আগালাগুরকি-বেঙ্গালুরু
মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতানের শহরে
বাবর আলী। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় পর্বতারোহী। সাইক্লিং, ম্যারাথন রানও তার সঙ্গী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছেন হিমালয়ের সাড়ে ২২ হাজার ফুটের ভয়ংকর চূড়া ‘আমা দাবালাম’। এর আগে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সাইকেল চালিয়ে দেশের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু কৃতিত্ব। এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতে। ভূ-স্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে বানিহাল, উধমপুর, জম্মু, পঠানকোট হয়ে দিল্লি ও আগ্রা। পরে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ঝাঁসী পেরিয়ে প্রবেশ তেলঙ্গানায়। এর পরে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক হয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে সফর শেষ হবে। তার হিসাবে সব মিলিয়ে ৪৫ দিনে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সফর করবেন তিনি।
এই সফরের প্রতিদিনের গল্প থাকবে জাগো নিউজে। আজ থাকছে ২৭তম পর্ব।
দিন ২৫। ধাবার মালিক সাজিদ ভাইয়ের টি-শার্টে বড় করে লেখা-Sleep deprived. আমার পাশের চারপাইয়ে শুয়েছিলেন তিনি। শেষরাতে তার বিকট নাক ডাকা আমাকেই ঘুম বঞ্চিত করলো। এমনভাবে নাক ডাকে লোকে! অথচ তার বুকেই নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে বছর পাঁচেকের কন্যা নুর বানু। ভোরে বেরিয়ে প্রথম জনপদ পড়লো ছক্কাহাল্লি। পাহাড় দেখছি সেই মধ্য প্রদেশ থেকেই। তবে ডেকান মালভূমির অংশ এই পাহাড়গুলো খুব বেশি উঁচু নয়। পাহাড়ের গায়ে কিংবা চূড়ায় মেঘের আনাগোনা সম্ভবত শেষ দেখেছি কাশ্মীরে। এতদিন বাদে ফের পাহাড়ের চূড়োর গায়ে সাদা মেঘের ভেলা। ক্ষণে ক্ষণে শিখরকে আড়াল করে দিচ্ছে।
এই বড় পাহাড়গুলো নন্দী হিলসের অংশ। বেঙ্গালুরুর অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এই পাহাড়শ্রেণির মাহাত্ম্য অনেক। এখানে ট্রেকিং রুট আছে, আছে সাইক্লিংয়ের ট্রেইল। এছাড়া নন্দী হিলসের সূর্যোদয় দেখার লোভেও আসেন অনেকে। সপ্তাহান্তে অনেক ভিড় হয় দেখে সেটা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য সরকার। নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটক সপ্তাহান্তে এখানে যেতে পারেন। আগে থেকেই সংগ্রহ করতে হয় অনুমতি/টিকিট। টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন একটি প্রাসাদও আছে এই পাহাড়ে। দিনদুয়েক আগে পামিডিতে অতিক্রম করা পেন্নার নদের জন্মও এই নন্দী হিলসে।
আরও পড়ুন>> হাসিমুখে জানাই ‘তেলেগু নেহি আতে’
