সাইকেলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী (পর্ব-১)
চিনার বৃক্ষ-লেক-পাহাড়ের রাজ্যে টিউলিপের মুগ্ধতা
বাবর আলী। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় পর্বতারোহী। সাইক্লিং, ম্যারাথন রানও তার সঙ্গী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছেন হিমালয়ের সাড়ে ২২ হাজার ফুটের ভয়ংকর চূড়া ‘আমা দাবালাম’। এর আগে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সাইকেল চালিয়ে দেশের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু কৃতিত্ব। এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতে। ভূ-স্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে বানিহাল, উধমপুর, জম্মু, পঠানকোট হয়ে দিল্লি ও আগ্রা। পরে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ঝাঁসী পেরিয়ে প্রবেশ তেলঙ্গানায়। এর পরে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক হয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে সফর শেষ হবে। তার হিসাবে সব মিলিয়ে ৪৫ দিনে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সফর করবেন তিনি।
এই সফরের প্রতিদিনের গল্প থাকবে জাগো নিউজে। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
মাউন্ট নুন অভিযানে যাওয়ার কথা ছিল গত বছর। সাত হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার এ পর্বত যদিও জম্মু-কাশ্মীর আর লাদাখ নামক দুই ইউনিয়ন টেরিটরির সীমান্তে অবস্থিত, তবে পর্বতাভিযান হয় মূলত লাদাখের দিক থেকে। পাকিস্তান সীমান্তঘেঁষা কারগিল থেকে যেতে হয় টাংগোল নামক একটা গ্রামে। অভিযানের উত্তেজনায় এসব গ্রামের নাম, রুট, ভূখণ্ডের প্রকৃতি, আবহাওয়া ইত্যাদি ছিল নখদর্পণে।
যাই হোক, বিধি বাম! ভাগ্যের ফেরে ওই অভিযান আঁতুড়ঘরে নুন খাওয়ানো বাচ্চার মতো অকালে ঝরে পড়েছিল। প্রায় নয় মাস পর এ অভিযানের কথা এলো কেন সেটা বলি। গতকাল জম্মু পৌঁছে শ্রীনগরের বাসে চেপেছি সন্ধ্যায়। বাসভর্তি বিহারের লোকজন। কাজের খোঁজে যাচ্ছে শ্রীনগর, লাদাখ আর কারগিল। পুরো বাসে অ-বিহারি আমরা চারজন। দৈবক্রমে আমাদের সিটও একসারিতে। বাস চলার কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচিত হয়ে গেলাম হামজার সঙ্গে। তার নামের শেষাংশ আর আমার নামের শেষাংশ আবার একই। দুজনের জমে যেতে দেরি হলো না। এত বিতং করে মাউন্ট নুনের কথা বলার একটাই কারণ। হামজার বাড়ি মাউন্ট নুনের পাদদেশে। গ্রামের নাম পানিখার। ওই সূত্রেই মাউন্ট নুন-কুন নিয়ে কত কথা। নুন না খেয়েও ‘মাউন্ট নুন’ এই পর্বত নিয়ে গুণ গাইতে আমার কোনো অসুবিধাই নেই!
এর মাঝে ক্ষণে ক্ষণে হল্লা করছে বিহারের লোকজন। বাচ্চাদের চিৎকার, তাদের শান্ত করতে বাপ-মায়ের গালি আর চড়-থাপ্পড়, বুড়োদের থেকে থেকে কাশি, বুড়িদের নিজেদের মধ্যে হাঁকাহাঁকি- বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত। আমি অবশ্য এসব গায়ে মাখছি না। তবে কান খাড়া করে ভাষা শুনছি। মনে হচ্ছে গত বছর দেখা ‘পঞ্চায়েত’ নামক টিভি সিরিজ চোখের সামনে অভিনীত হচ্ছে। খুব প্রিয় ওই সিরিজের মতোই ঠেকছে বাসভর্তি লোকের সংলাপ।
একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম। ভারতের অন্য জায়গার লোকজন ‘আমি’ শব্দকে হিন্দিতে বলে ‘ম্যায়’, আর বিহারের লোকজন বলে ‘হাম’। সবচেয়ে দারুণ লাগলো, পঞ্চায়েত সিরিজের অন্যতম ব্যাপার ছিল ‘লকি’ তথা লাউ। এই বাসেও বয়োঃজ্যেষ্ঠ এক বুড়োর হাতের থলি থেকে দুটো বিশাল লকি তথা লাউ উঁকি দিচ্ছে!
