ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

ঘুড়ি পরিবারের সঙ্গে মহানন্দের একদিন!

রেজা ঘটক | প্রকাশিত: ১১:২০ এএম, ২৯ জুলাই ২০১৭

ঢাকার একঘেয়ে দমবন্ধ নাগরিক জীবন ছেড়ে একদিন ‘এক রঙ্গা এক ঘুড়ি’ পরিবারের সঙ্গে ‘নদীর পাশে, জলের কাছে, নীলের সাথে’ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগটি এবার আর হাতছাড়া করতে চাইনি। ঘুড়ি পরিবারের প্রধান কবি নীল সাধু ও তুলা ভাবি আগেই আমাকে এই আনন্দ ভ্রমণের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন। সে অনুযায়ী এবারের এই আনন্দ ভ্রমণে প্রকৃতির কাছে যাওয়ার দিনক্ষণ আগেই নির্ধারণ হয়েছিল ২১ জুলাই শুক্রবার।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এক রঙ্গা এক ঘুড়ি গত ৯ বছর ধরে ঢাকা মহানগরীর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ট্রেন, নৌ, বাস ভ্রমণে আমাদের ৬৪ জনের একটি দল যাত্রা শুরু করেছিল কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে সকাল সোয়া সাতটার এগারো সিন্ধু’র ট্রেনে। সাধুদা স্বয়ং রেলমন্ত্রী’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের জন্য রেলের পুরো একটি বগি বুকিং করেছিলেন। আমাদের বগিটা ছিল ‘ঠ’। একেবারে রেলগাড়ির সামনে ইঞ্জিনের সাথের বগি।

এই আনন্দ ভ্রমণ নিয়ে সাধুদা ফেসবুকে ‘নদীর পাশে, জলের কাছে, নীলের সাথে। ঘুড়ি আনন্দ আয়োজন ২০১৭’ নামে একটি পেজ খুলেছিলেন। আমরা সবাই এই ভ্রমণের সব আপডেট সেখানে রাখতাম। সাধুদা টাইম টু টাইম সেই পাতায় সব আপডেট দিচ্ছিলেন। ট্রেনের টিকিট কনফার্ম করা, সকালের নাস্তা কী হবে, দুপুরের খাবার কী হবে, কোথায় কোথায় যাত্রা বিরতি, কখন কোথায় নৌকা ভ্রমণ, কোথায় নদীতে সাঁতার কাটা, কখন কোথায় জুমা’র নামাজের বিরতি, কখন কোথায় ফটোসেশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আগেই সাধুদা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমরা সবাই কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠবো। যারা এয়ারপোর্ট থেকে উঠবে, তারা যেন ফেসবুকে এই ভ্রমণের পাতায় সারাক্ষণ আপডেট দেয়। এমন একটি আনন্দ ভ্রমণকে ক্যামেরায় ধরে রাখার জন্য আমি আমার ‘হরিবোল’ সিনেমার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর ও সহকারী ক্যামেরাম্যান প্রণব দাসকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। আমার চিফ অ্যাসিস্টেন্ট সেলিম হায়দারের নবাবপুরের অফিস থেকে ক্যামেরা নিয়ে প্রণবকে রাতে আমার বাসায় থাকার কথা। রাত দশটায় প্রণব জানালো, ‘দাদা আমি একটু পরে রওনা দেব।’

ভোরবেলা তুলা ভাবির ফোন। ‘শুভ সকাল’ না বলে দিলেন একটা ঝাড়ি। ‘ফোন ধরেন না ক্যান! হায় মাবুদ।’ আমার তখনকার দশা তুলা ভাবি যদি একবিন্দুও বুঝতেন! বা আন্দাজ করতে পারতেন! যাক তুলা ভাবিকে বললাম, ‘এখনই আমি রওনা দিচ্ছি।’

