এই বর্ষায় দেশের মধ্যেই ঘুরে দেখুন ৮ জলপ্রপাত
জলপ্রপাতের সৌন্দর্য প্রকৃতির অন্যতম এক বিস্ময়। পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসছে দুধ সাদা জলের ধারা। বিস্ময়কর এক অনুভূতির শিহরণ জাগে জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়ালে। শরীর ও মনের ক্লান্তি নিমিষেই দূর করে দেয় জলপ্রপাতের সৌন্দর্য।
জলপ্রপাতের পানি, পাহাড় ও সবুজ অরণ্যের দৃশ্য সবার মনোযোগ কাড়ে। এই বর্ষায় সুযোগ পেলেই ঘুরে আসতে পারেন দেশের বেশ কিছু জলপ্রপাত অর্থাৎ ঝরনায়। চলুন জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় কয়েকটি জলপ্রপাত বা ঝরনা সম্পর্কে-
আরও পড়ুন: মাটির ১৩৭৫ ফুট গভীরে ঘুমাতে পারবেন ‘ডিপ স্লিপ হোটেলে’
তিনাপ সাইতার জলপ্রপাত
তিনাপ সাইতার হচ্ছে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়িতে অবস্থিত একটি জলপ্রপাত। পানি প্রবাহের দিক থেকে তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের সব থেকে বড় জলপ্রপাত। এটা পাইন্দু খালের অনেক ভেতরে অবস্থিত। তিনাপ সাইতারে যাওয়ার পথের ঝিরিপথ খুবই আকর্ষণীয়।
বর্ষা মৌসুমে তিনাপ সাইতারে পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। অবাক করা বিষয় হলো, সব মৌসুমেই এ ঝরনার পানি স্বচ্ছ ও ঠান্ডা-গরম থাকে।
এ পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে আঁকাবাঁকা পথে ১৫০ ফুট উঁচু থেকে এ ঝরনার পানি পড়ে পাইন্দু খালে। সেখানে একেবারেই স্বচ্ছ পানিতে আপনি খালের তলদেশ পর্যন্ত দেখতে পারবেন।
আরও পড়ুন: প্রিয়জন নিয়ে ঘুরে আসুন ‘মেঘনা ভিলেজ হলিডে রিসোর্টে’
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে প্রথমে বান্দরবন যেতে হবে। বান্দরবান থেকে দু’টি পথ ধরে তিনাপ সাইতারে যেতে পারেন। রোয়াংছড়ি থেকে এবং রুমা থেকে। বান্দরবন বাস স্ট্যান্ড থেকে রোয়াংছড়ি বাসে যাওয়া যায়। বাসে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে।
রোয়াংছড়ি নেমে পুলিশ স্টেশনে নাম নিবন্ধন করে গাইড ভাড়া করতে হয়। কেপলং পাড়া, পাইখং পাড়া, রনিনপাড়া, দেবাছড়া পাড়া হয়ে তিনাপ সাইতারে পৌঁছানো যায়।
আমিয়াখুম জলপ্রপাত
আমিয়াখুমের সৌন্দর্য দেখতে সব সময়ই পর্যটকরা ভিড় করেন। তবে বর্ষায় আমিয়াখুমের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তখন আবার পাহাড়ের দূর্গমতার মাঝে আমিয়াখুমে পৌঁছানোও কষ্টকর।
একই সঙ্গে ভরা বর্ষায় সাঙ্গু নদীর পানি বেশি থাকে ও ফ্লাশ ফ্লাড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে বিবেচনা করে তবেই যাওয়া উচিত। ট্রেকিং করতে হয় বলে শীতকালে যাওয়া কিছুটা সুবিধাজনক।
আরও পড়ুন: পাশের দেশে গিয়ে ঘুরে আসুন ‘ছোট্ট স্কটল্যান্ডে’
কীভাবে যাবেন?
