ভারত ভ্রমণের ইতিবৃত্ত : শেষ পর্ব
রিটায়ারিং রুমে রাত কাটিয়ে ২৬ মার্চ ভোর ৩টা ৪০ মিনিটে উদয়পুর-খাজুরাহো এক্সপ্রেস ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম আগ্রা শহরের উদ্দেশ্যে। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ট্রেন পৌঁছলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে। স্টেশন থেকে বের হয়ে টেম্পু নিয়ে চলে গেলাম হোটেল তাজ খেমায়। তাজমহলের পূর্ব গেট ঘেঁষেই ছিল হোটেল তাজ খেমার অবস্থান। উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের ট্যুরিজম বোর্ড পরিচালিত মনোরম পরিবেশের এ হোটেলটিতে আমাদের জন্য আগে থেকেই রুম বুকিং করে রেখেছিলেন মনোজ দা।
হোটেলের যাবতীয় কাজ সেরে নিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম আগ্রা ফোর্ট দর্শনে। ঘণ্টাখানেক ঘুরলাম ফোর্টে। এরপর মনোজ দা’র কথামতো সন্ধ্যায় ফোর্টের ভেতরেই পর্যটকদের জন্য আয়োজিত সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো দেখলাম। শো শেষ করে আমরা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নিয়ে আবারও হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। তবে রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক জ্যাম থাকায় মাঝপথে নেমে পড়লাম আমরা। হোটেলে না গিয়ে চলে গেলাম মেলায়। কিছু সময় মেলায় ঘুরে রাত ১১টায় ঢুকলাম হোটেলে।
২৭ মার্চ সকালে হোটেলের রুম ছেড়ে দিয়ে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম বহুল আকাঙ্ক্ষিত তাজমহল দেখতে। তাজমহলে ঘণ্টাদুয়েক কাটিয়ে দুপুরের খাবার শেষে টেম্পু নিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম আরেক দর্শনীয় স্থান ফতেহপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে। সোয়া একঘণ্টা পর পৌঁছলাম ফতেহপুর সিক্রিতে। এখানে রয়েছে আরেক অলি সেলিম চিশতির মাজারসহ মোঘল আমলের কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা ফতেহপুর সিক্রি থেকে আবার যাত্রা শুরু করলাম আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশন থেকে রাত সোয়া ৯টায় নিউ দিল্লি-শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনে ফের নতুন দিল্লির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা। রাত সাড়ে ১১টায় নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলো আমাদের ট্রেন। নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে আমাদের রাত্রিযাপনের জন্য মনোজ দা রিটায়ারিং রুম বুকিং করে রেখেছিলেন। রাতে ঘুমানোর আগে তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে একটা স্টোরি পাঠালাম অফিসে।
২৮ মার্চ বেরিয়ে পড়লাম দিল্লি দর্শনে। দিল্লি ট্যুরিজম ও ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের মাধ্যমে বাসে করে দিনব্যাপি দিল্লির ঐতিহাসিক স্থাপনা কুতুব মিনার, লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, রেড ফোর্ট, গান্ধী স্মৃতি, হুমায়ূন টম্ব ও রাজঘাটসহ আরও কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখলাম।
সন্ধ্যায় ট্যুরিজম বোর্ডের বাস আমাদের কথামতো আমাদেরকে ইন্ডিয়া গেটের সামনে নামিয়ে দিল। ঘণ্টাদেড়েক ইন্ডিয়া গেটের সামনে অবস্থান করে আমরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এরপর রাতের খাবার খেয়ে মেট্রোরেলে করে চলে গেলাম নতুন দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। রাত আড়াইটায় কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে জেট এয়ারওয়েজের আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফ্লাইটটি।