সকাল সাড়ে ছয়টায় আমি আর প্রণব কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছলাম। প্রণবকে বললাম, ‘চলো, আমরা ট্রেনে গিয়ে বসি। সবাই আসার আগে একটু ঘুমাই।’ আমি আর প্রণব এই ভ্রমণের প্রথম যাত্রী হিসেবে কমলাপুর পৌঁছেছিলাম বলে আমরা ‘এগারো সিন্ধু’ ট্রেনের নির্ধারিত ‘ঠ’ বগিতে গিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আবার সাধুদার ফোনে ঘুমের ব্যাঘাত। বললাম, ‘আমরা ট্রেনে আছি, আপনারা কোথায়, আসেন।’ তারপর একে একে ঘুড়ি পরিবারের সদস্যরা এসে ট্রেনের বগি টইটুম্বুর।

সোয়া সাতটার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে- এ নিয়ে কিছুটা বিভ্রম ছিল বটে, কিন্তু শেষপর্যন্ত সকাল পৌনে আটটায় এগারো সিন্ধু যাত্রা শুরু করলো। আমরাও হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠলাম। সাধুদা আর তুলা ভাবি ঘুড়ি পরিবারের অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রণবকে কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে আমি একটা ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সারা দিনের জন্য এনার্জি রিচার্জ করার জন্য ওটা আমার খুব দরকার ছিল। এরমধ্যে ঘুড়ি পরিবারের কেউ একজন এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে সকালের নাস্তা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আমি তাকে না করে দিলাম। কিন্তু আর ঘুমোতে পারলাম না। ততক্ষণে ট্রেন এয়ারপোর্ট স্টেশনে এসে গেছে।

ঘুড়ি পরিবার এগারো সিন্ধু ট্রেনের ‘ঠ’ বগির সামনে বিশাল এক ব্যানার টানিয়ে রেখেছিল, যাতে এয়ারপোর্ট থেকে দলের বাকিরা সবাই চট করেই আমাদের নির্ধারিত বগিতে উঠতে পারে। অনেকেই উঠতে পারলো। কিন্তু পাঁচ মেয়ে আর ওদের দুর্বল দলপতি ছেলেটি ট্রেনে উঠতে পারলো না। ‘হায় হায়! এবার কী হবে!’ সাধুদাকে বললাম, ‘ওদের ফোন করে বলে দেন, যেন পরের কোনো ট্রেনে উঠে চলে আসে।’ সাধুদা খোঁজ নিলেন। আর তেমন একটা ব্যবস্থা ওরা করবে বলে ঠিক হলো!

এগারো সিন্ধুতে আমাদের বগিতে ততক্ষণে গানে লিড করেছে নুরুল ইসলাম পারভেজ। পারভেজ খুব ভালো বাঁশি বাজায়। খুব ভালো গান করে। কোনো ঢোল বা মন্দিরা না থাকায় গানের দলে আমার কোনো কারিশমা দেখানোর সুযোগ ছিল না। তাই আমি প্রণবের থেকে ক্যামেরা নিয়ে ওদের পুরো গানের অংশটা শ্যুট করেছিলাম। গান করেছে তাসলিমা, বৃষ্টি, সারা, জাহাঙ্গীর ভাই, তুষার ভাই, জাহিদ সুমন, তানহা, বনি, উপমা, প্রাপ্তি, তুলা ভাবি, ইকু, তানভীর, জাহিদুল সরোয়ার, আফতাব জামান ভাই, ইশতিয়াক, হাফিজ, অয়ন আবদুল্লাহ, চর্যাপদ, লুৎফর রহমান পাশা ভাইসহ অনেকে।

এমন হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে কখন যে আমরা ভৈরব পৌঁছে গেছি, সত্যি একদম টের পাইনি। ওদিকে শ্রাবণধারা চলমান থাকায় পুরো স্টেশনে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অগত্যা আমরা ভিজে ভিজেই প্লাটফর্মের উল্টোদিকে আশ্রয় পাবার চেষ্টা করলাম। এবার এয়ারপোর্ট থেকে যারা ট্রেন মিস করেছে, ওদের জন্য বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করার পালা। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সোয়া দশটা। আমরা স্টেশনে ঘুরে ঘুরে তখন ছবি তুলি, চা খাই। সিগারেট খাই। গালগপ্পো করি। আর কেউ কারো ছাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি। এরমধ্যে সাধুদা জানালেন স্টেশনে এইমাত্র দাঁড়ানো ট্রেনে মিসিং টিমের ছয় জন এসে গেছে।

