কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব-৬
সরোদের সুরে বিরহের গান
সাইখ আল তমাল
এ রাতের থাকার জায়গা ঠিক হলো অনিকদার দমদমের ফ্ল্যাটে। পুরো ফ্ল্যাটে আমরা দুজন। ডাফ লেন থেকে ট্যাক্সিতে করে রওনা দিলাম। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় ভুল করে অনিকদা তার সরোদটা গাড়িতেই ফেলে গেলেন। বাসায় আসার পর দুজনেরই খেয়াল হলো। অগত্যা ট্যাক্সি ড্রাইভারের পেছনে ছুটতে হলো সরোদের জন্য। এর জন্য বাড়তি খরচ করতে হলো তাকে। বেচারা ড্রাইভার নতুন যাত্রী তুলেছিল। সেটা বাতিল করতে হয়েছে, তাই জরিমানা। তবে জিনিসটা পাওয়া গেল এই যা স্বস্তির। এতক্ষণ তার দুশ্চিন্তা দেখে মুষড়ে পড়েছিলাম। অবশেষে স্বস্তি। বাসায় আসার পর শুরু হলো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। ততক্ষণে রাত গভীর হয়েছে। ঢাকার মতো নিশাচর নয় কলকাতা। মানুষজন তেমন একটা বের হয় না রাতে। কথায় কথায় প্রসঙ্গ এলো, অনিকদার সরোদ আমি কখনো শুনিনি। তিনি শোনাতে আগ্রহ দেখালেন। আমিও সুযোগ হাতছাড়া করতে পারলাম না। বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।
অনিকদা সরোদ ঠিকঠাক করছেন। আমি বসে আছি উন্মুখ শ্রোতা হয়ে। সরোদে সুর উঠবে। বাইরে বৃষ্টি। সরোদ বাজানো শুরু হলো। মুহূর্তে পরিবেশ মোহনীয় সুরে ছেয়ে গেল। গায়ে এসে লাগলো বর্ষার শীতলতা, সুরটা এমনই। মনোযোগ দিয়ে সরোদ বাজাচ্ছেন অনিকদা। আগে কখনো শুনিনি এভাবে। মাতাল সুরে মত্ত। স্বর্গীয় অনুভূতি বললে বোধ করি বিধাতা ক্ষমা করবেন। জীবনে পাপের গড়া পূর্ণ হতে হতে উপচে পড়ছে যেন। আরেকটু পাপ তিনি ক্ষমা করবেন নয় কি! এই সুরের নেশা আমি ছাড়ব কেমন করে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি। অনন্তকাল এভাবে কেটে যাক। সরোদের সুধা পান যে একবার করে, সে কি আর মাতাল না হয়ে পারে! শত আক্ষেপের মাঝে এতটুকু প্রশান্তি এক জীবনে চাওয়াটা নিশ্চয়ই স্পর্ধা নয়।
ফিরে গেলাম সেই বিকেলে। কমলা রোদ। রমনার শিরিষের ছায়া। পাতার ফাঁক গলে কিরণ গায়ে এসে পড়ছে। লুকানো আবেগ গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। মাঝখানে অদৃশ্য দেওয়াল। আটকে আছে মহাকাল। দেওয়াল ভাঙার আপ্রাণ চেষ্টা করেও লাভ হলো না। অভিমান জমে গেছে পাথর হয়ে। নিদ্রাময় আঁখিতে দোল খাচ্ছে ঝরা কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম পাপড়ি। আছড়ে পড়ছে উত্তাল সমুদ্রের ক্ষুব্ধ ঢেউ। সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়ার জেদ চেপেছে। অনিকদা বাজিয়ে চলেছে। এই সুর আফিমের নেশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
রাত অনেক হয়েছে। এখন ঘুমিয়ে নিতে হবে। নয়তো পরদিনের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। অনলাইনে আমার জন্য অনিকদা আর শিল্পীদি গেস্ট হাউজ ঠিক করে রেখেছে। পরের দুই রাত ওটাই আমার ঠিকানা। একাকিত্ব উপভোগ করছি বেশ। ক্লান্তি ভুলে গেছি একদিন। এগারোটার দিকে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য অপ্রতীম মজুমদার মহাশয়ের বাড়ি। ওস্তাদ মানুষ অপ্রতীমদা। অনিকদার গুরু। অনিকদার সরোদ বাজানো শোনার পর থেকেই মনস্থির করলাম দাদার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করেই যাই। অনিকদা মনে হয় আমার চাওয়া পাওয়া বড্ড বেশিই বুঝে গেছেন। সে না থাকলে এত গভীর থেকে আমার কলকাতা দেখা হতো না। এর জন্য তাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। সব কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ বলে প্রকাশ করা যায় না। কিছু অনুভূতি জন্মান্তর ধরে থেকে যায় মানুষের মনে। অনিকদাকে লাখো প্রণাম জানাই।
দমদম স্টেশনে পৌঁছালাম। স্টেশনে নেমে আলুর দম আর কচুরি খেয়ে নিলাম দুজনে। এটাই আপাতত আমাদের সকালের নাস্তা। এখানকার কচুরি খাওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল। কিন্তু অনিকদাকে বলা হয়নি। না বলতেও সে ঠিকই ইচ্ছেটা পূরণ করে দিয়েছে। আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্ত হতে দেয়নি। এমন লোকের আতিথেয়তা পাওয়া কম সৌভাগ্যের নয়।
