পাহাড়ি ঝরনার সঙ্গে একদিন : শেষ পর্ব
চারিদিকে অন্ধকার, সুনসান নীরবতা। কাকডাকা ভোরে হালকা নাস্তা করে অলংকার মোড় থেকে ৫টার বাসে করে কাপ্তাই জলবিদুৎ কেন্দ্রের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। পাহাড়ি পথ পেড়িয়ে রাঙ্গামাটির দিকে এগিয়ে চলছে চার চাকার বাসটি। সকাল ১০টার দিকেই পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনে। যখনই গেটের সামনে গেলাম ভিতরে প্রবেশ করার জন্য; তখনই বাঁধল বিপত্তি। আমাদের কাছে চাওয়া হল বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র। কিন্তু আমরা তো সেটি নিয়ে যাইনি। অনেক অনুনয়-বিনয় করার পরও মিলল না প্রবেশের অনুমতি।
ব্যর্থ হয়ে সামনের ট্রলার ঘাটের দিকে আগাতে থাকলাম। রুবেল আর অর্জুন ট্রলার ঠিক করলো। ঘাট থেকে পানি আর শুকনা খাবার নিয়েছিলাম। ছাউনির নিচে সবাই বসে পড়লাম। আগের রাতে ঢাকা থেকে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল ইমন। কাপ্তাই লেকের উপর দিয়ে চলতে শুরু করল আমাদের ট্রলার। চালককে বলা ছিল- বিদ্যুৎ কেন্দের বাঁধের কাছাকাছি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যে-ই কথা সে-ই কাজ। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি। দেখলাম আর আফসোস করলাম ভিতরে না যাওয়ার আক্ষেপে। দুই পাশে ছোট-বড় পাহাড় দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজারের লঞ্চ ঘাটে।
হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। ৫টার দিকে ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই ঝুলন্ত সেতু দেখতে। অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে আমরাও হারিয়ে গেলাম কাপ্তাই লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে। পাহাড়ের উপর থেকে নিচের পানি দেখতে যে এত সুন্দর লাগে, তা আগে কখনো বুঝিনি। সন্ধ্যা নেমে আসতে আমরাও ফিরতে লাগলাম।
রাতে আমি, অর্জুন আর মিনি গুগলার রুবেল গেলাম পরের দিনের জন্য ট্রলার ঠিক করতে। এক মাঝির সাথে কথা বলার পর সে আরেকটা নৌকায় করে অন্ধকারের মধ্যে দূরে কোথাও নিয়ে গেল। কেমন জানি ভয় হচ্ছিল, যদি আমাদেরকে অপহরণ করে! প্রায় ১৫মিনিট পরে একটা ট্রলারের সামনে থামিয়ে দেখালো- এই হচ্ছে আপনাদের ট্রলার, যেটাতে কাল আপনাদের নিয়ে যাওয়া হবে। ভাড়া ঠিক হলো ১৫০০ টাকা। আবার আমাদের সেই ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। তখন কেমন জানি মনে একটা প্রশান্তি পেলাম।
রাতেই আমরা বারবিকিউ করেছিলাম। আমাদের রুমের পাশেই ছিল হোটেলের ছাদের একটা অংশ। অনেক বাতাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মনটাকে অনেক বেশি রোমান্টিক করে দিচ্ছিল। কথা অনুযায়ী সকালে নাস্তা সেরে ৯টার মধ্যেই ট্রলারে উঠে পড়লাম।
মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার মধ্যেই এগিয়ে চলছে আমাদের ট্রলার। একসঙ্গে সবাই গেয়ে উঠলাম, ‘লাল পাহাড়ের দেশে যা... রাঙ্গামাটির দেশে যা... এখান তোকে মানাইছে না যে...’। প্রায় ৩০ মিনিট পরেই দেখলাম চাং পাই নামের টিলার উপরে একটা রেস্টুরেন্ট। বেম্বো চিকেন, বেম্বো ফ্রাই, রাইছ অর্ডার করে গেলাম ১৬ জনের জন্য। দেখতে দেখতে সুবলং ঝরনার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছি বরকলের দিকে, বরকল উপজেলার সাইনবোর্ড দেখে খুব ভালো লাগলো। পাহাড়ের উপরে কোন ধাতব দিয়ে বড় করে লেখা বরকল উপজেলা।