ভোর ৪টায় বাস পেটভর্তি লোকজনকে উগরে দিলো শ্রীনগর বাসস্ট্যান্ডে। বাইরে ঠান্ডার দাপট বেশ। হামজা আগেই বলে রেখেছিল এত ভোরবেলা আশ্রয় খোঁজার ঝামেলায় না যেতে। ওরা থাকবে কারগিলের লোকেদের রাত কাটানোর জন্য বানানো একটা সরকারি লজে। আপাতত ওখানেই সকালে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বললো। হামজারা বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৫ কিলোমিটার পথটুকু যাবে জিপে। ছাদ থেকে সাইকেল নামিয়ে প্যানিয়ার বেঁধে প্যাডেল চাপ দিতেই শীতের প্রকোপ আরেকটু বেশি ঠেকলো। সাইক্লিং গ্লাভস দিয়ে হাত আর গামছা দিয়ে মাথাটা মুড়ে অল্প একটু স্বস্তি পাওয়া গেলো। আমি সাইকেলে যাচ্ছি বিধায় হামজাদের আগে যাওয়ার একটা ব্যাপারও মনের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করছে। নিজে ডেকে ও আমাকে সকালটা নির্বিঘ্নে বিশ্রাম নিতে বললো। সেখানে দেরিতে পৌঁছে এই ভোরবেলা ওদের অসুবিধায় ফেলতে চাই না।
বিশাল সব ট্রাকের আলোয় পথ চলে গুগল ম্যাপের সাহায্যে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখি ওরা তখনো পৌঁছেনি। মিনিট ১৫ বাদে পৌঁছেই ডরমিটরির মতো দেখতে একটা লম্বা ঘরে ঘুম। আরও জনা দশেক লোকও শুয়ে আছে সেখানে। ১১টার দিকে হামজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরোলাম শ্রীনগর দেখতে। প্রথম গন্তব্য অতি অবশ্যই ডাল লেক। আমার অবস্থান থেকে ডাল লেকের দূরত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার। পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলো শ্রীনগরের অতীব সুন্দর নদ ঝিলমের সঙ্গে। স্থানীয়দের উচ্চারণে এটি অবশ্য ‘ঝেলম’।
ডাল লেক ঘিরে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ন্যায় একটা পাক দিয়ে ফেললাম। মাঝে অবশ্য থেমে থেমে শিকারা তথা লেকে ট্যুরিস্ট নিয়ে জলে ভাসানোর অপেক্ষায় থাকা নৌকাগুলোর ঘাটে ঘাটেও দাঁড়ালাম। শিকারাগুলোর কিছু নাম ভারি মজার। চোখে পড়া সবচেয়ে দারুণ তিনটার নামই বলি- ‘ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো’, ‘মামা মিয়া’ এবং ‘মানি হাহা’! লেকের জলজ আগাছা তুলছে বেশকিছু যান্ত্রিক জলযান। অনেকটা প্যাডেল বোটের মতো দেখতে এসব জলযান। প্যাডেল বোটের ন্যায় চাকা ঘোরে; আর চাকার গায়ে উঠে আসে জলজ আগাছা। অবশ্য ডাল লেক থেকে মাঝে মধ্যেই আমার দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে পাড়ের একটি মহিরূহ। ‘চিনার’ নামক গাছটি শ্রীনগরে অসংখ্য। বসন্তের নতুন পাতার ছোঁয়ায় এই গাছ সবুজাভ। এই গাছ থেকে চোখ ফেরানো দায়। কচি সবুজ রঙের পাতায় রোদ যেন পিছলিয়ে যাচ্ছে!
