ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন ত্রিপুরা
ঈদের ছুটিতে বেড়ানোর পরিমাণ বেড়ে যায়। কর্মজীবন থেকে ছুটি পেয়ে একটু ক্লান্তি দূর করতেই ঘুরতে বের হওয়া। কেউ দেশের ভেতরে আবার কেউ দেশের বাইরে বেড়াতে যান। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের দিকেই বেশি মানুষ ছোটে। কম সময়ে এবং কম খরচে সহজেই ঘুরে আসা যায় এসব দেশ থেকে। যারা ভারতে ঘুরতে যান তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ দার্জিলিং, কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, কাশ্মির, মানালিই যায়। তবে আমাদের সবচেয়ে কাছের ভারতে প্রকৃতির অপরূপ সুন্দর জায়গা আছে। যা আমরা অনেকেই জানি না। আসুন তেমনি একটি জায়গা নিয়ে আজ আপনাদের ভ্রমণপিপাসা জাগাই-
ত্রিপুরা কেন
ত্রিপুরাকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে দূরবর্তী স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য হল ত্রিপুরা। ছোট হলেও এটি অতীব সুন্দর একটি রাজ্য। শান্ত সরল ও মনোরম পরিবেশ। এই রাজ্যের ইতিহাস মহাভারতের সময়কাল থেকে সূচনা হয়েছে। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, ভূমি অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘ত্রিপুরা সুন্দরী’র নামানুসারে এই নামটি রাখা হয়েছিল। ত্রিপুরা পূর্বে মাণিক্য রাজবংশের মহারাজাদের দ্বারা শাসিত ছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এই রাজ্যটি ভারতের সঙ্গে মিলিত হয় এবং ১৯৭২ সালে ত্রিপুরা একটি রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। এই রাজ্যটি পূর্বে মিজোরাম, উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম এবং উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত।
বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
ত্রিপুরার অভয়ারণ্য স্পষ্টভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে ব্যাখ্যা করে। এই রাজ্যে চারটি অভয়ারণ্য রয়েছে যেগুলো বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে এবং প্রকৃতির একটি অত্যাশ্চর্য আলো-আঁধারি নিয়ে অবস্থিত। গোমতী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, রোয়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সিপাহিজলা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ত্রিপুরাকে করেছে সমৃদ্ধ। এই অভয়ারণ্য হাতি, হরিণ, সম্বর, বাইসনের জন্য বিখ্যাত। রোয়া অভয়ারণ্যটি ওষধি, পশুখাদ্য, অর্কিড এবং অন্যান্য উদ্যানজাত গাছপালার জন্য সুবিখ্যাত।
ত্রিপুরার মন্দির
ত্রিপুরার মন্দিরগুলো হল এই রাজ্যের পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ত্রিপুরার মন্দিরগুলো তাদের স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের জন্য সুপরিচিত এবং সারা বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটকদের আকর্ষিত করে। বিখ্যাত মন্দিরগুলোর মধ্যে ভুবনেশ্বরী মন্দির অন্যতম। এই মন্দিরটি গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত যা ১৬৬০-১৬৭৫ সালে মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য দ্বারা মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। হিন্দুদের ৫১টি পীঠস্থানের একটি হল এই ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির। ত্রিপুরার সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থানের একটি হল কমলাসাগর কালী মন্দির যা বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত।
ঊনকোটি
কোটির থেকে এক কম। ঊনকোটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আগরতলা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে কৈলাসহর। কৈলাসহর থেকে ৮ কি.মি দূরে রঘুনন্দন পাহাড়। এই পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্তি। এই মূর্তিগুলো সম্ভবত সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর। প্রাচীন এই মূর্তিগুলোই পর্যটকদের ডেকে আনে। সঙ্গে রয়েছে এখানকার নৈঃস্বর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। পাহাড়ি ঝরনা থেকে অবিরল জলের ধারা বয়ে চলছে। জায়গাটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হলেও ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র পুরো ঊনকোটির দায়িত্বে। প্রতিবছর মকরসংক্রান্তি ও অশোকাষ্টমীতে মেলা বসে। আগে ভক্তরা করলেও এখন ত্রিপুরা সরকারই এই মেলার আয়োজন করে।