বিমানবন্দর থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে আমাদের হাতে অনেক সময় ছিল। ভাবলাম সময়টা নষ্ট না করে ইন্ডিয়া গেট নিয়ে একটা স্টোরি লিখি। ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম স্টোরি লিখতে। স্টোরিটা পরিপূর্ণ করার জন্য ইন্টারনেট ঘেটে ইন্ডিয়া গেট সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। স্টোরিটা লিখে অফিসে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভাইয়ের মেইলে পাঠিয়ে তাকে ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম।
এরইমধ্যে বিমানবন্দরে পরিচয় হলো এক বাঙালির সঙ্গে। কেশরচন্দ্র সিনহা নামের ওই ভদ্রলোকের বাড়ি শিলচরে। তিনিও আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাচ্ছেন একই ফ্লাইটে। কেশর দা’র সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলতে বলতে আমাদের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেল। আমাদের সবার চোখে সে কী ঘুম! কোনো রকমে বিমানে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের কারণে বিমান কখন টেক অফ করল আর কখনই বা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল সেটি যেন টেরই পেলাম না! তবে এর মাঝখানে বিমান থেকে সরবরাহ করা রাতের খাবার ঠিকই খেয়েছি সবাই।
অবশেষে ভোর সাড়ে ৪টায় কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলো আমাদের বহনকারী বিমান। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মনোজ দা’র কথামতো ট্যাক্সি নিয়ে আমরা চলে গেলাম মহাত্মা গান্ধী রোডের হোটেলিয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে। শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন লাগোয়া এ হোটেলে ভোর ৫টার কিছু সময় পর পৌঁছালাম আমরা। আমাদের জন্য আগে থেকেই রুম বুকিং করে রেখেছিলেন মনোজ দা। তবে বুকিং করে রাখা সত্ত্বেও ভোররাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের পাসপোর্ট এবং এই কাগজ সেই কাগজ দেখানোর জন্য বলছিলেন তখন খুব রাগ হচ্ছিল। যাই হোক- সব কাগজপত্র দেখিয়ে ফরম পূরণ করে আমরা রুমে ঢুকলাম। সবার ব্যাগগুলো রুমের এক পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। এরই মধ্যে হোটেল কর্তৃপক্ষের আরেক আচরণে ক্ষুব্ধ হলাম ভীষণ। ঘুমের মধ্যেই আমাদের পাসপোর্টের ফটোকপিতে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য হোটেলের এক লোক এলেন রুমে। কী আর করা, বিছানায় শুয়ে শুয়েই স্বাক্ষর করলাম।
২৯ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে এবং গোসল করে সবাই তৈরি হলাম ঘুরতে বের হওয়ার জন্য। হোটেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। কলকাতা শহরেও প্রচণ্ড গরম ছিল। গরমের মধ্যেই ঘোরাঘুরির ফাঁকে বাসার লোকজনের জন্য কিছু কেনাকাটা করলাম। এরইমধ্যে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। মনোজ দা ফোন করে বললেন, ‘ঘুরাঘুরি পরে, আগে ‘আহার’ রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিও’। শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনের পাশের ‘আহার’ রেস্টুরেন্টটিতে ভালো বাংলা খাবার পাওয়া যায়। খাবার খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে গিয়ে আমাদের কেনা জিনিসপত্রগুলো রেখে আবার বের হলাম ঐতিহাসিক হাওড়া ব্রিজ দেখতে।
