেট। গেটে বড় বড় করে লেখা ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা-২০১৩’। হাজারো মানুষের ভিড়। দলবেঁধে মেলায় ঢুকছে। ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলবো বলে। ছবি তুলতে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। হায়! একি? ক্যামারায় ছবি উঠছে না। কিছুক্ষণ আগেই ছবি তুললাম আর এখন ক্যামেরা নষ্ট? মনটা মুহূর্তের মধ্যেই খারাপ হয়ে গেল। চিন্তায় পড়ে গেলাম।

কাল সকাল থেকেই আমার ক্যামেরা লাগবে। সাথে তেমন টাকাও নেই যে, একটা ক্যামেরা কিনবো। প্রথমেই মেলার প্রেস কর্নারে গিয়ে সংবাদকর্মীদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিলাম। সেমিনার কক্ষে সমাপনী অনুষ্ঠান হচ্ছে। যেহেতু মেলাটি হচ্ছে বাংলাদেশ থিমে সেহেতু সমাপনী অনুষ্ঠানটিও বাংলাদেশ নিয়েই হচ্ছে। ডেপুটি হাই-কমিশনারকে আমার প্রেস কনফারেন্সে আমন্ত্রণ করবো বলে অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন