ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব-৪

১৭৫ বছরের বেথুন কলেজিয়েট স্কুল

ভ্রমণ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:০১ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাইখ আল তমাল

বেথুন স্কুল নিয়ে পড়েছি অনেকবারই। কখনো স্বচক্ষে দেখা হবে ভাবিনি। অপ্রত্যাশিতভাবেই দেখা হয়ে গেল। অনিকদা সকাল থেকেই বলছিল, তোমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবো; যেখানে আমিই প্রথমবার যাচ্ছি। কলকাতায় বেড়ে ওঠা অনিকদারও অদেখা! এ জিনিস তো কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। আগ্রহ ক্রমশই জমাট বাঁধা শুরু করেছে। কী আছে আমি দেখতে চাই। চরম আগ্রহ নিয়ে বেরিয়েছি। পথে পুরোনো কলকাতার রহস্যময় রূপ দেখে বারবার আটকে গেছি। অদৃশ্য সম্মোহনী শক্তির ফাঁদে পড়েছি বারবার। চোখে ক্লান্তি নেই। শুধু কৌতূহল আর বিস্ময়। ব্রিটিশদের রাজত্বের ছাপ স্পষ্ট। মনে হয় এখনো ব্রিটিশ ভারতেই আছি। গলিগুলো পুরোনো হলেও বেশ গোছানো, পরিষ্কার। পুরো কলকাতাই মনে হয় এমন শান্ত। কোলাহল নেই, অতিরিক্ত ভিড় নেই। বিশাল চওড়া রাস্তা। কেউ অযথা হর্ন বাজিয়ে বিরক্ত করছে না। হাঁটার পথগুলোও বেশ চওড়া। কিছু স্ট্রিট ফুডের দোকান আছে। তবে তা পথচারীদের চলাচলে খুব একটা বিঘ্ন ঘটে না। পাকা রাস্তাগুলোও বেশ মজবুত মনে হয়েছে। সহজেই পিচ উঠে যাবে না। রাস্তার মাঝখানে বয়ে গেছে পরিত্যক্ত ট্রাম লাইন। এখন আর ট্রামের চল নেই বললেই চলে।

কলকাতায় ট্রামের বয়স প্রায় দেড়শ বছর। শহরজুড়ে সাতটি ট্রাম লাইন ছিল। প্রথম ট্রাম আসে ১৮৭৩ সালে। তবে যাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যায় কয়েক বছরের জন্য। ১৮৮০ সাল থেকে আবার চলা শুরু হয় কলকাতা ট্রামের। শুরুতে ঘোড়া টানা হলেও আধুনিককালে তাতে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ। কিন্তু অত্যাধুনিক মেট্রোরেলের কারণে ট্রাম প্রায় বন্ধ। সঙ্গে হাল আমলের ট্যাক্সির জন্য রাইড শেয়ারিং বাহন তো আছেই। এত সবের ভিড়ে ট্রাম দেড়শ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তাই অনেক। ট্রামে চড়ার ইচ্ছা আমার ছিল, কিন্তু ভাগ্যে ছিল না। কলকাতায় গণপরিবহন বলতে শুধু ট্রেন আর মেট্রোতে চড়েছি, বাসেও চড়িনি। সবগুলোই পুরোনো আমলের বাস। ঢাকার রিকশার মতো কলকাতায় বাস পেইন্টিং হয়। স্থানীয়রা ভিন্ন নাম দিয়ে থাকতে পারে। আমি নাম দিয়েছি বাস পেইন্টিং। তবে এই নাম কাউকে মানার জন্য বলব না। সবারই স্বাধীনতা থাকা উচিত।

বেথুন স্কুলের সদর ফটকে এসে দাঁড়িয়েছি। শিল্পীদির আসার কথা এখানে। যতটুকু মনে পড়ে, কখনো গার্লস স্কুলের ফটকে দাঁড়াইনি। কলকাতা এসে প্রথমবার দাঁড়ালাম। কিন্তু মনের মধ্যে কোনো অনুভূতি জাগাতে পারলাম না। স্কুলের মেয়েরা নেই। কারণ আমি যেদিন যাই, সেদিন স্কুলে পঠন-পাঠন বন্ধ ছিল সম্ভবত। কিন্তু শিক্ষকরা ছিলেন, ভাগ্যক্রমে তাদের পেয়েছি। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর শিল্পীদি আসলেন। মিষ্টি মতন দেখতে শিল্পীদি হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন। মনে হলো তার সঙ্গে আমার দেখা হয় রোজ। কলকাতার মেয়ে। অনিকদা বলেছিল এ কথা। একটা জিনিস খুব মন দিয়ে খেয়াল করেছি। কলকাতার মানুষ অতিথিদের এমনভাবে গ্রহণ করে, মনেই হয়নি আমি এখানে প্রথমবার! মানুষকে আপন করে নিতে এর থেকে বেশি কিছু লাগে না। মিষ্টি কথায় কাছে টানা যায়। কলকাতা আমাকে টেনেছে, মায়ায় বেঁধেছে। শিল্পীদি বেথুন স্কুলের প্রাক্তনী। এখানে তার একটা প্রভাব রয়েছে বটে। অনিকদা আর আমাকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ১৭৫ বছর চলছে স্কুলটার।