খাওয়া শেষ হতেই ট্রেন থামলো স্টেশনে। তাড়াহুড়ো না করে ছেড়ে দিলাম ট্রেনটা। পরের ট্রেনে যাব স্বস্তিরে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ক্ষতি নেই। সব দায়ভার অনিকদার ঘাড়ে দিয়ে এবার বিনা টিকিটেই ট্রেনে চড়লাম। ভাগ্যগুণে কেউ টিকিট চেক করেনি। তাই পথে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। গুরু অপ্রতীম মজুমদারের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাত থেকেই আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। ওখানে পৌঁছাতে প্রায় ১টার মতো বেজে গেছে। জায়গাটা অনেকটা আমাদের পুরান ঢাকার মতো তবে এতটা গিঞ্জি না। বেশ লেগেছে, ঠিক যেন সত্তর কিংবা আশির দশকের বাংলা সিনেমায় দেখানো শহরতলীর মতো। দোতলা বাড়িই বেশি। কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে ছাদে।
বাড়ির সামনে আসতেই একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দিলো। সম্ভবত তিনি অপ্রতীমদার বাবা হবেন। দাদা আসলেন, তিনি তখন বাড়ির কাজে একটু ব্যস্ত। প্রণাম জানালাম তাকে। অনিকদা আগে থেকে বলে রেখেছে সাংবাদিক বন্ধু আসবে। আমাদের ওপরে যাওয়ার কথা বললেন। দুজনে চললাম ওপরে, মাঝখানে অনিকদা তার সরোদ একটা কামরায় রেখে গেল। আমার কাঁধব্যাগটাও রাখলাম পাশে। এই ঘরটাতেই সরোদের তালিম নেয় অনিকদা। জিনিসপত্র রেখে ছাদে গেলাম। ছাদ থেকে পুরো এলাকাটা চমৎকার দেখা যায়। সবগুলো বাড়িই প্রায় একই ধাঁচের। কেমন যেন একটা ভাব আছে এখানটায়।
ততক্ষণে অপ্রতীমদা চলে এলেন। এখানকার সবাই খুবই বন্ধুসুলভ। দারুণ গল্প জুড়ে দিলেন দাদা। শিল্পী সত্তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অন্যরকম ব্যাপার আছে। জীবনটাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা যায়। শিকড়ের আবহ চলে আসে। সংস্কৃতির যে প্রবাহমানতা সেটি উপলব্ধি করা যায়। গল্পে গল্পে হুমায়ূন আহমেদ চলে আসলেন। কলকাতায় যাদের বাড়িতেই গিয়েছি, সবার কাছেই হুমায়ূন আহমেদের কোনো না কোনো বই ছিল। অপ্রতীম মজুমদার তো বলেই বসলেন, ‘যেদিন হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলেন, মনে হলো যেন আমার বাবা মারা গেলেন। আমি তো দুঃখ পেলাম এই ভেবে এখন আমরা পড়ব কী? ওনি তো চলেই গেলেন এখন তাহলে লিখবে কে? লিখার মতো কেউ তো আর রইলো না।’ কথাটা মনের মধ্যে খুব করে গেঁথে গেল।
কারো প্রতি প্রেম মানুষকে কতটা অসহায় করে দেয় আর সেই মানুষটার অসহায়ত্বের সুযোগ যখন অন্য কেউ নেয় তখন আর কিছু করার থাকে না। বুকের ভেতর যে কয়লার আগুন জ্বলে আর তাতে সুবিধাভোগীরা যেভাবে হাপর পিটিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফায়দা লুটে নেয় তার থেকে করুণ আর কিছু হতে পারে না। দুনিয়া ততক্ষণই পাষাণ মনে হবে; যতক্ষণ না কারো ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। মানুষের প্রতি একবার প্রেম চলে আসলে তা দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেবে না। তবুও মানুষ মানুষের প্রেমে পড়ে। জীবনের প্রতি মায়া কীভাবে কেউ ত্যাগ করতে পারে ভাবতেও অবাক লাগতো। এখন আর লাগে না।
হাওয়া বদল করতে কলকাতা এলাম, এখন অনেকটাই নির্ভার। আড্ডার পাট চুকিয়ে সেই ঘরটায় গেলাম। অনিকদাকে কিছু সুর ধরিয়ে দিলেন অপ্রতীম মজুমদার। আজকের মতো এখানেই শেষ। কথা ছিল বিকেলের মধ্যে সবার ব্যস্ততা শেষ করা গেলে গঙ্গা ঘাটের দিকে আড্ডা দেব। কিন্তু তা আর হয়নি। বেরিয়ে পড়লাম রবীন্দ্র ভারতীর উদ্দেশ্যে। এখানকার প্রতিটা জায়গায় সময় নিয়ে ঘুরলাম আমরা। গোলাকার একটি ভবন মাঠের শেষ প্রান্তে। এখানে নৃত্যকলা, সংগীত, নাট্যকলা ইত্যাদি বিভাগ। জায়গাটা বেশ সুন্দর। চারদিকে সুরের মোহ। কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছে, কেউ বাঁশি, কেউ তবলা বা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র।
আগের পর্ব পড়ুন
- ট্রেনে চেপে চলে এলাম কলকাতা
- হাবড়া শহরের অচেনা অতিথি
- ডাফ লেনের শতবর্ষী বাড়ি
- ১৭৫ বছরের বেথুন কলেজিয়েট স্কুল
- বিপ্লবী প্রীতিলতার বাঁশি
এসইউ/জেআইএম