ঘুরে আসুন রাবণ রাজার দেশ
রাবণ রাজার লঙ্কাপুরীর বর্তমান নাম শ্রীলঙ্কা। রাজধানী কলম্বো। শ্রীলঙ্কার জনসাধারণ অদ্ভুতরকমের শান্ত। রাস্তাঘাট খুবই পরিষ্কার। পথেঘাটে মানুষ সুশৃঙ্খল। এতোটুকু একটি দ্বীপ রাজ্য অথচ কী সুন্দর ও পরিষ্কার- তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দেশটিতে ভ্রমণ করার মতো রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান, স্থাপনা এবং ঐতিহ্য। অল্পদিনের ভ্রমণের জন্য দেশটি আদর্শ স্থান।
ডাম্বুলা গুহামন্দির
এর অপর নাম ‘গোল্ডেন টেম্পলস ডাম্বুলের’। জায়গাটি কলম্বো থেকে ১৪৮ কিলোমিটার দূরে। ১৯৯১ সালে জায়গাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ক্যান্ডি থেকে ৭২ কিলোমিটার উত্তরে। শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগে এ জায়গাটি। সব লঙ্কার মধ্যে এই মন্দিরগুলো ভীষণ ভালোভাবে সংরক্ষিত। পাহাড়ের ১৬০ মিটার উপরে এই গুহামন্দিরের অবস্থান। আজ পর্যন্ত ৮০টি গুহামন্দির লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এখানকার সব মূর্তি ও দেয়ালে অঙ্কিত ছবি গৌতম বুদ্ধের জীবন এবং জীবনী অবলম্বনে। মোট ১৫৩টি বুদ্ধের মূর্তি, ৩টি শ্রীলঙ্কার রাজাদের এবং ৪টি ভাস্কর্য হিন্দু দেব-দেবীর। এসব ভাস্কর্য মোট ২১০০ বর্গমিটার জায়গা নিয়ে ছড়ানো।
অনুরাধাপুরা
পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত এ শহরটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজধানী ছিল। শহরটির উল্লেখযোগ্য হলো ডোগাবস। সেই যুগে এই ডোগাবসগুলো ইট দিয়ে তৈরি, অর্ধগোলাকার বা বৃত্তাকার। এর মধ্যে রূবানভিলিসিয়া উল্লেখযোগ্য। স্থাপন করা হয়েছিল দ্বিতীয় শতাব্দীতে, ব্যাস ৩০০ ফুট। জেটাওয়ানারামা ডোগবার ব্যাস ৩৭০ ফুট। থুপারামা ডোগবাটি গৌতম বুদ্ধের গলার হাড় বহন করে। বিখ্যাত বো-গাছ, যার তলায় স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন, সেটিও এই শহরে আছে। গাছটি ২২৫০ বছর আগে রোপণ করা হয়েছিল, ভারতবর্ষ থেকে এটিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর সব থেকে পুরাতন গাছ বলে এটিকে মানা হয়।
পোলোনারুয়া
এটি আর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এটি শ্রীলঙ্কার রাজধানী ছিল ১১ থেকে ১৩ শতাব্দী পর্যন্ত। লঙ্কাতিলকে, তিভাঙ্কা ও থুপারামা- এই তিনটি বৌদ্ধস্তূপগুলো জগদ্বিখ্যাত তাদের ফ্রেসকো ও বৌদ্ধ স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন হিসেবে। এগুলো পোলোনারুওয়া রাজত্বকালে শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন। রাণকোট বিহারা এবং কিরীবিহারা হলো সেই যুগে নির্মিত ও সংরক্ষিত দু’টি বিশাল বৌদ্ধস্তূপ। গল বিহার, একটি পাথরের মন্দির, যেখানে বোধিসত্ত্বকে চারটি রূপে পাওয়া যায়। এখানে রাজা পরাক্রমবাহুর অপূর্ব একটি পাথরের মূর্তি আছে। ভাতা-ডা-গে সেই সময়ের লঙ্কান স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই রাজধানীটি বাহির এবং অন্দর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। রাজপ্রাসাদ, সভাগৃহ ও অন্যান্য গৃহগুলো আর একটি দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।
সিগীরিয়া