হোটেলের সামনে থেকে লোকাল বাসে চড়ে গেলাম হাওড়া ব্রিজে। কিছুক্ষণ হাওড়া ব্রিজ ঘুরলাম, প্রখর রোদের কারণে বেশিক্ষণ ঘুরতে পারলাম না। এরইমধ্যে মনোজ দা বললেন গঙ্গা নদীতে লঞ্চ ভ্রমণ করতে। তিনজন ১৫ টাকার টিকিট নিয়ে লঞ্চে উঠলাম বাবুরঘাট যাবার উদ্দেশ্যে। অনেক বছর পর লঞ্চে উঠে মনে অন্যরকম অনুভূতি। ঠাণ্ডা বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল! লঞ্চ থেকে বাবুরঘাট নেমে সেখান থেকে চলে গেলাম কলকাতার ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের (আইপিএল) কারণে স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়দের অনুশীলন চলায় আমরা আর স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। এজন্য স্টেডিয়ামের বাইরে থেকেই পায়েল ভাই, পলাশ ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছবি তোলায়। এসময় মনোজ দা ফোন করে বললেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যেতে, দ্রুত না গেলে সন্ধ্যায় সেটি বন্ধ হয়ে যাবে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কলকাতার ঐতিহাসিক একটি স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান। ঘণ্টাখানেক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কাটিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম নিউ মার্কেটে। নিউ মার্কেট থেকে আবারও কেনাকাটা করলাম সবাই। কেনাকাটা শেষে রাত ১০টার দিকে হোটেলে ফিরে গেলাম। কলকাতায় থাকা আমার বন্ধু মৃণ্ময় গোলদার সকাল থেকে ফোন দিচ্ছিল তার বাসায় যেতে। কিন্তু দিনের বেলা ঘোরাঘুরির কারণে মৃণ্ময়ের বাসায় আর যাবার সময় পাইনি। রাতে মৃণ্ময় আবার ফোন করল যেন তার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করি। তাই পায়েল ভাইকে হোটেলে রেখে পলাশ ভাইকে নিয়ে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে চড়ে গেলাম নিউ ব্যারাকপুর রেলওয়ে স্টেশনে।
স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিল বন্ধু মৃণ্ময়। মৃণ্ময় খুব করে বলছিল যেন তার বাসায় যাই কিন্তু বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় আমি বাসায় যেতে চাইনি। এর ফলে স্টেশনেই কিছুক্ষণ মৃণ্ময়ের সঙ্গে আড্ডা দিলাম। আড্ডা শেষে আবারও ট্রেনে চড়ে রাত ১২টায় ফিরলাম শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনে। স্টেশন থেকে হেঁটে হোটেলে চলে এলাম। হঠাৎ মনে হলো মহিউদ্দিন ভাইয়ের অ্যাসাইনমেন্টের কথা। হোটেলের বিছানায় শুয়ে শুয়েই কলকাতায় বাংলাদেশি কোম্পানি ‘প্রাণ’র খাদ্যপণ্য নিয়ে স্টোরি লিখতে বসে পড়লাম। তবে অর্ধেক স্টোরি লিখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
৩০ মার্চ সকাল ৮টা ৩৫ মিনেটে কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্পাইস জেট বিমানে আগরতলায় যাবার ফ্লাইট আমাদের। তাই সকাল সকাল হোটেল ছেড়ে দিয়ে ৭টার মধ্যেই বিমানবন্দরে চলে গেলাম। বিমানবন্দরে গিয়ে স্পাইস জেট বিমানের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে সিকিউরিটি চেকিং শেষে বিমানের ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরইমধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে আবার বসলাম প্রাণের খাদ্যপণ্যের সেই স্টোরিটা শেষ করার জন্য। স্টোরি শেষ করে মহিউদ্দিন ভাইয়ের মেইলে পাঠিয়ে ভাইকে ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম।
সোয়া ৮টার দিকে বিমানে উঠে বসলাম আমরা। নির্ধারিত সময়েই বিমান ছেড়ে গেল আগরতলার উদ্দেশ্যে। পৌনে ১০টার দিকে আমাদের বিমান ল্যান্ড করল আগরতলা বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে টেম্পু নিয়ে আমরা গেলাম আগরতলা শহরের কামান চৌমুহনীতে। কামান চৌমুহনীতে ইউকো ব্যাংকের আগরতলা শাখায় গিয়ে মনোজ দা’র সঙ্গে দেখা করলাম। এরপর মনোজ দা আমাদেরকে আগরতলা চেকপোস্ট আসার জন্য একটি টেম্পুতে উঠিয়ে দিলেন। দুই দেশের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের যাবতীয় কাজ শেষে সাত দিনের ভ্রমণ শেষে যে যার বাড়িতে ফিরলাম। সাত দিনের এই ভ্রমণ আমাদের কাছে যতটা না ছিল আনন্দদায়ক তারচেয়েও বেশি ছিল স্মৃতিময়।
এসইউ/জেআইএম