স্মৃতির পাতায় মহেরা জমিদার বাড়ি
২০১৯ সালের নভেম্বর মাস। ঢাকায় তখনো শীত পড়েনি। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা উদাস হয়ে গেল। বহুদিন ধরে কোথাও বেরোনো হয় না। ঢাকার ব্যস্ত জীবন থেকে একটু দূরে শান্ত পরিবেশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। তাই হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ মহেরা জমিদার বাড়ি ঘুরে আসবো।
বের হয়ে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে নিরালা পরিবহনের বাসে উঠলাম, গন্তব্য টাঙ্গাইলের মির্জাপুর। বাস ছুটে চলছে, আর জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সেই পুরোনো দিনের কল্পনায় ডুব দিলাম। ইতিহাসের পাতা উল্টে মনে পড়লো, মহেরা জমিদার বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে স্পেনের করডোভার আদলে। এককালের রাজকীয় ঐশ্বর্যের ছোঁয়া এখনো যেন সেখানে টিকে আছে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর টাঙ্গাইলের নাটিয়াপাড়ায় বাস থামলো। সেখান থেকে ছোট্ট এক রিকশা ভ্রমণ শেষে মহেরা জমিদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম। আমার ছোট মামা চাকরি করেন টাঙ্গাইল সদরে। তাকে আগেই বলে রেখেছিলাম, আমি যাচ্ছি। আপনি মহেরা জমিদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান। তিনি যথাসময়ে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এরপর ৮০ টাকা করে দুজনে দুটি টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম জমিদার বাড়িতে। বিশাল এক দিঘির পাড় ঘেঁষে শীতল ছায়ায় দাঁড়ানো জমিদার বাড়িটি দেখেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। দিঘি হলেও নামফলকে দেখলাম এটি সাগর, ‘বিশাখা সাগর’। দিঘিটি যেন জমিদার বাড়ির রূপের প্রতিচ্ছবি।
বাড়ির প্রবেশদ্বারে বিশাল সুরম্য গেট। যেন প্রবেশ করলাম এক প্রাচীন রূপকথার রাজ্যে। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ল উঁচু ভবন আর ছিমছাম পুকুরঘেরা বাগান। সেই পুকুরগুলোর নামও বেশ রোমাঞ্চকর। পাসরা পুকুর আর রানী পুকুর। এগুলো যেন এক সময়ের জমিদার পরিবারের সুখ-দুঃখের সাক্ষী।
১৮৯০ সালে নির্মিত প্রধান ভবনের সামনে একটি ফোয়ারা দেখলাম। যার পানির শব্দে মন যেন আরও গভীর কল্পনার জগতে চলে যায়। চারদিকে সুসজ্জিত ফুলের বাগান আর ছোট ছোট কাঠামো—নায়েব সাহেবের ঘর, কাছারি ঘর এবং বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর লজের সমাহার। পুরো জায়গাটা প্রায় আট একরজুড়ে বিস্তৃত। বাড়ির পেছনের দিকে বিশাল আম বাগান, যা একসময় জমিদারদের বৈঠকের স্থান ছিল।
এখানে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, কত শত বছরের ইতিহাস, কত গল্প, কত স্মৃতি লুকিয়ে আছে এই জমিদার বাড়ির দেওয়ালে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই জমিদার বাড়ির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি বাহিনী এই জমিদার বাড়িতে আক্রমণ করেছিল, গ্রামবাসীর সঙ্গে জমিদারের কূলবধূরও প্রাণহানি ঘটে সেই নির্মম দিনগুলোতে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্থাপনাটিকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে গড়ে তোলা হয় এবং বর্তমানে এটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সেখান থেকে প্রথমেই ঢুকলাম চৌধুরী লজে। গোলাপি রঙের ভবনটি রোমান স্থাপত্যের ছোঁয়া নিয়ে নির্মিত। ভেতরের ঢেউ খেলানো ছাদ আর খোদাই করা নকশা দেখলে একটানে পুরোনো দিনের জমিদারি শান-শওকতের গল্প মনে পড়ে যায়। চৌধুরী লজের সামনের বাগানটিও অপূর্ব।
