প্রকৃতির মায়ায় জড়ানো মহামায়া ইকো পার্ক : প্রথম পর্ব
শহরে আমরা যারা কর্মব্যস্ত মানুষ; তারা কেবল ছুটি পেলে গ্রামের বাড়ি যাই। পরিবারকে সময় দেই। আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে যাই। তাই ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগটা একটু কমই আসে। কেননা কর্মব্যস্ত জীবনে ঘুরতে যাওয়ার সময়ও আসে কেবল ছুটির দিনে। এবার তাই ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম। তেমনই এক ছুটির দিন পেয়ে গেলাম। পহেলা মে ‘মে দিবস’র ছুটির দিনটি আর হাতছাড়া করতে চাইনি। বন্ধু নিপুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম একদিনের ভ্রমণে।
উত্তর বাড্ডা থেকে সকাল ৭টায় রওয়ানা দিয়ে সাড়ে ৭টায় গিয়ে হাজির হলাম মালিবাগ মোড়ে অবস্থিত নিপুলের বাসায়। গিয়ে কিছুটা হতাশ হলাম। সবাই ঘুমাচ্ছে। তৈরি হবার তাড়া নেই কারো। নিপুল আমাকে রাত সাড়ে ১১টায়ও বলেছে গাড়ি আটটায় ছাড়বে। এরপর শুনলাম, আগের রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে বাইক দুর্ঘটনায় ডানহাতের কনুইতে আঘাত পেয়েছে নিপুল। কনুইয়ের বেশখানিক জায়গার চামড়া উঠে গেছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। যে কিনা এতো সুন্দর আয়োজনের কথা জানালো আমাকে। এখন সেই বলছে, ‘তোরা যা, আমার হাতে ব্যথা করছে।’ আমি বললাম, ‘তুমি না গেলে আমিও যাবো না। বাসায় চলে যাই।’ নিপুল বলল, ‘নাহ। দেখি যদি ব্যথার ওষুধ খেয়ে যেতে পারি কিনা।’
সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু মৃদুল, ইমাম, মিজান। আমাদের কথোপকথনে ঘুম ভাঙলো ওদের। ওরা এবার উঠে তৈরি হচ্ছে। আমার একটু পরে হাজির হলো মইন। ওর হাতে ৬টি বাটার বন আর এক পট গরম চা।
ভ্রমণের ব্যাপারে বন্ধু মিজান বরাবরই আগ্রহী। বলতে গেলে, ভ্রমণ করা ওর শখ। তাই যাবতীয় দায়িত্ব বর্তায় ওর ওপর। তাই আগে থেকেই মিজানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গাড়িসহ উপস্থিত ছিলো মিজানের বন্ধু রুয়েত। রুয়েত অবশ্য গাইডের মতোই দায়িত্ব পালন করছে। সে স্মার্ট ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে বসে আছে। কোথা থেকে কোন স্পট কত দূর? কোন সড়ক দিয়ে গেলে সুবিধা হবে ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা সবাই নিপুলকে নিয়েই বের হলাম। শান্তিনগরে অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে মন ছুটলো অজানার উদ্দেশ্যে।
সকাল ৯টায় গাড়ি ছাড়লো। প্রথমত সিদ্ধান্ত ছিলো কুমিল্লা যাওয়ার। সেখানে কোটবাড়ীসহ কয়েকটি স্পট ঘুরে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবো। আর সে অনুযায়ী কুমিল্লায় অবস্থানরত বন্ধু মিলনকে বলেও রাখা ছিলো। কিন্তু গাড়ি যতো এগোচ্ছে আমাদের মন ততোই দূরে চলে যাচ্ছে। গুগল ম্যাপ ধরে ধরে স্পটের দূরত্ব বলে যাচ্ছে রুয়েত। গাড়িতে বসেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গাড়ি চললো মহামায়া ইকো পার্কের উদ্দেশ্যে।
কুমিল্লার উদ্দেশ্যে যাত্রা অবশেষে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার মহামায়া ইকো পার্কের ফটকে গিয়ে শেষ হবে। তবে একদিনে সম্ভব কিনা? বা রাতের মধ্যে ফিরে আসা যাবে কিনা? এ নিয়েও সংশয় ছিলো। কেননা পরদিন সকালেই আবার সবাইকে ছুটতে হবে কর্মস্থলে। তবে মে দিবসের ছুটির কারণে পুরো ঢাকা থেকে মীরসরাই পর্যন্ত রাস্তায় কোথাও একটু যানজটে পড়তে হবে না। গাড়ি চালকের এমন আশ্বাসেই ছুটে চলা।