প্রথমেই যেতে হবে বান্দরবানে। এরপর থানচি উপজেলা হয়ে আমিয়াখুম যেতে হয়। থানচি থেকে দুইপথে আমিয়াখুম যাওয়া যায়। থানচি-পদ্মঝিরি-থুইসাপাড়া-দেবতাপাহাড়-আমিয়াখুম। অন্যটি হলো থানচি-রেমাক্রি-নাফাখুম-জিনাপাড়া-থুইসাপাড়া-দেবতাপাহাড়-আমিয়াখুম।
প্রথম পথে শুধু পদ্মঝিরিতেই প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা ট্রেকিং করতে হয়, এমনকি রাতের বেলাতেও ট্রেকিং করতে হতে পারে। প্রথম রুট দিয়ে অনেকে গেলেও দ্বিতীয় রুট তুলনামূলক সুবিধাজনক। এছাড়া আপনি পদ্মঝিরি দিয়ে গিয়ে রেমাক্রি হয়ে আসতে পারবেন।
নাফাখুম জলপ্রপাত
বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় নাফাখুম ঝরনার অবস্থান। বান্দরবান জেলা থেকে প্রায় ৭৯ কি.মি. দূরে যেতে হবে এই ঝরনার দৃশ্য দেখতে। থানচি বাজার সাংগু নদীর তীরে অবস্থিত। থানচি থেকে নদীপথে নৌকায় যাওয়ার সময় নদীপথ রেমাক্রি খালের দিকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে।
আরও পড়ুন: কম খরচেই ঘুরে আসুন মিরপুরের ‘তামান্না ওয়ার্ল্ড ফ্যামেলি পার্কে’
অর্থাৎ রেমাক্রি হতে সাংগু নদীর পথ বেশ কিছুটা ঢালু। রেমাক্রি খাল ছোট খাটো একটি জলপ্রপাত। এখানের পাথর গুলোও অনেকটা ছোট ছোট সিঁড়ির মত। অভূতপূর্ব এই পাহাড়ি পথের বিশুদ্ধ সৌন্দর্যে আপনি মোহিত হতে বাধ্য।
অনেকে নাফাখুম যাওয়ার পথে তিন্দুর সৌন্দর্যে বিমহিত হয়ে থানচিতে না থেকে তিন্দুতে রাত্রিযাপন করেন। যদিও থানচি ও তিন্দু দুই স্থানই সুন্দর।
রেমাক্রি বাজার থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা রাস্তা হেঁটে পাড়ি দেওয়ার পর আপনি পৌঁছে যাবেন নাফাখুম নামের আশ্চর্য সুন্দর সেই জলপ্রপাতে।
আরও পড়ুন: মেলখুম ট্রেইলে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো যে কারণে
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা টু বান্দরবানের ১০-১২ টি বাস সার্ভিস চালু আছে। আপনি ঢাকা টু বান্দরবান যেতে পারবেন বাস করে। নন এসি বাস ভাড়া জন প্রতি ৭২০ টাকা এবং এসি বাস ভাড়া জন প্রতি ৯৫০ টাকা। এরপর চাঁদের গাড়ি করে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে হবে। সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা।
থানচি থেকে রেমাক্রি যাবার উদ্দেশ্যে নৌকা ঠিক করে নিতে হবে। নৌকাটি আপনাদের থানচি থেকে তিন্দু হয়ে রেমাক্রি বাজার পৌছে দেবে।
রেমাক্রি বাজারে ১ টি রেস্ট হাউস ও ২০/২৫ টি বাড়ি আছে যেখানে আপনারা রাত্রিযাপনের জন্য রুম ভাড়া পাবেন। রেমাক্রি বাজার থেকে প্রায় দু ঘণ্টা পায়ে হেঁটে গেলেই আপনারা নাফাখুম পৌঁছে যাবেন।
আরও পড়ুন: রেমা-কালেঙ্গা ঘুরে আসুন মাত্র ১৫০০ টাকায়
হামহাম জলপ্রপাত
হামহাম জলপ্রপাতের চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখতে আপনাকে যেতে হবে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বন বিটের গহীন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। তবে সেখানে একা নয়, দলীয়ভাবে গেলেই ভ্রমণ হবে উপভোগ্য।
সেখানে যেতে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে চা বাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে একে একে কমলগঞ্জের কুড়মা বাজার, চাম্পারায় চা বাগান পার হয়ে পৌঁছাতে হবে কলাবন পাড়া। চা শ্রমিকদের ছোট্ট গ্রাম কলাবন। গ্রামের শেষপ্রান্ত থেকে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের এলাকা শুরু।
এ কলাবন থেকেই বনের মধ্যেই ট্র্যাকিং করতে হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। ১৫০ ফুট উপর থেকে আছড়ে পড়া হামহাম জলপ্রপাতের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
আরও পড়ুন: যে দেশে কনে যায় বিয়ে করতে, ধূমপান করলেই হয় জেল
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক ও রেলপথে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল যেতে হবে। সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজি বা জীপ নিয়ে কলাবন। কলাবন থেকে গাইড নিয়ে রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে হামহাম।