এবার আমাদের ব্যাটারিচালিত গাড়িতে করে ভৈরব ফেরিঘাটে যাবার পালা। বৃষ্টি না থাকলে হেঁটেই যাওয়া যেত। কিন্তু সাধুদা ঘোষণা করলেন, ‘আমরা ব্যাটারিচালিত গাড়িতে যাব। একটা গাড়িতে সাত জন যাওয়া যায়।’ শামীম আপা’র নেতৃত্বে একটি গাড়িতে আমরা উঠলাম। পুরো দলের সব গাড়ি আমাদের পেছনে ফেলে চলে গেল। তার মধ্যে আমাদের ড্রাইভার এক ছোকড়া। কখন যে গাড়ি পল্টি খায় সেই চিন্তায় সবার মুখ শুকিয়ে খাক। পথে এক ট্রাক আটকে প্রায় বিশ মিনিট আমরা আটকে থাকলাম। তারপর ফেরিঘাটের কাছাকাছি যেতেই কেউ একজন বলল, ‘আমরা ভুল পথে যাচ্ছি।’ তো এবার গাড়ি ঘুরিয়ে ঠিক পথে যাবার পালা। আমাদের মতো যারা এই ভুল করেছে, সবাই গাড়ি ঘুরিয়ে ভৈরব রেলওয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে নদীর ঘাটের দিকে আগালাম।

ভৈরবের এই নদী ঘাটে অনেক পাথর আছে। খুব সুন্দর জায়গা। মনোরম দৃশ্য। মেঘনা নদীতে জোড়া সাঁকো। শামীম আপা এই দফায় অনেক ফটোগ্রাফি করালেন আমাকে দিয়ে। সবাই ফটো তোলায় ব্যস্ত তখন। প্রণবকে নিয়ে ওদের সেই হৈ চৈ ক্যামেরায় ধারণ করালাম। ততক্ষণে সাধুদা প্রায় পাঁচশ’ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বিশাল এক ট্রলার নিয়ে পাথরঘাটে হাজির। সবাই দলবেঁধে সেই ট্রলারে উঠলাম। এ পর্যায়ে অয়ন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভাইয়া, বৃষ্টিতে তো আমাদের নৌবিহার মাটি হতে যাচ্ছে।’ জবাবে বললাম, ‘আমরা ট্রলারে ওঠার পর আর বৃষ্টি হবে না।’ আসলেই আর বৃষ্টি হয়নি। আমরা ফেরার সময় যখন ট্রলারের ছাদে প্রখর রোদে সবাই হা-হুতাশ করছে, তখন অয়ন আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী দেন!’ বললাম, ‘আর দেওয়া ঠিক হবে না।’

ghuri

শ্রাবণ মাসে মেঘনা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য যারা কাছ থেকে না দেখেছে, তাদের সেই বর্ণনা শোনানো এক ব্যর্থ প্রয়াস। বাংলাদেশ নদীর দেশ। কিন্তু আমরা এমন এক জাতি, নদী দখল করে ব্যবসা করি। নদী দখল করে বসতি গড়ি। নদী দখল করে সম্পত্তি বানাই। ঢাকার চারপাশে চারটা নদী। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালি ও তুরাগ। কিন্তু এই নদীর কোনো যত্ন তো হয়ই না, উল্টো নদীগুলো দখল, দূষণ আর ভরাটের ফলে এমন অবস্থা হয় যে, এখন বুড়িগঙ্গার তীরে গেলে পঁচা গন্ধ শুঁকতে হয়।

মেঘনা নদীতে এসে বুড়িগঙ্গার সেই কষ্ট কিছুটা দূর হলো। নদীতে নৌকায় ভেসে চলা মানে নদীতে চলাচলরত অসংখ্য স্টিমার, নৌকা, গাঙচিল, দু’পাশের জনপদ আমাকে এক নস্টালজিয়ায় নিয়ে যায়। সেই নস্টালজিয়ায় কিছুটা খোরাক জোগালেন সাধুদা ও ঘুড়ি পরিবার। এখানে নদীর পশ্চিম পাড়ে ভৈরব আর পূর্ব পাড়ে আশুগঞ্জ। আমরা মেঘনা নদীতে ভাসতে ভাসতে আশুগঞ্জ ছেড়ে লালপুর বাজারে এসে ত্রিশ মিনিটের একটা যাত্রা বিরতি দিলাম। লালপুর বাজারে আমরা চা খেলাম। ছবি তুললাম।