বাংলার নারী শিক্ষা আর অগ্রগতির সঙ্গে বেথুন স্কুলের নাম জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। ১৮০০ সালের দিকে যখন নারী অগ্রগতির প্রদীপের সলতেটা টিম টিম করে জ্বলা শুরু হয়; তখন এতে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে বেথুন স্কুল। তৎকালীন বঙ্গ সমাজে অন্তপুর ছেড়ে নারীদের বের হওয়া মানেই জাতপাতের ওপর কালিমা লেপন করার মতো ভাবা হতো। মেয়েদের জন্য স্কুল তো দূরের কথা, মেয়েরা স্কুলে গিয়ে শিক্ষা লাভ করবে, তা ভাবাই ছিল বিরাট কিছু। কলকাতার মতো বিরাট শহরে মেয়েদের জন্য স্কুল নেই, আর নারী শিক্ষার দুরবস্থা দেখে বেথুন সাহেবের মনে দাগ কেটেছিল। তিনি হাল ধরেছিলেন বাংলার মেয়েদের শিক্ষিত করার। বেথুন কলেজের ভেতরে একটা লেখা দেখে তার অবদান সম্পর্কে সুন্দর ধারণা হয়ে গেল। লেখাটি ছিল-
“বীটন কী দেবদূত? তাঁর বাঁশির ধ্বনিতে
ঘাঘরা নোলক পরা মেয়েদের ঝাঁক
এল প্রাসাদ কুটির থেকে
এল ঘরের আগল খুলে
থামেনি এখনও বাঁশি।”

স্কুলে ঢোকার পর শিল্পীদি নিয়ে গেলেন ভেতরে শিক্ষকদের কামরার সামনে। দিদি আগেই কথা বলে রেখেছিলেন। আমরা যাওয়ার পর সবাই এলেন আন্তরিকতা নিয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সহশিক্ষিকা সংহিতা চক্রবর্তী দিদি আমাদের পুরো স্কুলটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন আর খুঁটিনাটি ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তিনি বেশ শুদ্ধ একজন মানুষ। বাংলাটা তিনি ধারণ করেন। ঢাকা থেকে এসেছি শুনে যেন ভীষণ ভালো লাগলো তার। বাংলার মানুষ বলে কথা। তখনকার সময়টায় পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছিলেন আমাদের রত্ন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সংহিতা চক্রবর্তী তার খুবই ভক্ত। শান্তিনিকেতনে বন্যা আপার সঙ্গে তার পরিচয়ের গল্পটাও শোনালেন। আমাদের অদিতি মহসিন আপার কথাও বললেন তিনি। ভাষা আমাদের দুই বাংলাকে যেভাবে এক সুতায় গেঁথে রেখেছে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পেলাম। সংহিতা দিদির সঙ্গে পরিচয়টা না হলে আমার পরিচয়, আমার শেকড়ের অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত। ভাষার জন্য আমাদের যে ত্যাগ তা তো আর কোনো জাতির ইতিহাসে নেই। বাংলার প্রতি মমত্ববোধ কতটা গভীর, কতটা সুনিপুণ হওয়া চাই তা যেন নতুন করে শিখলাম। সংহিতাদি বললেন, ‘দেখো, যারা একসময় আমাদের ওপর জোর করে তাদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। আজ তারাই আমাদের ভাষা দিবস পালন করছে। এর থেকে উচিত জবাব আর অপমান কী হতে পারে?’ কথাটা শুনে আমার গায়ে শিহরণ জেগে উঠল। ভাষাটাকে ভালোবাসতে হবে আরও। আজকাল বাংলা ভাষা নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের মধ্যে কেমন যেন নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে বলে আমার মনে হয়। এক শ্রেণি তো বাংলাই বলতে পারে না ঠিকমতো। তারা কথা বলতে গেলে না পুরো ইংরেজি বলে না বাংলা। ভয়ংকর জগাখিচুড়ির মতো শোনায় কথাগুলো। সংহিতাদি আমাদের গল্প শোনাচ্ছেন আর আমি মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে তার কথা শুনছি। তার মুখে গল্প শুনতে বেশ মধুর লাগছে। চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলেন তিনি। মুগ্ধ না হয়ে থাকার উপায় নেই।

