জল আর বনের ভাব-ভালোবাসা
আমিসহ ন’জন। ন’জন খবরের মানুষ। মাসের ৩০টা দিনই খবর নিয়েই কারবার। কে কোথায় কী বললো, কার কোথায় কী হলো, কী হলো না- নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ এসব নিয়েই। মুক্তি চাই। কিভাবে? ঘুরতে যাই। সিদ্ধান্ত হলো সিলেট যাব; রাতারগুল আর বিছনাকান্দি, একদিনেই, এক রাতে যাব, আরেক রাতে ফিরব, ট্রেনে, রাতের ট্রেনে।
৯টা ৫০-এ ট্রেন ছাড়বে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে। মালিবাগ আবুল হোটেল থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে রিকশায় উঠে হঠাৎ করে যাওয়ার সব ইচ্ছা কোথায় যেন উবে গেল। বারবার মনে হচ্ছে কী যেন একটা ফেলে যাচ্ছি। কী? কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন উত্তর শাজাহানপুর পর্যন্ত পৌঁছেছি, ফোনটা বেজে উঠল। ধরেই শুনি তুমুল হট্টগোল। ওপাশের কথা বিশেষ কিছু বুঝতে পারছি না। ভেঙে ভেঙে কানে আসছে, ‘সিলেট-ঢাক্কা, সিলেট-ঢাক্কা।’ বুঝলাম ওরা পৌঁছে গেছে।
যথারীতি আমাদের ট্রেনে উঠতে হলো দৌড়ে; যদিও নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই আমরা হাজির হয়েছিলাম স্টেশনে। যথাসময়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। মালিবাগ, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, উত্তরা হয়ে আমরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেলাম একসময়। আমরা ছুটছি সবুজের দিকে, পেছনে পড়ে থাকছে ধূসর ঢাকা, প্রতি মুহূর্তে দূরত্ব বাড়ছে, উল্টোদিকে দূরত্ব কমছে।
তারই মধ্যে ট্রেনে বসেছে তুমুল আড্ডা। এর এ গল্প, ওর ও গল্প শুনতে শুনতে ঘণ্টাগুলো কাটছে। মাঝে মাঝে চোখটা বন্ধ করছি। উদ্দেশ্য রাতারগুল হলেও চোখে ভেসে উঠছে সমুদ্র। কানে বেজে উঠছে সঞ্জীব চৌধুরীর গান। তবে সেসব কিছু টিকছে না এদিককার আড্ডাবাজিতে। আড্ডা চলছে অফিসে কে কবে কীভাবে বকা খেয়েছে, খেয়ে কার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ট্রেনের শব্দের ছন্দে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে গল্পের ছন্দ, আবার ফিরে আসছে। আহা! হাসিমুখগুলো।
দু’পাশে অচেনা গ্রামের বুক চিড়ে ট্রেন ছুটছে, তুমুল শব্দে। ভোরের আগে আগে সঙ্গী হলো বৃষ্টিও। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। বিদ্যুতের ঝলকে কখনও দেখা যাচ্ছে দূরের একটা বাড়ি, কখনও সুপারি গাছের সারি, কখনও আবার বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। ছুটে চলা ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ছে বৃষ্টির ঝাপটা। বাতাসে বিশুদ্ধ সোঁদা মাটির গন্ধ।
খুব সকালেই পৌঁছে গেলাম সিলেট। জিন্দাবাজারে পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে সিএনজি নিয়ে যাত্রা শুরু আমাদের। যাচ্ছি রাতারগুল। খানাখন্দে ভরা রাস্তা পেরিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম মোটর ঘাট। সেখান থেকে দুই নৌকায় ভাসলাম গোয়াইন নদীতে।
মাঝি দু’জনের একজন সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। অন্যজনের বয়স বোঝা যায় না, চেহারায় বয়সের ছাপ থাকলেও কণ্ঠে বয়সন্ধির ছোঁয়াটুকু নেই। উচ্চতাও সাড়ে চার ফুটের বেশি নয়। ওরাই আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে রাতারগুল।
প্রথম পাঁচ-সাত মিনিট দু’পাশে চিরাচরিত গ্রামের দৃশ্য। এরপর একটা বাঁক নেয় গোয়াইন। ঢুকে পড়ে বনের মধ্যে। বাড়তে থাকে পাখির ডাক, কিচিরমিচির নয়, বুঝে-শুনে, ছন্দে, তালে। নৌকা এগুতে থাকে ধীরগতিতে, শান্ত জলের সঙ্গেও সন্ধি করে। একটু নড়াচড়াতেই মাঝির ভয়, আমারও। এই বুঝি উল্টে গেল।