রাস্তার বেশিরভাগ খাবারের দোকানগুলো অন্ধ্র স্টাইলের খাবার পরিবেশন করে। দোকানের ফলকে বড় করে তাই-ই লেখা। খানিকটা এগিয়ে আভাতিতে মহাসড়ক ছেড়ে ডানে বাঁক। কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে সবুজ পানির ছোট্ট আভাতি লেক। কলেবরে এমন কিছু নয়, তবে পেছনের পাহাড়গুলোর জন্যই জায়গাটা সুন্দর। এই সকালে আরও স্নিগ্ধ লাগছে লেকটাকে। রাস্তার ধারেই বিশাল সব বোল্ডারে ভরা পাহাড়। আভাতি নামক এই জায়গা কর্নাটকের রক ক্লাইম্বারদের খুব পরিচিত জায়গা। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা একে চেনে আভাতি রক ক্লাইম্বিং স্পট হিসেবে। বেঙ্গালুরু থেকে ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়েই এখানে চলে আসা যায় বোল্ডারিং করতে। এরকম প্রাকৃতিক রকের অবস্থানের কারণেই বেঙ্গালুরুতে অনেক রক ক্লাইম্বার। তাদের দক্ষতাও অসাধারণ।
অল্প এগিয়ে ডানে বাঁক। পাহাড়ের চড়াইয়ে অবস্থান শ্রী থিম্মারায়া স্বামী মন্দিরের। যথারীতি দক্ষিণী তথা দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। পাহাড়চূড়ার ছোট্ট মন্দির থেকে এক গড়ানে নিচে নেমে রক ক্লাইম্বিংয়ের আরও কয়েকটা স্থানে ঘুরলাম। একেবারে রাস্তার ধারেই অবস্থান এসব রকের। অনেক রক ক্লাইম্বারের শৈলারোহণে হাতেখড়ি এসব বোল্ডারে। নানান আকারের পাথর আর পাথুরে দেওয়াল অঞ্চলজুড়ে। ক্যাম্পিং করার মতো জায়গাও আছে দেদার। এমনকি গাড়ি পার্কিং সুবিধাও আছে।
পরের গন্তব্য দেবানাহাল্লি দুভাবে যাওয়া যায়। হাইওয়ে ছাড়াও গ্রামের ভেতরের একটা রাস্তা আছে। গ্রামের ছায়া সুনিবিড় রাস্তার আকর্ষণটা এড়ানো গেলো না। কোডাগুরকির দিকটায় বেশকিছু নেচার রিট্রিট টাইপ হোটেল আছে। কার্ট হুইলসহ আরও নানান অ্যাডভেঞ্চার অ্যাকটিভিটির ব্যবস্থা স্থানে স্থানে। রাস্তায় প্রচুর রোড বাইকার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উইকেন্ড রাইডে বেরিয়েছে। দেখা হলেই হাত দেখিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে নীরবেই। ওরা সবাই মূলত আমার উল্টোদিকেই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানিটা ভালো, মুগ্ধ করলো তালওয়া গোশত
মহাসড়কে উঠে কিছুদূর এগিয়ে ফের বামে। এগোতেই দেবানাহাল্লি দুর্গের রাস্তা। পুরোটাই পুষ্পশোভিত। হাজারো ফুলের পাপড়ি বিছানো রাস্তায়। দুই-একদিনের মধ্যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে খুব সম্ভবত। ফুলের ঘ্রাণে জায়গাটা সুরভিত। সকাল সকাল মনটাই ভালো হয়ে গেলো। ফটক পেরিয়ে ঢুকতেই দুর্গের ভেতর অনেক বাড়ি। এমন সাধারণত খুব একটা দেখা যায় না। দুর্গ কিংবা রাজবাড়ির ভেতর এমন বাড়ি শেষ দেখেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরের হরিপুর জমিদারবাড়িতে। ভারতে প্রথম দেখলাম এমন। বাড়ি ছাড়াও আছে অনেকগুলো মন্দির। