ইয়েমেনের ‘মোখা’ শহর কেন বিখ্যাত?
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের পর থেকে ‘মোখা’ নামটির সঙ্গে এখন কমবেশি সবাই পরিচিত। ‘মোখা’ নামটি শুধু ঘূর্ণিঝড়ের নয়, বরং এটি কিন্তু ইয়েমেনের একটি শহরের নামও। বিখ্যাত এই শহর যেটি প্রধান বন্দর হিসেবেও পরিচিত সেখানে, এটির নামেই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছে।
ইয়েমেনের রাজধানী সানার প্রধান বন্দর হলো মোখা বা মোচা। আরবি শব্দ আল-মোখা থেকে এসেছে এটি। ইয়েমেনের লোহিত সাগর উপকূলে অবস্থিত একটি বন্দর শহর মোখার ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা।
আরও পড়ুন: প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসুন ‘মিনি মালদ্বীপ’
সেখানকার মোচা কফি বিশ্ববিখ্যাত। ১৯ শতকে এডেন ও আল হুদায়দাহ কফি পান করার আগ পর্যন্ত স্থানটির নাম মোখা থাকলেও, পরবর্তী সময়ে তা মোচা বন্দরে পরিণত হয়। কফি বাণিজ্যের জন্য শহরটির নাম মোখা থেকে মোচায় পরিণত হয়। এমনকি সেখানকার কফিও মোচা নামেই পরিচিত হয় বিশ্বজুড়ে।
কফির ব্যবসার কারণে মোচা ১৭ শতকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসি কোম্পানিগুলো মোচায় কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ করতো। যেটি ১৯ শতকের গোড়ার দিকে একটি প্রধান এম্পোরিয়াম ও কফি রপ্তানিকারী বন্দরে পরিণত হয়।
এই শহরের কেন্দ্রে ছিলো একটি দুর্গ। এর চারপাশে পাথরের প্রাচীর ও ছাদওয়ালা কুঁড়েঘরের গোলকধাঁধা, প্রাচীরটিকে বাইরে থেকে ঘিরে রেখেছিল। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ ইহুদি পরিবার বসবাস করতো। তারা সবাই ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলো।
আরও পড়ুন: বিশ্বের যে স্থানে গেলে দেখবেন প্রাকৃতিক চৌম্বক শক্তি
১৭৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, মোচায় ব্যবসায় নিয়োজিতদের অধিকাংশই ছিলেন বেনিয়া বণিক। যাদের সংখ্যা ছিল ৩-৪ হাজার পুরুষ। তারা প্রধানত বায়তুল ফকিহ থেকে আরও উত্তর ও অভ্যন্তরীণ স্থান থেকে উট দ্বারা মোচা বন্দরে আনা কফির পণ্যের ব্যবসা করতেন।
মোচা কফির উৎসস্থল
যদিও কফির উৎস অস্পষ্ট রয়েই গেছে, তবে ইতিহাস ঘেটে জানা গেছে কফি প্রথম ইথিওপিয়াতে জন্মেছিল তারপর তা ইয়েমেনে আসে। বিশ্বের প্রথম কফি চাষকারী দেশ হিসেবে ইয়েমেনকে বিবেচনা করা হয়।
‘অল অ্যাবাউট কফি’ বইয়ে উইলিয়াম এইচ. উকারস লিখেছেন, ইয়েমেনে কফি চাষের তারিখ ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে খুঁজে পাওয়া যায়।’ জানা যায়, ইয়েমিনিরা কফি নামক এই মূল্যবান পানীয়টিকে ‘কাহওয়া’ বলে অভিহিত করে। যার অর্থ আরবি ভাষায় ওয়াইন।
ইংরেজি শব্দ ‘কফি, ‘ক্যাফে’ ও ‘কাহওয়া’ থেকে এসেছে। যেহেতু ইসলাম মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে, তাই ‘কাহওয়া’ ইউরোপে ‘আরবের মদ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
আরও পড়ুন: ৮০ দিনে ৮১ বছরের দুই নারীর বিশ্বভ্রমণ
ইতিহাস অনুযায়ী, ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সুফি, আলী ইবনে ওমর আল-শাদিলি মোখা বন্দরে বিশ্বের প্রথম কাপ কফি তৈরি করেছিলেন । ‘কফি: অ্য গ্লোবাল হিস্ট্রি’ নামক বইয়ে ইতিহাসবিদ জোনাথন মরিস উল্লেখ করেছেন, কীভাবে আলী ইবনে ওমর আল-শাদিলি নথিভুক্ত ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি কফির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ইয়েমেনের সুফি সন্ন্যাসীরা বিশ্বের প্রথম কফি পানকারীদের মধ্যে ছিলেন। রাতের নামাজের সময় জেগে থাকার জন্য তারা ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় গ্রহণ করতেন।
