পাহাড়-ঝরনাকে বাঁচতে দিন!
হঠাৎ করেই মাঝ রাতে আখতার ভাই ফোন দিয়ে বললেন, ‘শাকিল, চলো ঝরনা দেখে আসি।’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে বলেলাম, ‘চলেন যাই।’ তখনই সঙ্গে সঙ্গে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া যাওয়ার কথা বললাম। আখতার ভাইও রাজি হয়ে গেলেন। তারপর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন শামিম ভাই, খাদিজা ভাবি, রুপক ভাই, রত্না আপু এবং দিবা আপু। ৪ তারিখ টিকিট কেটে রাতের বাসে ভোর ৪টায় মিরসরাই পৌঁছলাম। তারপর একটি দোকানে বসে চা পান করে আড্ডা দিয়ে দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করলাম।
সকাল ৭টা। নাস্তা খেয়ে প্রথমে আমরা নয়দুয়ার হয়ে নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে ট্রেকিং শুরু করি। মিরসরাই থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় আমাদের গাইড মামুন। গ্রামের ভেতর দিয়ে শিম, পুঁইশাক, ধানের জমি, ছোট-বড় গাছ পেছনে ফেলে আঁকাবাঁকা পথ ছেড়ে ঝিরিপথে নেমে এলাম। রোদ-মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। বৃষ্টি আসবে আসবে বলে আসছে না। তাই হাঁটতে আমাদের তেমন কষ্টও হচ্ছে না।
পাথর, আলো-ছায়া, শামুক ভেজা ঝরনার শীতল জল ঝরা বুনো ফুল ভাসিয়ে নেমে আসছে কলকল ছলছল শব্দে। ঝিরিপথে নেমেই আমরা পা ভিজিয়ে নিলাম। পানি পাথর আর শেওলাময় পথে আমরা সবুজ আর পাহাড়ের গভীরে ঢুকে যাচ্ছি। পাখির কিচিরমিচির বরণ করে নিলো একদল ইট-পাথরের যান্ত্রিক শহুরের প্রাণকে। আমরা ৭ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজন এই প্রথম কোন পাহাড়ি পথে এসেছে। পাহাড়ের কাছে এসেছে। ঝরনার কাছে এসেছে। কখনো ঝিরিপথে কখনো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলছি আমরা।
যতই সামনে এগোই, ততই সৌন্দর্য বাড়ছিল। পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে যখন সামনে হঠাৎ নাপিকাটাকুম জলপ্রপাতটা পেয়ে গেলাম, মনে হচ্ছিল- এ আমি কোথায় এলাম? এটা কি সত্যি বাংলাদেশ? নাপিকাটাকুম জলপ্রপাতের ঠান্ডা পানিতে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করে আবার রওনা দিলাম ওপরের দিকে। আরও ঝরনা দেখা তখনো বাকি।
নাপিকাটাকুমের ওপরে রয়েছে আরেকটি জলপ্রপাত, যার নাম ছোট নাপিকাটাকুম। সেখান থেকে কলকল ছলছল করে পানি আসছে, উপচে পড়ছে বড় নাপিকাটাকুমে। সৌন্দর্য পেছনে রেখে কর্দমাক্ত পাহাড়ি পথে আবারও চলতে শুরু করলাম আমরা। আমরা হেঁটে যাচ্ছি ঝিরিপথ দিয়ে। পানির প্রবাহ আর গতি এখানে আরও বেশি। যতই সামনে এগোচ্ছি- মনে হচ্ছে, সৌন্দর্যের একেকটা আধার উন্মোচিত হচ্ছে। জানি না সামনে কী আছে? আর সামনে আরও খানিকটা এগিয়ে বিশাল এক ঝরনা বাঘবিয়ানির পায়ের কাছে। এমন সবুজ পাহাড় এত রহস্য লুকিয়ে রাখার বিদ্যা কোথায় শিখেছে কে জানে? সমস্ত বন্য আদিমতা নিয়ে বাঘবিয়ানির ঝরনাধারা সশব্দে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। সেই পানিতে কেউ ধ্যানমগ্ন হয়ে, কেউ শুয়ে, কেউ বসে, যে যেভাবে পারে নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলতে লাগল। বান্দরকুম ঝরনা দেখা এখনো বাকি রয়েছে। একটা সময় পৌঁছেও গেলাম সেটির কাছে। বিশাল বান্দরকুম ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নিজেকে সঁপে দেওয়া আর রহস্যময় পাহাড়ের সৌন্দর্যের কাছে আরেকবার বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে আমাদের।