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ভেনুগোপালাস্বামী মন্দির। কৃষ্ণের সুন্দর একটা মূর্তি আছে মন্দিরগাত্রে। পাশেই আরও অনেকগুলো মন্দির। সেগুলো অবশ্য তারের জালি দিয়ে আগাপাশতলা ঘেরা। কারণটা কী কে জানে! দ্রাবিড়ীয় মন্দিরগুলো কখনো এমন বেষ্টনী দিয়ে আবদ্ধ হতে আগে দেখিনি। লোকের বসতবাড়ি আর মন্দির ছাড়াও চালের গুদাম অবধি আছে দুর্গের অভ্যন্তরে।
হায়দার আলী আর তার পুত্র টিপু সুলতানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই দুর্গ। হায়দার এখানেই তার সামরিক ক্যারিয়ার শুরু করেন একজন নিছক অশ্বারোহী হিসেবে। অসম সাহসের সঙ্গে দারুণ যুদ্ধবিদ্যার নৈপূণ্যের মিশেলে ধীরে ধীরে অকুতোভয় এই বীর বনে যান মহীশূর তথা মাইসোরের শাসক। তার পুত্র টিপু সুলতান জন্ম নেন দুর্গের ঠিক বাইরে। শ দেড়েক গজ দূরত্বে। দেবানাহাল্লির দুর্গ নতুন করে নির্মাণে হায়দার আলী ভূমিকা রাখলেও এটির মূল নির্মাতা মাল্লা বাইরে গোড়া। ১৫০১ সালে কাদামাটিতে এই কেল্লা তৈরি করেন বেঙ্গালুরুর প্রতিষ্ঠাতা এই শাসক।
বেরিয়েই উৎসবের পুষ্পশোভিত রাস্তা শেষ হতেই কনকচূড়ার ফুলের চাদর। গাছের তলা সকালের আলোতে হলদে আভা ছড়াচ্ছে। গাছের মাথা আর পাদদেশ- দুটোই উজ্জ্বল হলুদ বর্ণে ঢাকা। গাছ পেরিয়েই বাওলি বা সিঁড়ি কুয়া। চারপাশ থেকে অসংখ্য সিঁড়ি ধাপে ধাপে ঢালু হয়ে নেমে গেছে কুয়াতে। বাওলির দুই প্রান্তে আছে দুটি মন্দির। ঘণ্টা হাতে পুরোহিতের দেখাও মিললো মন্দিরের দোরগোড়ায়। তার পাশেই মহিশুরের বাঘ বলে বহুল পরিচিত টিপু সুলতানের জন্মস্থান। চারটা খিলান দিয়ে ঘেরা ফুট দুয়েক একটা বর্গক্ষেত্র অবশিষ্ট আছে এখন এ স্থাপনার। এখনো নৈবেদ্যের ফুল পান মাইসোরের বাঘ। জন্মস্থানের বেদিতে ঝুলে আছে ফুলের মালা। দেবানাহাল্লির এই শহরতলীতেও বাড়ির সামনে রাঙ্গোলি আঁকার চল আছে। চকের সুন্দর সব নকশা কাটা বাড়ির দোরে।
মহাসড়কের চারলেন এখানে উন্নীত হয়েছে ছয় লেনে। পাশেই আবার বেশ বড় আকৃতির সার্ভিস রোডও আছে। রাস্তা বড় হলে আমার মতো ধীরগতির বাহনের আরোহীর সুবিধা। রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে। পথে দুই রোড বাইকারের সঙ্গে দেখা। ডেকাথলনের দুটো রোড বাইক নিয়ে লং রাইডে বেরিয়েছে ভারতের আইটি হাবের দুই কম্পিউটার প্রকৌশলী। নবীন আর অক্ষয় নাম।
আরও পড়ুন>> খরচ বাঁচাচ্ছে পেট্রোল পাম্পের ফ্রি বিশুদ্ধ পানি-হাওয়া