খৈয়াছড়া জলপ্রপাত
নয়টি ধাপ বিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনার নান্দনিক সৌন্দর্য দেখতে পাবেন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। এই ঝরনা মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজার থেকে ৪.২ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশের এই ঝরনাকে প্রকৃতিপ্রেমীরা ঝর্ণা রানি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে অনেকগুলো বাস সার্ভিস চালু আছে। ইউনিক, হানিফ, এনা এসব পরিবহনে নন এসি ৪২০-৪৮০ টাকা ভাড়া।
আরও পড়ুন: ৫২ প্রজন্ম ধরে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো হোটেল
আপনার পছন্দমতো যে কোনো একটি বাসে চড়ে মিরসরাই এর বড়তাকিয়া বাজারের কাছে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে নেমে যেতে হবে। এখান থেকে ১০০ টাকা সিএনজি ভাড়া করে খৈয়াছড়া ঝরনার ঝিরির কাছে যেতে পারবেন।
ধুপপানির জলপ্রপাত
রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ি উপজেলার ওড়াছড়ি নামক স্থানে অবস্থিত এই ঝরনার। কথিত আছে, ২০০০ সালের দিকে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধুপপানি ঝরনার নিচে ধ্যান শুরু করেন।
এক নাগারে প্রায় ৩ মাস ধ্যান করার পর ব্যাপারটি স্থানীয় লোকজনের নজরে পরে। স্থানীয়রা সন্ন্যাসীকে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেবা করতে গেলে ক্রমে ক্রমে তখন এই ঝরনাটি জনসম্মুখে পরিচিতি লাভ করে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে প্রথমে কাপ্তাই যেতে হবে বাসে করে। জন প্রতি বাস ভাড়া ৫৫০ টাকা করে হবে। সেখান থেকে ট্রলার ভাড়া করে যেতে হবে বিলাইছড়ি। জন প্রতি ভাড়া পরবে ৫৫ টাকা আর রিজার্ভ ১০০০-১৫০০ টাকা।
আরও পড়ুন: অবিশ্বাস্য ‘লাল নদী’ দেখলেই জুড়াবে চোখ
বিলাইছড়ি থেকে আরো ২ ঘণ্টা পাহাড়ি ঢলের নদী পার হতে হবে ওড়াছড়ি পর্যন্ত। এখানে অবশ্যই গাইড নিতে হবে। গাইড ফি ৫০০ টাকার মতো পরবে।
নাপিত্তাছড়া জলপ্রপাত
এই ঝরনার অবস্থানও চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাইয়ে। নাপিত্তাছড়া ঝরনা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় একটি স্থান। এখানে খুব কাছাকাছি দূরত্বে তিনটি ঝরনা আছে কুপিটা খুম, মিঠাছড়ি, বান্দরখুম।
যদি আপনি এখানকার গ্রাম থেকে গাইড সঙ্গে নেন, তাহলে একদিনেই সবগুলো ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
এখানে প্রথমে আপনাকে পাহাড়ি পথ হেঁটে যেতে হবে। এসময় বনমোরগ আর হনুমান আপনার নজরে পরতে পারে। ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার পরই প্রথম ঝরনা কুপিটাখুমে আপনি পৌঁছে যাবেন।
আরও পড়ুন: মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণের খরচ কত? রইলো অবাক করা সব তথ্য
কিছুটা হাঁটার অভ্যাস থাকলে একদিনেই গিয়ে ঘুরে দেখে আসতে পারেন একসঙ্গে নাপিত্তাছড়ার তিনটি ঝরনা।
কীভাবে যাবেন?
বর্ষাকাল এসব জলপ্রপাতের সৌন্দর্ উপভোগ করার সেরা সময়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো একটি বাসে উঠে মিরসরাই এর নয়দুয়ারী বাজারে নেমে যেতে হবে। নিজেদের সুবিধার জন্য নয়দুয়ারী বাজার থেকে স্থানীয় কাউকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিতে পারেন।
জাদিপাই জলপপ্রাত
বান্দরবানের জাদিপাই ঝরনা রুমা উপজেলায় অবস্থিত। কেওক্রাডং, জংছিয়া ও জাদিপাই এ তিনটি পাহাড়ি ঝিড়ি একসঙ্গে মিলিত হয়ে জাদিপাই ঝরনার সৃষ্টি করে। এটি প্রায় ২০০ ফুট উপর থেকে ঝর্ণার স্বচছ পানির ধারা নিচে নেমে এসে সাংগু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান শহরে গিয়ে চান্দের গাড়ি করে রুমা যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে চান্দের গাড়ি ভাড়া প্রায় ৪০০০ টাকা পরবে। রুমা যেতে সময় লাগবে প্রায় ২ ঘণ্টার মত।
রুমা বাজার নেমে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে নিতে হবে কমলা বাজার পৌঁছানোর জন্য। এখান থেকে পায়ে হেঁটে বগালেকে উঠে হেঁটে কেওক্রাডং এবং এরপর পায়ে হেঁটে জাদিপাই ঝরনায় পৌঁছাতে পারবেন।
জেএমএস/এমএস