ডাল লেকে ভাসমান পোস্ট অফিস পেরিয়ে এগোলাম গুরুদুয়ারা চাটি পাঠশাহির দিকে। সোনালি গম্বুজওয়ালা গুরুদুয়ারাটা বেশ গোছানো। পরবর্তী গন্তব্য সঙ্গিন দরজা এবং কাঠি দরজা। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে এগুলো বানানো হয়েছিল। মূল শহরকে রক্ষা করতে বানানো পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসের দেওয়ালে যাতায়াতের এমন দরজা ছিল তিনটি। একটু এগিয়ে দেওয়ালের ভগ্নাবশেষের সঙ্গে লাগানো সুন্দর একটি মুসলিম কবরখানা। আমাদের দেশীয় চিনামাটির ফলকের বদলে সুন্দর সব পাথুরে ফলক। ফাঁকে ফাঁকে মাথা তুলেছে রঙিন সব ফুল। আরও কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে আড়াইটা নাগাদ হরি পর্বতের পাদদেশে। টিকিট কাউন্টারে লেখা আছে ৩টায় বন্ধ হয়ে যাবে প্রবেশপথ। দুররানি সাম্রাজ্যের এই দুর্গ কালকের জন্য তোলা রইলো।
এবার সাইকেল হাঁকালাম হজরতবাল মসজিদ পানে। রাস্তার গাছে গাছে বসন্তের ছোঁয়া। রঙিন পাতা রাস্তার চেয়ে গাছের ডালে চোখ আটকে রাখছে। পথে পড়লো কাশ্মীরের আরেক দ্রষ্টব্য নাইগিন লেক। কলেবরে ডাল লেকের চেয়ে ছোট। তবে শিকারা আর হাউজ বোটের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা বিস্তৃত এখানেও। মিনিট ১৫ সাইকেল চালাতেই হজরতবাল মসজিদ।
এই মসজিদ তথা দরগার প্রাঙ্গণ থেকে ডাল লেককে অসম্ভব সুন্দর দেখা যায়। কথিত আছে, এখানে হজরত মুহাম্মদ (স.) এর চুল সংরক্ষিত আছে।
পরের গন্তব্য ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন। আমার শ্রীনগর আসার সময়টা টিউলিপ ফোটার কথা চিন্তা করলে একেবারে মোক্ষম হয়েছে। হাজারে হাজারে রং-বেরঙের টিউলিপ সবুজ ঘাসের জমিনে ফুটে আছে। চার কিংবা পাঁচটা পাতার মাঝখানে পেঁয়াজ পাতার মতো দণ্ডের মাথায় লম্বাটে ফুলগুলো জগতের সম্ভব সব রঙের পসরা সাজিয়ে বসেছে। পেছনের উদ্ধত ন্যাড়া পাথুরে পাহাড়কে ভর্ৎসনা জানিয়েই যেন নিচের জমিনে এত এত ফুলের সমাহার। অনেক লোকের ভিড় টিউলিপ গার্ডেনে। নানান অঙ্গভঙ্গিমায় নেচে-কুঁদে ‘টিকটক’ এবং ‘রিল’ নামক মহার্ঘ্য বস্তু বানাতে ব্যস্ত নারী-পুরুষ সবাই। বিপরীত চিত্রও আছে। হুইলচেয়ারে চেপে এসেছে বেশ কজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। অঙ্গসঞ্চালনে অক্ষম এসব প্রবীণদের সৌন্দর্যবোধের প্রতি আকর্ষণের ব্যাপারটা বেশ নাড়া দিলো।
টিউলিপ ছাড়া একটা গাছ খুব মুগ্ধ করলো। পোশাকি নাম ‘উইপিং উইলো’। এর ঝুলে থাকা পাতাগুলোর হালকা সবুজ রং কী যে প্রশান্তি জোগায়! বেরিয়ে কাশ্মীরের স্থানীয় চা ‘কাহওয়া’ চাখলাম। আমি কড়া চা-কফির ভক্ত বলে মিষ্টি স্বাদের চা খুব একটা ভালো লাগলো না।
আকাশে সময়ের চাকা ঘোরানোর কাজে নিয়োজিত সূর্য তখনো ঢলে না যাওয়ায় গেলাম নিশাত বাগে। মুঘলদের সৌন্দর্যপ্রিয়তার আরেক নিদর্শন এ বাগান। ডাল লেকের একেবারে গা ঘেঁষে এর অবস্থান। অসম্ভব পরিপাটি এ বাগানে আছে অনেকগুলো ফোয়ারা। একসময় ছিল ১২টি টেরেস। রাশিচক্রের ১২টি রাশি অনুসারে। কালের বিবর্তনে অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়েছে এ বাগানের। তবে রয়ে গেছে এখনো শতবর্ষী চিনার গাছগুলো। মুঘল আমল থেকে এখন অবধি এ অঞ্চলের মানুষদের তার সুশীতল ছায়া দিয়ে যাচ্ছে এসব মহিরুহেরা। ইফতারের ঠিক পরপর শ্রীনগরের রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। সদা ব্যস্ত ডাল লেকের পাড়েও নিস্তব্ধতা। কালো পিচের ওপর দুদ্দাড় গতিতে এগিয়ে চলা সাইকেলের টায়ারের ঘর্ষণ ছাপিয়ে কানে আসছে চিনারের ডালে পাখিদের গৃহপ্রবেশের চাঞ্চল্য। আমারও মাথা গোঁজার সময় হলো বলে!
ভালো কথা, অফিসিয়ালি রাইড শুরু না হলেও আজ এদিক-সেদিক করতে করতে ৯০ কিলোমিটার সাইকেল চালানো হয়ে গেছে।
চলবে…
এএসএ/এএসএম