নবীন আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার ফোনে ফোনপে কিংবা গুগল পে আছে কি না। নেতিবাচক উত্তর দিতেই টপ টিউব ব্যাগ থেকে ২০০ রুপি আমার হাতে দিলো নাশতার জন্য। আমি নিতে ইতস্তত করায় বললো এটা দিয়ে আজকে সকালের নাশতা সারতে। ওদের হাতে সময় থাকলে একসঙ্গেই প্রাতরাশ সারা যেত। সেটা যেহেতু হচ্ছে না, এটা নিতেই হবে। বাড়ি বাংলাদেশ শুনে কয়েক বাক্য বাংলাও বললো নবীন। কর্নাটকের ছেলে বাংলা কীভাবে জানে জিজ্ঞেস করায় জানালো, ওর শ্বশুরবাড়ি পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে।
ঈশ্বরের বানানো গ্রাম ছেড়ে মানুষের বানানো শহরের দিকে এগোচ্ছি! প্রকৃতি পেছনে পড়ে যাচ্ছে, দৃশ্যমান হচ্ছে ইট-পাথরের সুকঠিন সব স্থাপনা। রাস্তার ফলকে বেঙ্গালুরু পুলিশের জিজ্ঞাসা- Is this conversation worth ur life? অতএব, গাড়ি চালানোর সময় কানে ফোন গেঁথে চলা ছেড়ে দাও! ভারতীনগরের পরে নাশতা সারার জন্য মহাসড়ক ছাড়লাম। দোসা আর পুরি খেয়েও নবীনের টাকাটা খরচা করতে পারলাম না। দোকানে পরিচয় হওয়া কান্তব নামে একটা ছেলে বিল দিয়ে দিলো।
ভারতের অন্য এলাকায় সিগারেটের চেয়ে লোকে গুটখা খায় অনেক বেশি। বেঙ্গালুরুতে আবার ভিন্ন দৃশ্য। তরুণ প্রজন্ম ক্যানসার কাঠির পেছনে আগুন দিতেই আগ্রহী এখানে। ইয়েলেহানা ছাড়িয়ে জাক্কুর প্ল্যান্টেশন। নাশতা সারার জন্য মহাসড়ক ছাড়ার পরে ভাবলাম সার্ভিস রোড ধরেই এগোই। গাড়ির গতি এখানে অপেক্ষাকৃত কম। অবশ্য খানিক বাদেই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হলো। একের পর এক লালবাতির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। অবশ্য এমন না যে, খুব বেশি সময় নষ্ট হয়। তাও প্রতিটা মোড়ে লালবাতি সবুজ হওয়ার প্রতীক্ষা করতে কারই-বা ভালো লাগে। সুযোগ পেয়েই মহাসড়কে উঠে গেলাম। ছোট একটা বিমানঘাঁটি আছে জাক্কুরে। সরকারের ফ্লাইং ট্রেনিং স্কুল ছাড়াও এখানে নানান অ্যাডভেঞ্চার অ্যাকটিভিটি হয়। কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই মাইক্রোফ্লাইট চালানো যায় এই বিমানশালায়। এছাড়া প্যারাগ্লাইডিংও হয় এখানে।
বেঙ্গালুরুর একের পর এক আন্ডারপাসের ওপরের উড়ালপুল পেরিয়ে হেব্বাল। রাস্তার দুই ধারের অসংখ্য ভবন, শপিংমল পেরিয়ে পৌনে এগারোটা নাগাদ বেঙ্গালুরু। আজ আর এগোবো না। বেঙ্গালুরুর আশপাশেই ঘোরাফেরা করবো। প্রথমেই চলে গেলাম বেঙ্গালুরু প্যালেসে। শিরীষ গাছে ছাওয়া পথের শেষে দামি তোরণ। কোনো এক রাজকীয় বিয়ে হয়েছে গতকাল; তারই সাজসজ্জা রয়ে গেছে। এগিয়ে বিশাল সব পাথরে নির্মিত বেঙ্গালুরু প্যালেস। টিকিটের দাম শুনে আক্কেল গুড়ুম। বিদেশিদের জন্য প্রবেশমূল্য ৪৮০ রুপি। ছবি তোলার জন্য আবার গচ্ছা দিতে হবে ৩০০ রুপি! ঢোকার আগ্রহই চলে গেলো। চত্বরেই বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করলাম। জায়গাটা বাইরে থেকেও কম দৃষ্টিনন্দন নয়।