আবার আমরা ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে মেঘনার বুকে ভাসতে লাগলাম। ট্রলারের একেবারের চূড়ার জায়গাটি নিয়ে তখন তুলা ভাবি আর আমার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আমি ট্রলার থেকে নামলে তুলা ভাবি সিটটা দখল করেন। আবার তুলা ভাবি ট্রলারের অন্য কোথাও গেলে আমি সেই সিট পাল্টা দখল করি। আমাকে সঙ্গ দেয় বৃষ্টি, সারা, তসলিমারা। এভাবে মেঘনায় ভাসতে ভাসতে আমরা একপর্যায়ে বাইশ মৌজার ঐতিহ্যবাহী বাজারে ত্রিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি করি।

বাইশ মৌজা থেকে আমরা মেঘনা নদীকে রেখে তিতাস নদী ধরে আগাতে থাকলাম। আমার ওস্তাদ ঋত্বিক কুমার ঘটক তাঁর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির দৃশ্যায়ন করেছিলেন ঠিক এই জায়গাগুলোতে। আমার নস্টালজিক মনে তখন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির দৃশ্যগুলো ফ্ল্যাশব্যাক হচ্ছিলো। তিতাস এখানে মেঘনার তুলনায় অনেক ছোট। আরও সামনে গিয়ে আমরা তিতাসের একটি ছোট্ট শাখা ধরে আগালাম। এই জায়গায় মনে হবে অনেকগুলো নদী। আসলে এগুলো সব মেঘনা ও তিতাসের শাখা বা উপনদী। ঠিক দুপুর একটায় আমরা উত্তর লক্ষ্মীপুর পীর বাড়ির ঘাটে নামলাম। উত্তর লক্ষ্মীপুরের এই পীর বাড়ি হলো সাধুদা’র নানা বাড়ি। এখানেই সাধুদার জন্ম। প্রতি বছর এখানে বড় পীরের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে তিন দিনের ওরশ হয়। পীর বাড়ির সামনে বেশ বড় একটা খেলার মাঠ। সেখানে আমরা ফুটবল খেলতে শুরু করলাম।

এদিকে মাইক অন করে সাধুদা বারবার ঘোষণা দেওয়া শুরু করলেন, ‘দেড়টায় জুমা’র নামাজ। এর আগে আপনারা ফুটবল খেলা বন্ধ করে যারা সাঁতার কাটতে চান, তারা সাঁতার কাটবেন। যারা নামাজ পড়তে চান, তারা নামাজ পড়বেন। আর নামাজ শেষে ঠিক দুইটায় আমরা কিন্তু দুপুরের খাবার খাবো।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। জুমা’র নামাজের কারণে অবশ্য ফুটবল খেলা সোয়া একটায় বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এরপর শুরু হলো নদীতে সাঁতার কাটা। সাধুদা মাইকে বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘যারা সাঁতার জানেন না, তারা কেউ নদীর ভেতরের দিকে যাবার চেষ্টা করবেন না। তীরের কাছে থাকবেন।’ প্রণবকে নিয়ে সাঁতারের কিছু ফুটেজ নেবার পর আমিও নেমে পড়লাম ডুবাডুবিতে। একপর্যায়ে পিচ্চিদের নিয়ে ট্রলার থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ার সেই শৈশবের আনন্দ আমাকেও পেয়ে বসলো। ওদিকে সাধুদা সাঁতার শেষে আবার মাইকে বকবক করছেন, ‘আপনারা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাঁতার শেষ করবেন।’ কিন্তু আমরা তখন ঘোর শৈশবে মহানন্দে লাফাচ্ছি, সাঁতার কাটছি।