এটি আর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এর অপর নাম ফোর্টরেস ইন দ্য স্কাই। এটিকে অনায়াসে পৃথিবীর একটি অত্যাশ্চর্য স্থান বলা যেতে পারে। এটিকে আবার সিংহ চাটানও বলা হয়। এই পাথরের চাটানটি ভূপৃষ্ঠের থেকে ৬০০ ফুট ওপরে। ভূপৃষ্ঠের থেকে ডুলিতে করে হাতে টানা দড়ির কপিকলের সাহায্যে রাজধানীবাসীদের ওপরে তোলা হতো। এর দেয়ালগুলো এতোই খাড়া যে সেই দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠা প্রায় দুঃসাধ্য। এখন পরিভ্রমণকারীদের জন্য স্থানে স্থানে ঝুলন্ত দড়ি ও লোহার সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ১৪২২ সিঁড়ি পেরিয়ে তবেই আকাশের রাজধানীতে পা রাখা যায়। ব্যাপারটি অল্পবিস্তর কঠিন ও কষ্টসাপেক্ষ। নিচের জাদুঘরে এই দ্রষ্টব্য স্থানটির মডেল রাখা আছে জনসাধারণের জন্য। সেইসময়ে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার সম্যক জ্ঞান ছিল। সেইভাবেই পাহাড়ের মাথায় বৃষ্টির জল ধরে রেখে সমস্ত রাজ্যবাসীকে ব্যবহারের জল সরবরাহ করার জ্ঞানও সেইসময়ে ছিল।
ক্যান্ডি
শ্রীলঙ্কার এই পর্বতকন্যাটি অপর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং পর্তুগীজ উপনিবেশের সময়ে এই শহরটি ছিল শেষ স্বাধীন দুর্গ সিংহলী রাজাদের। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে এই শহর ইংরেজরা কৌশল করে দখল নেয়। পৃথিবীর সমস্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই শহর বিশেষভাবে পূজিত। কারণ এই শহরের ‘দালাদা মালিগাওয়া’ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত আছে। এখানকার স্নান গৃহটি হ্রদের তীরে স্থাপিত। হ্রদের মধ্যের দ্বীপটিকে দুধ সাগর বলা হয়। গ্রীষ্মকালে রাজা-মহারাজারা এটাকে গ্রীষ্মাবাস হিসেবে ব্যবহার করতেন। বর্তমানে শহরটি সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত।
দালাদা মালীগাওয়া
চতুর্থ দশক, যে সময়ে গৌতম বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পর কলিঙ্গ রাজকন্যা বুদ্ধের একটি দাঁত চুলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আসেন এই শহরে এবং এই মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে বৌদ্ধদের মধ্যে সব থেকে পবিত্র পীঠস্থান এই মন্দির। প্রতিবছর এটিকে নিয়ে বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দলে-দলে আসেন এই শোভাযাত্রায় যোগ দিতে।
নুওয়ারা এলিয়া
এই শহরের অপর নাম লিটল। আবহাওয়া চমৎকার। শ্রীলঙ্কার শৈলাবাস এটি। চারিদিকে চা-বাগান, ঝোরা, ছোট-ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই শহর। বিলেতের বসন্তের ঠান্ডা থাকে এখানে সারাবছর।
সীতা আম্মান মন্দির ও অশোক বাটিকা
রাবণ সীতা হরণের পর তাঁকে বন্দি করে রেখেছিলেন এই অশোক কাননে। যে অশোক গাছটির তলায় বসে সীতা রামের ধ্যান করতেন, সেটি আজো সেখানেই আছে। হনুমান যখন রামের বার্তা নিয়ে সীতার কাছে গিয়েছিল অশোক বনে, যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হনুমান সীতাকে রামের অঙ্গুরীয় দিয়েছিলেন, সেই পাথরে তাঁর পায়ের ছাপ আজও আছে। যে ঝরনায় সীতা স্নান করতেন। সেটা আজো বইছে সেই জায়গা দিয়ে। দক্ষিণী স্থাপত্য অনুসরণ করে একটি মন্দির আছে এখানে।
সমুদ্রসৈকত, বেনটোটা
এখানে যাওয়ার পথে পড়বে তার্তল হ্যাচারি। তারপর বেনটোটা নদীতে নৌকা ভ্রমণ। ভালো লাগবে দু’টো জায়গাই।
গল
শ্রীলঙ্কার অন্যতম বন্দর শহর। বিগত ১০০ বছর এটিই ব্যবহার হতো। দক্ষিণে এটি একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর। এখানে ওলন্দাজ এবং পর্তুগীজদের তৈরি বিশাল দুর্গ আছে। যা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত। লোকের বিশ্বাস; এই শহরটি আরো প্রাচীন। ওল্ড টেস্টামেন্টের তারশিশ হলো এই শহর। এই বন্দরে রাজা সলোমন তাঁর বাণিজ্য জাহাজ পাঠাতেন। আর ‘জোনা’ ভগবানের কাছ থেকে পালিয়ে এই শহরে আত্মগোপন করেছিলেন। দুর্গটি পরে ইংরেজরাও ব্যবহার করেছে তাদের রাজত্বকালে।
এসইউ/পিআর