প্যালেস থেকে বেরিয়ে ছায়াঘেরা কানিংহাম রোড। শহরের কেন্দ্রে থেকেও নগরের সব কলুষতা থেকে যেন মুক্ত এই সড়ক। সাইকেলের চাকা গিয়ে থামলো জওহরলাল নেহরু প্ল্যানেটরিয়ামে। কুরুক্ষেত্রে কল্পনা চাওলা প্ল্যানেটরিয়ামে সময়ের অভাবে যেতে না পারার আফসোস কিছুটা হলেও ঘোচানোর চেষ্টা। দারুণ সব বৈজ্ঞানিক তথ্য আর যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রদর্শনীতে ভর্তি প্ল্যানেটরিয়াম। সপ্তর্ষি মন্ডল, নয়েস রেজোনেটস, কেলিডোস্কোপ, আর্কিমিডিস পাম্প ইত্যাদি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের বানানো পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকলের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণও আছে এর প্রাঙ্গণে। সবচেয়ে মজা লাগলো একটা পাতের ওপর হেঁটে গেলে সেটা থেকে একই সঙ্গে হন্টনকারীর শরীরের ভর দুনিয়া আর মঙ্গলে কত হবে সেটা জানা যায়। ভাষার ভিখারি হওয়ায় ভলান্টিয়ারের শব্দগুচ্ছ থেকে মঙ্গল আর দুনিয়া- কোনোখানেই নিজের ভর জানতে পারলাম না!
ভারতের বেশিরভাগ পাবলিক প্লেস কিংবা পর্যটন স্থাপনায় ফ্রি ফিল্টার পানির ব্যবস্থা থাকে। এখানেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে যেহেতু এটি প্ল্যানেটরিয়াম, তাই ব্যবস্থাটা ব্যতিক্রমী। এই পানির ফিল্টারগুলো অন্য সব পানি পরিশোধকের মতো দূষিত পানিকে পরিশোধিত করে না। এরা বাতাসের জলীয় বাষ্প থেকে পানি তৈরি করে সেটাকেই পরিশোধন করে। নিউটনের বর্ণ চাকতির প্রদর্শন দেখে আর বর্ণনায় পড়ে জিনিসটা মুহূর্তেই বুঝে গেলাম। অথচ স্কুল-কলেজে এগুলো আমরা শুধু মুখস্ত করেই গেছি। এখানে প্রতিটি জিনিসের এত মনোগ্রাহী প্রদর্শন করা হয়েছে যে, কেউ একবার মনোযোগ দিয়ে দেখলে সহজে ভোলার কথা নয়। প্ল্যানেটরিয়ামের দর্শনার্থীরা বেশিরভাগই স্কুলগামী স্থানীয় শিশু। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির রাজধানী শহরের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে বিজ্ঞানমনষ্ক করার জন্য শুধু নিয়েই আসেনি, সহজবোধ্য ভাষায় বোঝানোর চেষ্টাও করছে। এক মাকে দেখলাম তার শিশু সন্তানকে ভারকেন্দ্র সম্পর্কে বোঝাচ্ছেন।
অপটিক্যাল ইল্যুশন দেখে এগোলাম বিধান সৌধের দিকে। কর্নাটক রাজ্য সরকারের সব দাপ্তরিক কার্যক্রম হয় এখানে। নিও-দ্রাবিডিয়ান স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত ভবনটির বয়স প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এ ভবন দেখতে এখনো প্রচুর ভিড় হয়। ভবনের উপরে বড় হরফে লেখা আছে- Govt. work is god's work. সরকারি কাজ অবশ্যই দরকারি কাজ। তবে নগদ অর্থের আদান-প্রদান থাকলে সেখানে ঈশ্বরকে জড়ানোটা কি ঠিক কাজ?