ততক্ষণে সবুজ বেড়েছে দু’পাশে, এসেছে আরও কাছে। গন্ধ আসছে নাকে; মাটির, গাছের, পানির। সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। এই হলো সোয়াম্প ফরেস্ট; বাংলায় যাকে বলে জলাবন বা জলার বন।
চারপাশে নিজের মতো করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গাছগুলো। পানির সীমানা ঘেঁষে যে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর নিচের দিকের ডালের পাতাগুলো কাদামাখা। বনের মধ্যে বইয়ে যাওয়া বাতাসে মাথা নুইয়ে থাকা ডালগুলো ছুঁয়ে গেছে জলের শরীর, এখন বয়ে যাচ্ছে তারই চিহ্ন। কোনো বেলার বৃষ্টিতে হয়তো ধুয়ে যাবে সেসব চিহ্ন, তারপর আবার তারা শরীরে মেখে নেবে নিচে বয়ে যাওয়া জলের অস্তিত্ব।
খুব চুপচাপ চারদিক। ঘোলা জলরাশি। মাঝির হাতে থাকা বৈঠা ছলাৎ করে আছড়ে পড়ছে জলের শরীরে, পদার্থবিদ্যার সূত্র খাটিয়ে বাতাসের প্রতিকূলে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নৌকা। জলের শব্দ, বাতাসের শব্দের আড়ালে গভীর থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। চেনা পথে মাঝি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে রাতারগুলের গভীরে- জলের রাজ্যে, সবুজের রাজ্যে। কোথাও পরিচিত কোনো দৃশ্যের অবতারণা নেই। আমরা ক’জন অবাক দৃষ্টিতে দেখছি জল আর বনের ভাব-ভালোবাসা, ওদের মিলেমিশে থাকা।
ততক্ষণে আমরা পৌঁছে গেছি বাংলাদেশের একমাত্র জলাবনের বেশ গভীরে। রাতাগাছ থেকে নাম পাওয়া রাতারগুলের মূল সৌন্দর্য বর্ষায়। আমরা গেছি গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতে। এ বন সাপের আখড়া হলেও পানি কম থাকায় সাপ বা জোঁকের মুখে পড়তে হয়নি আমাদের। বর্ষায় পানি বেড়ে গেলে এখানে চলতে হয় খুব সাবধানে। কারণ, সাপগুলো তখন আশ্রয় নেয় গাছে। আর নৌকায় এগোতে হয় কখনও কখনও হাত দিয়ে ডালপালা সরিয়ে।
বনের বেশিরভাগটাই জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল আর করচ গাছ। জলমগ্ন এ বনে বনবিভাগের লাগান বৃক্ষও রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ বন অনেকের কাছে খ্যাতি পেয়েছে বাংলাদেশের আমাজন বলে। তবে এতদূর যারা বলতে চান না অন্তত সিলেটের সুন্দরবন বলতে তারা নারাজ নন।
প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা থেকে অনেক দূরে এই সবুজ অরণ্যে আমরা মেখে নিচ্ছিলাম প্রকৃতির সবটুকু ভালোবাসা; গাড়। মেঘালয়ের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানি, এখানে, এই বনে এসে ভীষণ স্থির। মায়াবী। গোয়াইনের পানিতে ভাসতে ভাসতে আমরা পৌঁছে গেলাম রাতারগুলের পর্যবক্ষণ টাওয়ারের কাছে। বনের গাছগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ টাওয়ারটি থেকে একনজরে সম্পূর্ণ বনটি দেখে নেয়া যায়। তবে গাছগাছালির মধ্যে ইট-সুরকির এ টাওয়ারটি বড্ড বেমানান।
ফেরার পথে আকাশ খুব দ্রুত রূপ বদলাতে শুরু করল। আমাদের গতি অবশ্য আগের মতোই মন্থর। বৃষ্টি ছাড়া জলাবন সফর পূর্ণতা পায়? প্রকৃতি বোধহয় তাই ষোলআনা দিতেই বৃষ্টি ঝড়িয়ে দিল শহুরে শরীরগুলোতে। চারপাশের স্থিরপানিতে সবুজের প্রতিচ্ছবি আর তাতে টুপটাপ করে এসে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। নৈঃশব্দ্য সৌন্দর্য পেছনে ফেলে আমরা ফিরে যাচ্ছি মোটর ঘাটের দিকে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মোটরের শব্দ; ডিঙি নৌকার বদলে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। উদ্দেশ্য গোয়াইন ঘাট।
এনএফ/জেআইএম