মোখা বা মোচা শহর তখন দক্ষিণ ইয়েমেনের জনসংখ্যা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি ছিল। মোখায় যখন রমরমা কফি ব্যবসা চলছিলো, তখন উপনিবেশিত অঞ্চলগুলোও বৃহত্তর পরিসরে কফি উৎপাদন শুরু করেছিল।
আরও পড়ুন: লাদাখ গিয়ে যে ৭ স্পট ঘুরতে ভুলবেন না
ইতিহাসবিদদের মতে, ডাচরা ১৬৯৯ সালে তাদের জাভা উপনিবেশে (ইন্দোনেশিয়ায়) সফল কফি বাগান স্থাপন করেছিল। এরপর থেকে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি ছাড়াই মোচা বাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় ইয়েমেনের শহর থেকে।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ
অতঃপর ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ ভোর ৩টা নাগাদ মোখা বন্দরের বাসিন্দারা একটি বোমা বিস্ফোরণে জেগে ওঠেন। বেশ কয়েকটি বোমা হামলা হয়। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয সেদিন।
উভয় বেসামরিক বিমানবন্দরে বোমা হামলা করা হয়েছিল সেদিন। ইয়েমেনে আমেরিকান নাগরিকদের জন্য কোনো স্থানান্তর পরিকল্পনা ছাড়াই মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: উজবেকিস্তান ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন ও খাবেন?
এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে একটি আরব জোট বোমা হামলা ঘটায় মোখা বন্দরে। জানুয়ারি ২০১৭ সালে হাদিপন্থী বাহিনী দ্বারাও শহরটিতে আক্রমণ করা হয় ও পরের মাসে তারা দখল করে মোখা।
সর্বশেষ ২০২১ সালে হাউথি বিদ্রোহীদের দ্বারা একটি কথিত আক্রমণ, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে মোখা বন্দরের বড় ক্ষতি করা হয়। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট করেছে, বন্দরে হামলার ফলে অসেক গুদাম ধ্বংস হয়ে যায়।
বর্তমানে মোচা আর প্রধান বাণিজ্য রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। সেখানকার স্থানীয় অর্থনীতির মূল হলো এখন মাছ ধরা ও অল্প সংখ্যক পর্যটক।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
বিশ্বের বিভিন্ন স্থান পর্যটকরা গিয়ে ভিড় করেন বিখ্যাত মোচা কফির এই উৎপত্তিস্থলে। সেখানে গিয়ে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন সানার পুরোনো শহরে। এটি আরব উপদ্বীপের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি।
আরও পড়ুন: এক জাহাজেই ঘুরতে পারবেন ১৩৫ দেশ, জানুন খরচাপাতি
সানার পুরোনো শহর সালার কেন্দ্রে অবস্থিত ও জ্যামিতিক আকৃতির ভবনগুলো দেখে আপনি তাজ্জব বনে যাবেন। যার মধ্যে আছে ১০৩টি মসজিদ, ১৪টি হামাম মন্দির ও ৬ হাজারটি ক্লাব।
সেখানে গিয়ে আরও দেখতে পাবেন রক বা স্টোন প্যালেস। ইয়েমেনের রাজধানী সানার উপকণ্ঠে দাহর উপত্যকায় অবস্থিত স্টোন প্যালেস। প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পুরো প্রাসাদটি ২০ মিটারেরও বেশি উঁচু একটি সম্পূর্ণ বোল্ডার পাললিক পাথরের উপর নির্মিত।
পাথরের সামনের অংশটি ঢালের মতো। মূল প্রাসাদটি এর উপর নির্মিত বিশালাকার গ্রানাইটের বৈশিষ্ট্য ও গঠন অনুসারে 8তলা বিশিষ্ট। বাহ্যিক দিকটি চমৎকার ও অভ্যন্তর সুন্দরভাবে সজ্জিত।
ইয়েমেনি স্থাপত্যের ইতিহাসে এটি ‘দৈত্য রক প্যালেস’ একটি চমৎকার উদাহরণ। আরও আছে সিরা ক্যাসেল, এটিও জনপ্রিয় একটি স্থান। সেখানে গেলে একনজরে পুরো শহরকে দেখা যায়।
সূত্র: কাফিকুয়ারী ব্লগ/এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
জেএমএস/জিকেএস