আমি বড় হয়েছি বলেশ্বর নদের তীরে। নদীতে আর পুকুরে সাঁতার কাটা ছিল আমার শৈশবের একটা বিশাল বিনোদন। সাধুদার নানাবাড়িতে এসে সেই বিনোদনের সূত্র আবার পেলাম। একপর্যায়ে সাধুদা মাইকে ঘোষণা দিলেন, ‘যারা দেরিতে আসবে, তারা খাবার পাবে কি না আমরা জানি না। কারণ, আমাদের সবার খুব ক্ষুধা লেগেছে। আমরা আর দুই মিনিটের মধ্যে খেতে বসব। যারা সাঁতার কাটতে চান, নিজ দায়িত্বে খাবার পেলে খাবেন, না পেলে বইসা থাকবেন।’ এবার আমাদের হুশ ফিরলো। তাই তো, অনেক ক্ষুধা লেগেছে। এবার আর সাঁতার কাটা চলে না।

সাধুদার দুই মামি আমাদের খাবার ব্যবস্থাপনা তদারকি করলেন। চিংড়ি মাছের ভাজি, মুরগির মাংস, ডাল আর ঘরে বানানো দই। আহা, কী যে সুস্বাদু সেই খাবার। অতিরিক্ত সাঁতার কেটে যে পরিমাণ ক্ষুধা লেগেছিল, তা পুষিয়ে দিলাম ডাল আর দই দিয়ে। দীর্ঘদিন এই দইয়ের স্বাদ আমার মুখে লেগে থাকবে। আহা, ঘরে বানানো খাঁটি দই। খাবার সময় শৈশবের যোগেন দইওয়ালার সেই প্রিয় ডাক ‘দই, ভালো দই’ বলে বেশ কয়েকটা চিৎকারও ছুড়লাম।

খাওয়া শেষে সেই মাঠের গাছের ছায়ায় বসলো কবিতা পাঠ, গান ও গল্প বলার আসর। কবিতা পড়লেন সাধুদা, জাহাঙ্গীর ভাই, তুষার ভাই, জাহিদ ভাই, জামান ভাই, চর্যাপদ ভাই, পাশা ভাই, তাসলিমা। আমি ছোট্ট করে গল্প শোনালাম আর সেদিনের ঘুড়ি পরিবারের সঙ্গে আনন্দ অনুভূতি ব্যক্ত করলাম। তাসলিমা গান শোনালো। পারভেজ বাঁশি শোনালো, গান শোনালো। এক পর্যায়ে সাধুদা ঘোষণা করলেন, ‘আমরা ঠিক চারটায় আবার ট্রলারে উঠব।’ তারপর সেই মাঠে আমাদের ফটোসেশন করা হলো। এরপর মামিদের ও সাধুদার নানা বাড়ির অন্যদের থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ট্রলারে উঠলাম। এবার আমরা তিতাস ও মেঘনা নদী ধরে আশুগঞ্জ গিয়ে নৌবিহার শেষ করব।

এবার ফেরার পথে রোদের বেশ তাপ। আমরা ট্রলারের ছাদে বসে ছবি তুললাম। গান গাইলাম। আর নদীর দু’পাশের অসংখ্য মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আশুগঞ্জ পৌঁছলাম। এরমধ্যে এক ঘটনা ঘটেছে। গ্রুপ ছবি তোলার সময় কে যেন আমার হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ক্যামেরার মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না। তুলা ভাবিকে মডেল বানিয়ে অনেক ছবি তুললাম সেই ক্যামেরায়। একপর্যায়ে সাধুদাও মডেল হলেন। ট্রলারে বসে বসে নদী ও নদীর দু’পাশের ছবি তুলে আমি ততক্ষণে মেমোরি কার্ড ভর্তি করে ফেলেছি। এখন বোকা ক্যামেরার মালিকের খবর নাই। সাধুদাকে বললাম, ‘এই ক্যামেরার যে মালিক, তাকে একটু দরকার।’ সাধুদা বললেন, ‘টেনশন নিয়েন না। ক্যামেরার যে মালিক, সে ঠিকই আপনার থেকে ক্যামেরা বুঝে নেবে। কেউ না নিলে আমার কাছে দিয়েন।’