মিরসরাইয়ে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন ঝিরি, ছড়া ও ঝরনা। যা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। বাংলাদেশের এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত বহু ধাপবিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনাটি এ এলাকাতেই অবস্থিত। ঝর্ণাটিই এলাকার মূল আকর্ষণ। খৈয়াছড়ার পথে এখন বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল হয়েছে। এরমধ্যে পুরনো হলো ঝরনা হোটেল। আগে এখানেই খেয়েছি। এবারো এখানেই খেতে বসেছি। হোটেলটি আগের থেকে অনেক পরিপাটি হয়েছে। এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে আবার খৈয়াছড়ার পথে হাঁটা শুরু করলাম। পথে দেখা হচ্ছে অনেক ট্রেকারের সঙ্গে। তারা নেমে আসছে। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। অনেক পিচ্ছিল আর কাদা। এর মধ্যেই কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছি। আমরা সবাই যেহেতু তরুণ, তাই খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
কাদাপথ, ঝিরিপথ হেঁটে আমরা এসে পৌঁছলাম খৈয়াছড়ায়। এখানে এসে ঝরনার শীতলতা ও পানির শব্দ আমাদের মনটাকে ভরে দিলো। আমাদের দলে প্রায় সবারই পাহাড়ে এবারই প্রথম, তাই তারা কিছুটা ক্লান্তও হয়ে গেছে। তাদের রেখে আমি আর রুপক ভাই উপরের ধাপগুলো দেখতে উঠে গেলাম।
যেভাবে যাবেন
যারা ঢাকা থেকে আসবেন, তারা পথিমধ্যে মিরসরাই নেমে গেলে ভালো। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যেসব বাস ছাড়ে সেই বাসেই আসা যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৪৮০ টাকা (নন এসি) বাসে। মিরসরাই নেমে সকালের নাস্তা করে সিএনজি দিয়ে নদুয়ারহাটে চলে আসবেন। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। ভ্রমণের সুবিধার জন্য সঙ্গে গাইড নেওয়া ভালো। গাইডের জন্য মৌসুমভেদে ৩০০-৫০০ টাকা লাগতে পারে।
খাওয়া-দাওয়া
নদুয়ার হাটে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এজন্য মিরসরাই আসতে হবে। একদিনের মধ্যেই ঘুরে আসা যায়, তাই থাকার দরকার পরে না। থাকার জন্য সীতাকুণ্ডে নিম্নমানের হোটেল পাওয়া যায়। ভালো হোটেলের জন্য শহরের দিকে আসতে হবে।
সঙ্গে যা নিবেন
যেহেতু পাহাড়ি রাস্তা, সেহেতু ভালো গ্রিপওয়ালা বেল্টের স্যান্ডেল উত্তম। কারণ ঝিরিপথে হাঁটবেন তাই কাদা, পানি দিয়ে হাঁটতে হবে। কাঁটাছেড়া হতে পারে, তাই কিছু ব্যান্ডেজ আর এন্টিসেপটিক নিতে পারেন। যেহেতু ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা, তাই যাওয়ার আগে স্থানীয় চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা উচিত। আর সঙ্গে কিছু হালকা শুকনো নাস্তা আর খাবার পানি এবং শুকনো কাপড়। আর বর্ষাকালে বৃষ্টি হতে পারে কোন আগাম বার্তা ছাড়াই। তাই ছাতা অথবা রেইন কোট নিতে ভুলবেন না।
সতর্কতা
ঝরনায় গিয়ে অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। যার ফলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। তাই ঝরনার উপরে বেশি লাফালাফি করবেন না। ঝরনার একদম পাড়ে দাঁড়াবেন না। কারণ ঝরনা অনেকটা পিচ্ছিল হয়। ঝিরিপথে হাঁটার সময় সতর্কতার সঙ্গে হাঁটবেন।
যারা যাবেন না
প্রকৃতির প্রতি যার সচেতনতার অভাব আছে, তার প্রকৃতির কাছে না যাওয়াটাই উত্তম। কারণ তিনি গেলে সুন্দর প্রকৃতি নষ্ট হয়ে যাবে। এখন এক শ্রেণির ট্রেকার তৈরি হয়েছে, যারা শুধু ট্রেকিংই করে। তাদের মধ্যে কোন সচেতনতা নেই। যে যেভাবে পারছে পাহাড় ও ঝরনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এবার ট্রেকিং করতে গিয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। ঝরনার পানিতে বা ঝিরিতে পানির বোতল, পলিপ্যাক, চিপস, চকলেট- এমনকি খাবারের প্যাকেট ফেলতে দেখে। যার ফলে ঝরনার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে এবং প্রকৃতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাদের মধ্যে এই বোধটুকু নেই; তারা প্লিজ পাহাড় ও ঝরনায় যাবেন না। পাহাড় ও ঝরনাকে বাঁচতে দিন।
এসইউ/পিআর