ঢাকার ব্যস্ততম সড়কেও গাড়ি কম বলে ঢাকা শহর থেকে বের হলাম দ্রুতই। যেহেতু সকালের নাস্তা করা হয়নি কারো। তাই নাস্তার জন্য বিরতি তো অবশ্যই দরকার। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো সোনারগাঁওয়ে গিয়ে সকালের নাস্তা করবো আমরা। সে অনুযায়ী চলছে গাড়ি। এরমধ্যে রাজপথ ধরে মাঝে মাঝে শ্রমিকদের টুকরো টুকরো মিছিল আসছে। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’- স্লোগানকে ধারন করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম সোনারগাঁওয়ে।
সোনারগাঁওয়ে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম হোটেল। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটি মধ্যম মানের হোটেল দেখে পছন্দ হয়নি মিজানের। হোটেলের কর্মচারীদের কাছেই খোঁজ পাওয়া গেলো ভালো (উন্নতমানের) একটি হোটেলের। রাস্তার ঠিক ওপাড়ে। ওভারব্রিজ পার হয়ে চললাম হোটেলের সন্ধানে। সামনে গিয়ে ভালো লাগলো হোটেলটি। সাইনবোর্ড দেখে পড়লাম হোটেল বনলতা। মিজান বলল, এর নাম তো কলাপাতা। বনলতা কোথায় পেলে? ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম, তা-ই তো! হোটেলের সুদৃশ্য গেট। গেট থেকেই উপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই বাহারি ডিজাইনে সাজানো হোটেল কলাপাতা।
হোটেল কলাপাতায় খাসি আর ভুনাখিচুরি খেয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো এসময় চোখে পড়লো আম পাড়ার কোটা। একটি লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁশ ফেড়েই চটি দিয়ে বেঁধে সুন্দর করে বানানো হয়েছে আম ধরে রাখার কুলুঙ্গি। প্রথমে আমরা বুঝতে না পেরে এর বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন, এগুলো দিয়ে আম পাড়া হয়।
সোনারগাঁও থেকে যাত্রা শুরু হলো মহামায়ার উদ্দেশ্যে। নামটি শোনামাত্রই মহামায়া যেন মহা মায়ার মতোই আমাদের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। পথে যেতে যেতে ভুট্টার চাষ, ধানের খেত, কৃষকের ব্যস্ততা দেখে ভালোই লাগছিলো। ময়নামতি, কুমিল্লা, ফেনী, সোনাগাজী পার হয়ে পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রামে। সুপ্রশস্ত সড়ক ধরে আগাতে আগাতে কেবলই মনে হচ্ছিলো আমাদের দেশে এতো সুন্দর সড়ক আমি এই প্রথম দেখলাম। কেননা এই মহাসড়ক ধরে বহুবছর পর আবার চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছি।
যেতে যেতে কতো বৈচিত্রপূর্ণ নামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। দেখলাম লালপুর ব্রিজ। যেখানে ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিলো পাকহানাদার বাহিনী। চোখে পড়লো কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার নামের দোকানগুলো। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে- সবগুলো মিষ্টির দোকানের নামই ‘মাতৃভাণ্ডার’। তাহলে আসল মাতৃভাণ্ডার কোনটি? ওয়ান ওয়ে সড়ক ধরে যাচ্ছি আর প্রকৃতির অপরূপ মহিমা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। কোথাও কোথাও এখনো কাজ চলছে সড়কের কিংবা রেলক্রসিংয়ের। কখনো চা খেতে নেমে পড়ছি কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটি চায়ের দোকানে। গাড়িতে উঠেই আবার হাসি-আনন্দ-গল্প শুরু। গান গেয়ে মাতিয়ে রাখছে মৃদুল।
চলবে-
এসইউ/জেআইএম