নীরমহল
ইংরেজিতে ওয়াটার প্যালেস। আগরতলা থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে মহারাজার অবসর বিনোদনের এই মহলটি এখন পর্যটকদের আকর্ষণের মূলকেন্দ্র। ১৯৩০ সালে মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের আমলে নির্মিত প্রাচীন স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। প্রাসাদটিতে ত্রিপুরার ঐতিহ্য মাথায় রেখে হিন্দু ও মুসলিম উভয় স্থাপত্যেরই ছোঁয়া রয়েছে। বিশাল প্রাসাদকে ঘিরে রয়েছে প্রায় ৫,৩০০ কিলোমিটারের এক দীঘি। দীঘির নাম রুদ্রসাগর। প্রায় আধাঘণ্টা নৌবিহারের পর পৌঁছানো যায় আসল প্রাসাদে। প্রতি শীতে আয়োজন করা হয় নীরমহল পর্যটন উৎসবের। উৎসবে তুলে ধরা হয় রাজ্যের উপজাতি ও বাঙালি সংস্কৃতিকে। রুদ্রসাগরের পারেই গড়ে উঠেছে ত্রিপুরা পর্যটন নিগমের অতিথিশালা সাগরমহল। পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার অসাধারণ বন্দোবস্ত রয়েছে এখানে। ছোটদের বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি পার্ক। স্থানীয়দের মনসামঙ্গল কীর্তন বাড়তি পাওনা। মেলাঘরের এই নীরমহলের কাছেই সোনামুড়া বক্সনগর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাছে এই সোনামুড় ও বক্সনগরও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। বক্সনগরে খনন করে পাওয়া গিয়েছে বৌদ্ধ বিহার। পর্যটকদের কাছে এই বৌদ্ধবিহারও বেশ আকর্ষণের।
বিলোনিয়া
বিলোনিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান। রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক ঘটনা। এই স্থানেই স্বাধীনতা যুদ্ধের কে ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন বাহিনী প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিলোনিয়ার চোত্তাখোলায় মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে স্মারক উদ্যানের উদ্বোধন করেছিলেন। সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আদলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ ফুট দীর্ঘ একটি ভাস্কর্য ও সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলে স্তম্ভ তৈরী করা হয়েছে।
এছাড়াও পরিদর্শনযোগ্য স্থানসমূহ হচ্ছে- সবুজ উপত্যকা, পাহাড়ি স্রোত, পাহাড়, ডামবুর হ্রদ, উজ্জায়ান্তা প্রাসাদ, কুঞ্জবন প্রাসাদ, সরকারি জাদুঘর, জাম্পুই পাহাড়, গোমতী অভয়ারণ্য, তৃষ্ণা অভয়ারণ্য, এবং সিপাহিজলা অভয়ারণ্য, ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির, কমলাসাগর কালী মন্দির, ভুবনেশ্বরী মন্দির, দক্ষিণ ত্রিপুরার মনু বকুল বৌদ্ধ মন্দির, আগরতলার বেণুবন বিহার বৌদ্ধ মন্দির, উত্তর ত্রিপুরার পেচারথাল বৌদ্ধ মন্দির প্রভৃতি।
কেনাকাটা
ত্রিপুরা এসে ঘুরে যাবেন কিন্তু কেনাকাটা করবেন না, তা কি হয়? ত্রিপুরায় কেনাকাটার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হল রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আপনি আদিবাসী গ্রামগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে সেখানকার কারিগরদের কর্মযজ্ঞ দেখতে পারেন এবং তাদের কাছ থেকে কেনাকাটাও করতে পারেন। অন্যান্য রাজ্যের মতো ত্রিপুরাতেও কেনাকাটার জন্য সরকার পরিচালিত দোকান এবং ব্যক্তিগত দোকান পাবেন।
কখন যাবেন
ত্রিপুরা ভ্রমণের সেরা সময়- সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ। তাছাড়া সারা বছরই ঘুরতে পারবেন প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে যেতে পারেন আগরতলা। ভাড়া একদম হাতের নাগালে। আবার ট্রেনেও যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে আখাউড়া যেতে হবে ট্রেনে। সেখান থেকে অটো, সিএনজি, মাইক্রোবাসে আখাউড়া স্থলবন্দর যেতে হবে। ইমিগ্রেশন শেষ করে ট্যাক্সি অথবা বাসে আগরতলা শহরে ঢুকে পরবেন। সময় লাগবে ১৫-২০ মিনিট।
এসইউ/জেআইএম