১৭৫ বছরের বেথুন কলেজিয়েট স্কুল

বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা যখন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের মাথায় এলো; তখন কথাটি তিনি তৎকালীন বঙ্গ সমাজের প্রভাবশালী রামগোপাল ঘোষকে জানালেন। প্রস্তাবে রামগোপাল অত্যন্ত খুশি হলেও পড়ে গেলেন মহা চিন্তায়। মেয়েদের জন্য স্কুল! সমাজের রক্তচক্ষুর বাইরে গিয়ে কতটা সফল তারা হতে পারবেন কিংবা সমাজ তো সহযোগিতা করবেই না, ধরে নেওয়াটা অমূলক কিছু নয়। জাত-ধর্মের দেওয়াল তুলে কার বাড়ির মেয়েদেরই বা লোকে একসঙ্গে পড়ালেখা শিখতে পাঠাবে। প্রস্তাবটি ঘোষ বাবুর মনের চিন্তা যেন বাড়িয়ে তুলল।

এই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বিশেষ সভার আয়োজন করলেন রামগোপাল বাবু। সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সমাজ পরিবর্তনপন্থী ও বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম ব্যক্তি রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মদন মোহন তর্কালঙ্কারও ছিলেন সভাতে। প্রস্তাব শোনা মাত্রই সায় দেন দক্ষিণারঞ্জন। মেয়েদের স্কুলের জন্য নিজের বাড়ি, লাইব্রেরি সব ছেড়ে দিলেন তিনি। আজকের বেথুন স্কুলের যে ভবনটি রয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে দক্ষিণারঞ্জনের বাড়ির উঠান থেকেই শুরু হয়েছিল বেথুন স্কুলের যাত্রা। অশোক গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে বাংলার নারী সমাজের ত্যাগের যে বার্তা বেথুন সাহেব দিয়ে গেলেন, তা আজও শাখা প্রশাখা মেলে যাচ্ছে।

অশোক গাছকে বেুথন সাহেব গ্রহণ করেছেন বাঙালি মেয়েদের ত্যাগের প্রতীক হিসেবে। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে সনাতনী নারীরা অশোকষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। পরিবার ও সন্তানের মঙ্গল কামনায় সারাদিন উপবাস থেকে পালন করা হয় এই ব্রত। ব্রত পালনের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন হয় ছয়টি অশোক ফুলের কুঁড়ি, মুগকলাই ও দই বা কাঁঠালি কলা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ষষ্ঠী পূজার পর দই বা কাঁঠালি কলার মধ্যে ফুলের কুঁড়িগুলি রেখে দাঁতে না লাগিয়ে গিলে খাওয়া হয়। এরপর মুগকলাই খেয়ে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করতে হয়। অশোক ব্রত পালনের একটি লোককথা প্রচলিত আছে। গল্পটা অনেকটা এরকম, অশোক গাছে ঘেরা এক তপোবনে ছিল এক মুনির বাস। একদিন সকালে পুজোর ফুল তোলার সময় মুনি দেখলেন, একটা অশোক গাছের নিচে সুন্দর এক সদ্যোজাত মেয়ে কাঁদছে। মুনি তাকে আশ্রমে নিয়ে গেলেন। পরে ধ্যান করে জানতে পারলেন কোনো এক শাপের ফলে হরিণরূপিণী এক স্ত্রীলোক এই মেয়েটিকে প্রসব করেছে। মুনি মেয়েটিকে খুব যত্নে লালন-পালন করতে লাগলেন। হরিণীও রোজ একবার করে এসে মেয়েটিকে দুধ খাইয়ে যেতে লাগল। অশোক গাছের গোড়ায় তাকে পাওয়া গিয়েছিল বলে মুনি মেয়েটির নাম রাখলেন অশোকা। এভাবে মেয়েটি ক্রমে বেশ বড় হয়ে উঠল। একসময় বিয়ের বয়স হলো তার।

