পর্ব ২: মোটরবাইকে ভ্রমণ
উত্তরবঙ্গে কী দেখবেন ও কীভাবে যাবেন?
মুক্তাগাছার মণ্ডা দিয়েই শুরু হয়েছিল আমাদের উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের শুরু। প্রথম পর্বে www.jagonews24.com সেই গল্প তুলে ধরেছিলাম পাঠকদের সঙ্গে। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার স্বাদ নিয়ে আমরা আবারও আমাদের ছুটে চলা শুরু করি।
ময়মনসিংহের শহুরে কোলাহল থেকে বেরিয়ে আমরা জামালপুরের সড়ক ধরে ছুটতে থাকি কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে। বিস্তীর্ণ চারণভূমির বুক চিরে পিচঢালাই মহাসড়ক ছুটে চলেছে মাইলের পর মাইল। জামালপুর শহর অতিক্রম করেই শুরু হয় সীমান্তঘেঁষা উপজেলা বকশীগঞ্জ।
আরও পড়ুন: অপরূপ যাদুকাটা নদী ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, কত খরচ?
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সাথে সমান্তরালভাবে ছুটে চলেছি আমরা। চোখের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই দেখতে পাচ্ছিলাম বিএসএফ ক্যাম্প ও ভারতের স্থানীয় কিছু মানুষকে। মোটরবাইক থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম সেই দৃশ্য।
কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর সীমান্ত এতটাই কাছে চলে এসেছিল, যেন মনে হচ্ছিল পা বাড়িয়েই চলে যাওয়া যাবে মানচিত্রের অন্য একটি দেশে। ঠিক তখনই নজরে পড়ে কিছুটা দূরে সুউচ্চ পাহাড়ের দিকে।
দেখে বিমোহিত হলেও কিছুটা আফসোসও কাজ করছিল, কারণ সেই পাহাড়ের রূপ আমাদের দূর থেকেই উপভোগ করতে হচ্ছিল। কাঁটাতারের ভাগাভাগিতে পাহাড় আমাদের তথা বাঙালিদের ভাগ্যে জোটেনি। তা-ও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা আবারও শুরু করে দিই যাত্রা।
আরও পড়ুন: কম খরচে কীভাবে ঘুরবেন পান্থুমাই জলপ্রপাতে?
কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবেশ করতেই হুট করে চোখের সামনের দৃশ্যপট অনেকটা বদলে গেলো। এখানে মানুষের চেহারা ও কথায় সারল্য স্পষ্ট। খুব ভোরে রাইড শুরু করে কুড়িগ্রামের সড়ক ধরে আমরা যখন ছুটে চলেছি, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে কিছুটা ঢলে পড়তে শুরু করেছে।
তবে ক্লান্তি খুব একটা তখনো আমাদের কাবু করতে পারেনি। আমাদের আজকের গন্তব্য ছিল কুড়িগ্রাম জেলার বিচ্ছিন্ন এক উপজেলা চর রাজিবপুর। চর রাজিবপুর পৌঁছে রাতের ঠিকানা হিসেবে অনিকের পরিচিত একজনের বাড়িতে উঠবো বলে আগে থেকেই ঠিক করা রাখা হয়েছিল।
মোটরবাইক সড়কের পাশেই এক বাড়িতে রেখে আমরা উঠে পড়ি তিন চাকার ভ্যান গাড়িতে। বাকি পথটা আমাদের ভ্যানেই ভরসা। তবে আমাদের অবাক করে দিয়ে রাস্তার শেষপ্রান্তে ভ্যান এসে থামে এক বিলের সামনে। বাঁশ ঝাড়ের সঙ্গে বেঁধে রাখা আছে একটি ডিঙি নৌকা।
আরও পড়ুন: খাগড়াছড়ি ভ্রমণে ঘুরে আসুন ‘মানিকছড়ি ডিসি পার্কে’
আমি আর অনিক তখনো বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে! ভ্যান থেকে নেমে আমরা নৌকায় উঠে পড়ি। নৌকা চলতে শুরু করলেই দেখতে পাই বিশাল বিলের মাঝে একটি বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জানানো হলো আজকে রাতের জন্য এই বিচ্ছিন্ন বাড়িটিই আমাদের আবাসস্থল।
আমরা মনে মনে ভাবছিলাম, তাহলে রাতটা বেশ রোমাঞ্চকর হতে যাচ্ছে। নৌকা থেকে নেমে বাড়ির উঠানে পা দেওয়ার পরই জানতে পারলাম এখানে খেয়া নৌকা চলে না। সুতরাং আগামী দিন সকালের আগে আমরা এখান থেকে বের হতে পারছি না।
উঠানের পাশে বাঁশের মাচায় বসে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে দিলাম অলসভাবেই। বিকেল থেকেই বিদ্যুৎ নেই ও ভ্যাপসা গরমে আমাদের অবস্থা ততক্ষণে খারাপ হতে শুরু করেছিল। মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ আবার এদিকে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশ শোচনীয়।
আরও পড়ুন: এ সময় শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে কী দেখবেন, কোথায় থাকবেন?
মোটামুটি নেটওয়ার্কের বাইরে জনবিচ্ছিন্ন একটি রাত কাটিয়ে পরেরদিন সকালেই আমরা রওনা দিই গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে। বাজারে চা পান করা করার সময়ই জানতে পারি রাজিবপুর ঘাট থেকে নৌকা করে আমরা ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে সরাসরি গাইবান্ধা পৌঁছে যেতে পারবো।
তাই আমরাও ছুটলাম রাজিবপুর ঘাটের দিকে। দিনে একবারই এই ঘাট থেকে নৌকা গাইবান্ধা পর্যন্ত ছেড়ে যায়। আমরা তাই বেশ সময়ের সাথে যুদ্ধ করেই পৌঁছাই রাজিবপুর ঘাটে। পাঁচ মিনিটের জন্য সেদিন আমরা নৌকা ধরতে পেরেছিলাম। দুজন লোক আমাদের বাইক নৌকায় তুলে দিলেন আমরাও চেপে বসলাম নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে।
প্রায় ২ ঘণ্টা বিভিন্ন চর পাশ কাটিয়ে আমরা দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাই গাইবান্ধায়। গাইবান্ধা-বগুড়া মহাসড়ক ধরে ছুটে চলতে চলতেই প্রচণ্ড খিদে পেয়ে যায়। দুপুরের খাবারের জন্য আমরা আবারও থামি মহাসড়কের পাশের একটি হোটেলে। সারি সারি ট্রাক থামানো হোটেলের সামনে। ট্রাক ড্রাইভারদের কাছে সম্ভবত বেশ জনপ্রিয় একটি হোটেল এটি।
আরও পড়ুন: ডোমখালী সমুদ্রসৈকত যেন চট্টগ্রামের সুন্দরবন
খাবারের স্বাদ ছিল দারুণ। ক্লাসিক হিন্দি গানের সঙ্গে ট্রাকের বাহারি রকমের হর্নের শব্দ বেশ ভিন্ন একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। খাওয়া শেষে হোটেলের সামনে রাখা চৌকিতে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে মনে হচ্ছিল জগতের সব সুখ বোধ হয় এখানেই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবারও শুরু করি আমাদের পথচলা।
দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ বরাবরই বেশ অবহেলিত হলেও বর্তমানে উত্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত হয়েছে। বিশাল মহাসড়ক ও প্রতিটা বাজারের ওপর দিয়ে ওভারপাস যানজট কমিয়ে যাতায়াত আরও সহজ করেছে।
জেএমএস/এসইউ/এএসএম