এরপর গেলাম মহারাজ লজে। বাইজেনটাইন স্থাপত্যের ভবনটি তার ছয়টি বিশাল কলামের জন্য বিখ্যাত। গোলাপি রঙের ভবনের সামনে বাঁকানো রেলিংওয়ালা সিঁড়ি আর ঝুলন্ত বারান্দা ভবনের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। ভবনটির কয়েকটি কক্ষে ঢুঁ মেরে দেখলাম, সামনে একটি বাগান আর পেছনে একটি টেনিস কোর্ট রয়েছে। বর্তমানে এখানে শুটিং স্পট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
সবশেষে পৌঁছালাম মহেরা জমিদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবন, আনন্দ লজে। নীল আর সাদা রঙে রাঙানো তিনতলা ভবনটির সামনে আটটি সুউচ্চ কলাম রয়েছে, যা ভবনটির সৌন্দর্যকে অসাধারণ করে তুলেছে। আনন্দ লজের সামনে একটি চমৎকার বাগান, যেখানে রয়েছে হরিণ, বাঘ আর বিভিন্ন পশু-পাখির ভাস্কর্য। পুরো পরিবেশটাই যেন জীবন্ত শিল্পকর্মের মতো।
বিকেলের দিকে গেলাম কালীচরণ লজে, যেটি ইংরেজ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। ইংরেজি ‘ইউ’ আকারের ভবনটি অন্য ভবনগুলোর থেকে আলাদা। বিকেলের মৃদু রোদের আলোয় ভবনের ভেতরে ছড়ানো আলোর ঝলকানি, যেন এক ভিন্ন সময়ে নিয়ে যায়।
শেষ বিকেলে বিশাখা সাগরের ধারে বসে রোদে রাঙানো জমিদার বাড়িটির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, ইতিহাস যেন নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ে সময়ে ছুঁয়ে যায় আমাদের হৃদয়, ফেলে যায় শিহরণ। এই একদিনের ভ্রমণ আমাকে ইতিহাসের ছোঁয়ায় নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দিয়ে গেল।
এরপর জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে এলাম টাঙ্গাইল রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে মামার সাথে খেলাম টাঙ্গাইলের বিখ্যাত চাপড়া পিঠা আর ঝাল বেগুন ভর্তা। খাবারের এতটাই স্বাদ যেন, এখনো মুখে লেগে আছে। এরপর ট্রেনে করে চলে এলাম ঢাকায়। আপনারা চাইলে একদিনে ঢাকা থেকে এসে জমিদার বাড়িটি ঘুরে যেতে পারেন।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী অথবা কল্যাণপুর থেকে প্রায় সারাদিনই টাঙ্গাইলের বাস চলাচল করে। এসব বাসে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ভাড়ায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছা যায় টাঙ্গাইলের নটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে সিএনজি, অটোরিকশায় সরাসরি আসা যায় জমিদার বাড়িতে।
চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনের শিডিউল দেখে ট্রেনে আসতে পারেন টাঙ্গাইলের মহেরা রেলওয়ে স্টেশনে। ট্রেনে এলে খানিকটা সুবিধা পাবেন। এখান থেকে খুব সহজেই জমিদার বাড়িতে আসা যায়। এ ছাড়া ট্রেনেই আবার ঢাকা ফিরে যাওয়া যায়।
যা খাবেন
টাঙ্গাইলের চমচম সব মিষ্টির রাজা। শুধু বাংলাদেশেই নয়—এ মিষ্টি ভারত, পাকিস্তানসহ সমগ্র ভারত উপমহাদেশেই বিখ্যাত। তাই সুযোগ থাকলে কোনো ভাবেই এর স্বাদ নিতে ভুলবেন না। এ ছাড়া চাপড়া পিঠা আর বেগুন ভর্তা তো আছেই।
এসইউ/জেআইএম