আশুগঞ্জে ট্রলারে নেমে পুরো টিমকে হটিয়ে দিয়ে সাধুদা, শিমুল আর আমি একটু পেছনে থেকে গেলাম। আমাদের কিছু জরুরি মিটিং করার জন্য। সবার পেছনে হেঁটে হেঁটে আমরা সেই মিটিং শেষ করে সামনে এসে দলের অনেককে আর পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে হাঁটার ভয়ে রিকশা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড চলে গেছে। কিন্তু সাধুদার প্ল্যান ছিল পাহাড়ি টিলা টপকে সবাইকে হাঁটিয়ে বাসস্ট্যান্ড নেওয়ার। কিন্তু দলের অর্ধেকের বেশি রিকশায় করে আগেই ভেগে গেছে। শেষপর্যন্ত আমরা কয়েকজন পাহাড়ি টিলার মতো উঁচু ঢিবি টপকে সেই রোমাঞ্চ শেয়ার করলাম। ওই পুরোটা পথ আমরা হেঁটেই বাসস্ট্যান্ড এসেছি।

সাধুদা আগেই বলেছিলেন, ‘বাসে ওঠার আগে আমরা মালাই চা খাবো।’ আমরা পুরো এলাকায় একটা চক্কর দিয়ে এক পশলা চা খেলাম। বাসের কোনো খবর নাই। মালাই চা খেয়ে আমরা যখন বাসে উঠব ঠিক তখন ক্যামেরার মালিকের দেখা মিললো। ক্যামেরার মালিক আমাদের লুৎফর রহমান পাশা ভাই। পাশা ভাই এসে বললেন, ‘রেজা ভাই, এবার ক্যামেরাটা দেন। আমি তো এখান থেকে বিদায় নিচ্ছি।’ বুঝলাম, পাশা ভাইর নৌবিহার শেষে একটু শ্বশুরবাড়ি ঘুরে আসার বাসনা জেগেছে। আশুগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে আমরা দলের ৬৪ জন থেকে একমাত্র পাশা ভাইকে রেখে ৬৩ জন আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। পাশা ভাই আমাদের বিদায় দিয়ে শ্বশুরবাড়ির দিকে আগালেন।

ঢাকা থেকে দূরের শহরের বাসগুলো অনেক ভালো। সে তুলনায় ঢাকা থেকে কাছের শহরগুলোর বাস ততো ভালো না। কিন্তু আশুগঞ্জে সাধুদা অনেক ভালো একটা বাস ম্যানেজ করেছেন। কিন্তু ড্রাইভারের চান্দি অনেক গরম। আমাদের বাংলা সিনেমার অচল গানগুলো ফুল ভলিউমে বাজিয়ে উল্টাপাল্টা বাস চালানো যেন তার মিশন। বাসের ড্রাইভারকে প্রায় আমাদের সবাই বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও ড্রাইভার নিজের পছন্দমতো সারা পথ জোরসে চালালেন। তুলা ভাবি এক ধমক দিয়ে তার ফুল ভলিউমের গান বন্ধ করালেন। কিন্তু জোরসে বাস না চালানোর ব্যাপারটা আমরা কেউ তাকে বুঝিয়েও করানো গেলো না।

এরপর শুরু হলো ঘাটে ঘাটে আমাদের দলের কেউ কেউ নেমে যাবার পালা। নরসিংদীতে নামলো কয়েকজন। কাঁচপুর ব্রিজের ওপারে নামলো কয়েকজন। নারায়ণগঞ্জের একটা দল নামলো কাঁচপুর ব্রিজের এপারে। কয়েকজন নামলো যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে ওঠার আগে। রাত এগারোটায় আমরা কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। অবশিষ্ট দলের থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর প্রণবও এরপর ছুটলাম নিজেদের গন্তব্যে।

গোটা দিনের নানা কিসিমের আনন্দময় ঘটনাগুলো বারবার তখন ফ্ল্যাশব্যাক দিচ্ছিলো মাথার ভেতরে। এমন একটি আনন্দময় দিন উপহার দেওয়ার জন্য ঘুড়ি পরিবার এবং বিশেষভাবে সাধুদা ও তুলা ভাবিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন থেকে আমিও ঘুড়ি পরিবারের একজন। ঘুড়ি পরিবারের অন্যান্য কর্মযজ্ঞে আমিও সানন্দে যোগ দিতে চাই।

এসইউ/আরআইপি

আরও পড়ুন