পরের গন্তব্য বেঙ্গালুরু ফোর্ট। এই নগর কেল্লায় যেতে শহরের অনেকটুকুই দেখা হয়ে যাচ্ছে। দুচোখে দৃশ্য গিলতে গিলতে এগোচ্ছি। মেট্রোপলিটন শহর হলেও বেঙ্গালুরু বেশ ছিমছাম শহর। ট্রাফিকের চাপ সত্ত্বেও লোকে দারুণভাবে ট্রাফিক আইন মানে। অবশ্য লাল/সবুজ বাতিগুলো একটানা অনেকক্ষণ কাউকেই অপেক্ষায় রাখে না। এদের ট্রাফিক ব্যবস্থা দেখে ঢাকার বিজয় সরণির জ্যামের কথা মনে পড়ে গেলো। ওই পুলসিরাত আমি জীবনে সম্ভবত দুই-তিনবার কোনো অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে পেরোতে পেরেছি। বেঙ্গালুরু মেডিকেল কলেজের সঙ্গেই দুর্গটি। বিশাল ফটকে পেল্লাই একটা কাঠের দরজা। সেটার তলা দিয়েই ঢুকতে হয় দুর্গে। ভেতরে পেইন্টিং করছে একজন। লোকে দুর্গ দেখার চেয়ে তার শিল্পকর্মে অধিকতর মুগ্ধ যেন! বিশাল সব পাথরের ব্লক একের ওপর এক সাজিয়ে নির্মিত কেল্লাটি। পাথরের ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে ছোটখাটো সব অশ্বত্থের চারা। এক সময় দুর্গকে ঘিরে পরিখা ছিল। সেসব এখন অতীত।
মেডিকেল কলেজের ফটকের সঙ্গেই অসম্ভব ভিড়ের খাবারের দোকান। খানিক দোনোমনা করে দোসার জন্য বললাম। এখন অবধি সেরা দোসা পাকস্থলীতে পড়লো এই দোকানেই। নারকেলের আচার আর এক ধরনের লালচে তরকারিতে এই মাসালা দোসা অনবদ্য। বেরোতেই আকাশে ফের জলভরা মেঘের উপস্থিতি। বৃষ্টির আগের ঠান্ডা হাওয়াও বইছে। টিপু সুলতানের সামার প্যালেস যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ডরমিটরি পানে পা বাড়ালাম। পথে বেশ কয়েকটা মুসলিম বসতি পড়লো। বেঙ্গালুরু শহরে মসজিদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। অবশ্য মসজিদগুলোর বেশিরভাগ মিনারই হায়দ্রাবাদের চার মিনারের আদলে তৈরি। ডরমিটরি দেখে মুগ্ধ। নরম পরিষ্কার বিছানা, সঙ্গে ততোধিক পরিস্কার বাথরুম। লোকেশনও একেবারে শহরের মধ্যখানে। ডরমিটরিতে ঢুকে সাইকেলের ব্যবস্থা করতেই ঝেঁপে বৃষ্টি।
আড়াইটায় শুরু হওয়া বৃষ্টি থামলো সাড়ে পাঁচটার পরে। সাইকেল রেখে হেঁটেই বৈকালিক ভ্রমণে বেরোলাম। লোকমান্য তিলক পার্ক হয়ে গেলাম হজরত তাওয়াক্কুল শাহ মাস্তানের দরগা। এটি বেঙ্গালুরু শহরের সবচেয়ে পুরোনো এবং বড় দরগা। বিশাল একটা মসজিদও আছে। মসজিদটি নির্মিত হয় মাইসোরের এক সময়ের শাসক হায়দার আলীর অর্থায়নে।
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ফ্রিডম পার্ক হয়ে ফেরার পথে পথিস নামক ফুড কোর্টে থামলাম। লোকে দেদারসে পরোটা কারি নামে এক ধরনের খাবার খাচ্ছে দেখে আমিও সেটা অর্ডার করলাম। মুচমুচে পরোটার সঙ্গে মটর, টমেটো আর লাউয়ের কারিটা লা-জওয়াব। ফেরার পথে আরেক দোকানে পাও ভাজি খেয়ে খানিকটা হতাশ হয়ে ডরমিটরির পথ ধরলাম।
চলবে..
এএসএ/জিকেএস