ভাগ্যক্রমে মুনি এক রাজপুত্রের সাক্ষাৎ পেলেন। মুনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এখানে এসেছো কেন?’ রাজপুত্র বলল, ‘আমি মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলাম। কাল রাত্রে খুব ঝড়ের কারণে ফিরতে পারিনি, আপনার কুটিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম।’ আবার কোনো স্থানে বর্ণনায় পাওয়া যায়, রাজপুত্র জলের তেষ্টায় আশ্রমে এসেছিলেন। তখন মেয়েটিকে দেখে তার ভালো লেগে যায়। এভাবেই রাজপুত্রের সঙ্গে অশোকার বিয়ে হয়। অশোকাকে বিদায় দেওয়ার সময় মুনি তাকে অশোক ফুলের বীজ দিয়ে বললেন, যাওয়ার পথে যেন বীজগুলো সে ছড়াতে ছড়াতে যায়। তাহলে রাজবাড়ি পর্যন্ত অশোকগাছের সারি হয়ে যাবে। কখনো বিপদে পড়লে সে যেন অশোক গাছের সারি ধরে আশ্রমে আসতে পারে। আর অশোক ফুলগুলো শুকিয়ে রেখে দিয়ে চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠীর দিনে ওইগুলো খাওয়ার উপদেশ দেন ওই মুনি। এর ফলে নাকি তার জীবনে কখনো শোক আসবে না।

অশোকা মুনির কথামতো সব পালন করলো। তার ঘরে একসময় ছয় ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হলো। আরও কিছুকাল পরে চৈত্রমাসে অশোক ষষ্ঠীর দিন অশোকা বৌমাদের বললেন, ‘আজ অশোকষষ্ঠী, আমি আজ অন্ন গ্রহণ করব না।’ এই কথা শুনে বৌমারা মুগকলাই সেদ্ধ করে অশোকাকে খেতে দিলেন। নিয়ম মেনে ষষ্ঠীপূজা করে খেয়ে অশোকা শুয়ে পড়লেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন সবাই মারা গেছে। এই দৃশ্য দেখে অশোক গাছের সারি ধরে সে মুনির আশ্রমে গিয়ে সব খুলে বললো।

১৭৫ বছরের বেথুন কলেজিয়েট স্কুল

মুনি সব শুনে অশোকাকে বলেন, তুমি যে মুগকলাই সেদ্ধ খেয়েছ, তার মধ্যে একটা ধান ছিল, সেই ধান সেদ্ধ হয়ে ভাত হয়েছে। তা খেয়েই এই বিপত্তি। তোমাকে মন্ত্রপূত জল দিচ্ছি। এই জল ছিটিয়ে দিলে সবাই আবার বেঁচে উঠবে। অশোকা বাড়ি ফিরে এসে জল ছিটিয়ে দিতে সবাই বেঁচে ওঠে। আশ্চর্য এই ঘটনা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মহিমা শুনে সবাই অশোকষষ্ঠী পালন করতে শুরু করল। রাজাও সমস্ত রাজ্যে এই ব্রত পালন করতে আদেশ দিলেন। সেই থেকে রাজ্যজুড়ে ‘অশোকষষ্ঠী’ পূজোর প্রচার হলো।

ঘটনাটি পৌরাণিক কাহিনি মাত্র। তবে মেয়েদের ব্রত পালন সত্য। নারী শিক্ষার প্রতীক হিসেবে অশোক গাছকে বেছে নিয়ে বেথুন সাহেব ৭ মে, ১৮৪৯ সালে বলেছিলেন, ‘You have seen possession of this land symbolically given, by delivering to us of a young Ashoka tree, ‘the tree of glibness’. It is commended for this day’s ceremony not only by the gracefulness of its foliage and the surpassing beauty of its flowers. But also because it is held in special honour among Hindu women. I propose therefore, henceforth that the Ashoka tree be made the symbol of female education in India.’

সেদিনের সভার পর নানা বাধা পেরিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় বেথুন স্কুল। পরে তা বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে রূপান্তরিত হয়। আঠারো শতকের শুরুতে বাংলার নারী শিক্ষা নিয়ে যে হাওয়া বইতে শুরু করেছিল তাতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় বিভেদ এতটাই ছিল যে অন্তপুরবাসী অন্তপুর ছেড়ে যে বাইরে আসবে শিক্ষার জন্য তা কল্পনা করাও পাপ। সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়েরা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তো। তারা কেন বাইরে বেরিয়ে পড়াশোনা শিখতে আসবে।