কিছুদূর যেতেই বরকল উপজেলা বাজার, আর সেখানেই ছিল আমাদের গন্তব্য। বাজারের পাশেই বড় একটি পাহাড়, নাম টিঅ্যান্ডটি পাহাড়, প্রায় ২০০০ ফিট উঁচু। তার নিচেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকি। সবাই নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে বোতলে পানি, স্যালাইন এবং শুকনো খাবার নিয়ে শুরু করলাম পাহাড় যাত্রা। প্রথমে প্রায় ৬০০ এর মত সিঁড়ি ছিল, পাহাড়ের চেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা যে বেশি কষ্টকর তা সেদিনই টের পেয়েছিলাম। একপর্যায়ে জাকিরকে পানি খাওয়ার জন্য বলতেই ও হাসি শুরু করলো। ঘটনাটা তখনো বুঝে উঠতে পারলাম না। পরে ও বলল, ‘আমি তোমার বোতলের পানি খেলে তো বোতলের ওজন কমে যাবে। এত বোকা আমি নই।’ এ কথা বলেই সে তার বোতলের পানিই খাওয়া শুরু করলো।
কিছুদূর যাচ্ছি আর কিসমিস, খেজুর, স্যালাইন খেয়ে নিচ্ছি। এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম টিঅ্যান্ডটি পাহাড়ের চূড়ায়। যেখান থেকে রাঙ্গামাটির অনেকাংশই দেখা যায়। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন, রয়েছে টেলিটকের নেটওয়ার্ক টাওয়ার। সামনে দেখলাম একটা রাস্তা আছে। যখনই যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলাম; তখনই দেখলাম একটা গাছে ছোট্ট সাইন বোর্ডে লেখা- ‘সামনে যাওয়া নিষেধ’। ফলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেনাবাহিনীর সদস্যদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন যাওয়া যাবে না?’ তারা বললেন, ‘সেখানে চাকমা জাতির বসবাস। তারা সাধারণত বাঙালি দেখলে অনেক সময় দা, ছুরি ছুঁড়ে মারে।’ তাই আর ঝুঁকি নিলাম না। চূড়ায় বসে ঘণ্টাখানেকের মত আড্ডা মেরে নিচে নামলাম।
বাজারে গিয়ে দেখতে লাগলাম স্থানীয় কী কী পাওয়া যায়। একপর্যায়ে বাজারের শেষ মাথায় গিয়ে দেখলাম অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। ছবি তুলতে আর সময় নিলাম না। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে ছিটেফোঁটা বৃষ্টির মধ্যেই ফিরতে শুরু করলাম। সুবলং ঝরনায় এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তেমন পানির প্রবাহ নেই, মনে হলো টিকিটের টাকাটাই জলে ফেললাম। যাই হোক সামনেই না কি ছোট একটা ঝরনা আছে। সেটা দেখার জন্য মাঝিকে ট্রলার ছাড়তে বললাম।
সেখানে এসে কিছুটা ভালো লাগল। পানির প্রবাহ অনেক ছিল। এখানে কিছুটা সময় পার করে দ্রুতই ট্রলারে উঠে পড়লাম। কারণ তখন ক্ষুধায় আমাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সাড়ে তিনটার দিকে চলে আসলাম চাংপাই রেস্টুরেন্টে। যেখানে অর্ডার করে গিয়েছিলাম। বাহারি আইটেম দেখে তো জিভের পানি পড়ে যাচ্ছিল। সবাই বসে পড়লাম অন্যরকম এক বসার ভঙ্গিতে। বাঁশ দিয়ে তিরি ঘরগুলো দেখলেই মনে হয় কেমন জানি শান্তি আছে এই ঘরগুলোতে। বাঁশের মধ্যে চিকেন রান্না, আর বাঁশের কচি অংশ দিয়ে করা ভাজিটা অসাধারণ ছিল। সাথেই ছিল একটা চায়ের দোকান, খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে চা পান করতে চলে গেলাম সেই দোকানে। এই টিলাটিতে বসার জন্য বাঁশ দিয়ে বেঞ্চ তৈরি করা আছে। সেখান থেকে লেকের সৌন্দর্য যেন মনকে আবেগী করে দেয়। সবাই নীরবে সেই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম।
সূর্য মামা বলছে- তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই আমরাও আর দেরি করলাম না। ট্রলারে উঠেই শুরু করল ইমনের পাগলামি। ক্যামেরায় ক্লিক করছে অবিরত। সবাই গান গাইতে গাইতে চলে আসলাম সেই রিজার্ভ বাজারের লঞ্চ ঘাটে। হোটেলে গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের জন্য বের হয়ে গেলাম। বাসের টিকিট করা ছিল রাত সাড়ে ১০টার। হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চলে আসলাম বাস কাউন্টারে। এভাবেই শেষ হল আমাদের চারদিনের ঢাকা-চট্রগ্রাম-রাঙ্গামাটি-ঢাকা ভ্রমণ। অপরূপ এই ভ্রমণ সত্যিই সারাজীবন মনে রাখার মতো।
এসইউ/জেআইএম