কলকাতায় মেয়েদের স্কুল হবে শুনে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বললেন, সুকিয়া স্ট্রীটে আমার বৈঠকখানা আছে। এক পয়সা ভাড়া লাগবে না, এই বাড়িতেই শুরু হোক স্কুলের পাঠদান। সেই থেকেই শুরু। ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ নামে যাত্রা হয় শুরুতে। ছাত্রী সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ জন। তখনকার দিনে ঠাকুর বাড়ি কলকাতাজুড়ে যে আলো ছড়াচ্ছিল তাতে মনে হতে পারে হয়তো এ বাড়ির মেয়েরাই ছিলেন শুরুর দিকের ছাত্রী। তবে বাস্তবে এমনটা ঘটতে দেয়নি উদারপন্থী ঠাকুরবাড়ি। সংস্কৃতিমনস্ক ও নারী শিক্ষায় আগ্রহী হলেও এ ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ি ছিল সনাতনধর্মী। কিন্তু বেথুন স্কুল ও নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে ঠাকুরবাড়ি দুঃসময়ে হাল ধরেছিল ঠিকই।

প্রথম ছাত্রীর গৌরব অর্জন করে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুই মেয়ে কুন্দমালা আর ভুবনমালা। তাদের নিয়েই তিনি লিখেছিলেন—
‘পাখী সব করে রব, রাতি পোহাইল
কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।’
কিন্তু তখনকার দিনেও মেয়েদের বাইরে এসে পড়তে আসার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, বাধা এসেছে। এর নেতিবাচক ফলও দেখা গেছে। অনেকে উৎসাহ দেখিয়ে পরে পিছিয়ে যায়। তবে সব ছাপিয়ে আলোচনায় ছিল কলকাতায় বিদেশি সাহেবের স্বপ্নের স্কুল। তৎকালীন সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। সমালোচনা হয়েছে। বর্তমানে সময়ে এসে যখন আলোচনায় আসে নারী-পুরষ সহশিক্ষা নিয়ে। এ সময়েও যখন পুরুষের কামভাব জাগ্রত করার জন্য নারী শিক্ষার্থীদের কিংবা তাদের চলাফেরা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে তৎকালীন সময়ের চিত্রটা তাহলে একবার কল্পনা করলে হতাশায় ডুবে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।

‘বাপ রে বাপ। মেয়েছেলেকে লেখাপড়া শেখালে আর কী রক্ষে আছে? এক ‘আন’ শিখাইয়াই রক্ষে নেই। চাল আন, ডাল আন, কাপড় আন করিয়াই অস্থির করে, অন্য অক্ষরগুলো শেখালে কী আর রক্ষে থাকবে?’—কথাটি তখনকার সমাজে নাকি প্রচলিত ছিল বেশ। শুরুতে ২১ জন ছাত্রী থাকলেও ক্রমে তা বাড়ার বদলে কমতে কমতে সাত জনে দাঁড়ায়। তখনই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ডাকা হলো। সমাজের সব শ্রেণিকে এক ছাদের তলায় আনার জন্য নেওয়া হয় এই উদ্যোগ। প্রথমেই বেথুন স্কুলে পড়তে আসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সৌদামিনী দেবী। এই উদ্যোগ শুরুতেই নেওয়া হলে একটা উদাহরণ হতে পারতো বলেও অনেকে মত দিয়েছিলেন।

বেথুন সাহেবের প্রধান সহকারী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এর মধ্যে বেথুন স্কুলের জন্য আলাদা জায়গা ঠিক করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন বিদ্যাসাগর। দক্ষিণারঞ্জন মুখ্যোপাধ্যায় প্রথমে মির্জাপুরে জমি দিতে চেয়েছিলেন স্কুলের জন্য। জায়গাটা মেয়েদের জন্য দূরে হওয়ায় কেউ মত দেয়নি। শেষে ১৮৫০-এর ৬ নভেম্বর জমি নেওয়া হলো হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল বেথুন স্কুলের। কলকাতায় নারী শিক্ষার অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে তৎকালীন গভর্নর স্যার হার্বার্ট লিটলারের স্ত্রী বেথুন সাহেবের অনুরোধে একটি অশোক গাছ পুঁতলেন। দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে দেবেন্দ্রনাথ তার মেয়ে সৌদামিনকে স্কুলে ভর্তি করেন। ফলাফল ইতিবাচক আসলো। তাকে অনুসরণ করে বাড়ির বাকিরাও স্কুলে আসতে শুরু করে।

নোট: এই অংশের তথ্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে সংকলিত। মূল গল্পটা সংহিতা চক্রবর্তী দিদির কাছ থেকে শোনা।

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন