কাশ্মীর গিয়ে ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম ঘুরতে ভুলবেন না
মো. আরাফাত রহমান
ভ্রমণকে কাজের অজুহাত না দেখিয়ে বরং কাজকে ভ্রমণের অজুহাত দেখিয়ে ২ সপ্তাহের জন্য চলে গেলাম কাশ্মীর। যাত্রা শুরু ১৭ ডিসেম্বর, প্রথমে ঢাকা থেকে কলকাতা। সেখান থেকে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে জম্মু। সবচেয়ে দীর্ঘ এই যাত্রাপথের দূরত্ব ১৯৪৫ কিলোমিটার।
৩৯ ঘণ্টার এই যাত্রাপথে কোথাও ধু ধু জনমানবশুন্য প্রান্তর, কোথাও বিস্তীর্ণ বনভূমি, কোথাও আবার শহুরে মানুষগুলোর সড়কপথে অবিরাম ছুঁটে চলা। ভারতের রেলব্যবস্থার প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে, প্রতিটি কামরা আর ওয়াশরুম অসম্ভব পরিষ্কার ছিল। একই সঙ্গে স্টাফদের আচরণ খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ। ট্রেনে খাবারে বাঙালিয়ানা স্বাদ না থাকলেও খাবারের বৈচিত্র্যে অপ্রতুলতা ছিল না।
আরও পড়ুন: ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে ট্রেনের টিকিট কাটবেন যেভাবে
কাশ্মীর ভ্রমণের প্রথম গন্তব্য পেহেলগাম। ছবির মতো সুন্দর একটি জায়গা। পাহাড়, গাছ, নদী আর বরফের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আমি পাহাড়ভক্ত একজন মানুষ। বান্দরবান থেকে শুরু করে সিকিম, মেঘালয়ের সব পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকি আপার দৃষ্টিতে। তবে পেহেলগামের একেকটি পাহাড় যেন একেকটি মায়া।
পাহাড় ঘেরা রাস্তায় প্রতিটি বাঁকে চোখে পরবে সারিবদ্ধ পাহাড় আর তার চূড়ায় বরফের আবরণ। মনে হবে যেন সৃষ্টিকর্তা আইসক্রিমের ফেরিওয়ালার সাজে সাজিয়ে রেখেছেন এই স্থান। পেহেলগাম থেকে ১৬ কিলেমিটার দূরত্বে আমাদের প্রথম গন্তব্য চন্দনওয়ারী।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৯৫ মিটার উঁচু, এককথায় ‘বিপদজনক সৌন্দর্য’। এই বিশেষণ ব্যবহার এর কারণ শুভ্র বরফ আপানকে আকর্ষণ করবে কিন্তু বরফপৃষ্ঠ এতোই পিচ্ছিল যে আপনি হোঁচট খেতে বাধ্য। স্থানীয়দের প্ররোচনায় ১০০ রুপিতে গামবুট ভাড়া করেও হোঁচট খাওয়া থেকে রক্ষা পায়নি।
আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিনের বিপজ্জনক বিচ থেকে সাবধান!
তবে স্থানীয়রা এই পিচ্ছিল পথে হেঁটে চলছে নিবিড় অনায়াসে। নানা ধরনের গাজেট হাতে প্রযুক্তিবাজদের ছবি আর ভিডিও করারা অযাচিত ব্যস্ততা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে, চন্দনওয়ারিতে দেখা মিলবে আধো বরফ আচ্ছাদিত পাহাড় আর পাইন গাছের সমান্তরাল সমবায়, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ‘শেষনাগ’ লেক।
সেখানকার পাথরের গায়ে আছড়ে পড়া পানির শব্দ এতোটাই মোহনীয় যে, মনে হবে যেন এক অদৃশ্য সংগীত সুরকার প্রতিনিয়ত সুর তুলছে তার অদৃশ্য তানপুরায়। চন্দনওয়ারি থেকে পরের গন্তব্য আরু ভ্যালি। অনন্তনাগ শহর থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এটি পেহেলগাম থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে, লিডার নদী থেকে ১১ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেও আরু ভ্যালি সবুজ ও সুন্দরী। চারপাশ পাহাড় ঘেরা মাঝখানে সমতল উপত্যকা। ঘাষের প্রাচুর্যতার কারণে কাশ্মিরের সবচেয়ে বড় গোখাদ্য প্রক্রিয়াকরন স্টেশন এইখানে অবস্থিত।
আরও পড়ুন: প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসুন ‘মিনি মালদ্বীপ’
পর্যটন বাণিজ্যের প্রসার দেখা যাবে আরু ভ্যালিতে। জ্যাকেট, শাল, স্যুভেনিরসহ শীতের সব আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পাওয়া যায় আরু ভ্যালিতে। ঘোড়ায় চড়ে পুরো ভ্যালি ভ্রমণ করা যায়। স্থানীয় পোশাকে ছবি তোলার ব্যবস্থাও আছে সেখানে।
আরু ভ্যালির পর যাওয়া হলো হাজান ভ্যালি। ১৯৮৩ সালে বলিউডে মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় মুভি ‘বেতাব’ এর নামানুসারে এর নাম রাখা হয় বেতাব ভ্যালি। আয়তনে আরু ভ্যালির চেয়ে বড়, মনে হবে এক বিশাল সবুজ গালিচা। বিশাল পাহাড়ের মাঝে সমতল জায়গায় ঠাঁই করে নিয়েছে পাইন বন।
চন্দনওয়ারী থেকে এই পথে তীর্থযাত্রীরা অমারনাথ মন্দিরে যাত্রা করেন। উপরের যেই চূড়াগুলোতে এখনো কিছুটা বরফ রয়ে গেছে সেখান থেকেই এখনো বরফ গলে বেতাব ভ্যালির ভেতর দিয়ে এই স্রোত ধারা ছুটে চলছে লিডার নদীর দিকে। পাহাড়, নদী, উপত্যকা আর অপার নিস্তব্ধতা- প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এ যেন স্বর্গের পরশ।
পেহেলগামে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল বাইসারন ভ্যালি। কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামে থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাইসারন উপত্যকা একটি শীর্ষ দর্শনীয় স্থান হিসাবে বিখ্যাত। এর মনোরম সৌন্দর্যের কারণে মিনি-সুইজারল্যান্ড বলা হয়।
এটি একটি পাহাড়ের চূড়ার সবুজ তৃণভূমি যা ঘন পাইন বন তুষারবৃত পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। ঘোড়ায় চড়েও যাওয়া যাবে যার জন্য গুনতে হবে স্থানভেদে ৮০০-১২০০রুপি। প্রথমে ভাড়া একটু বেশি মনে হলেও পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের ‘হর্সরাইড’ মনে রাখার মতো দুর্দান্ত স্মৃতি।
আরও পড়ুন: সঙ্গীকে নিয়ে কম খরচেই ঘুরে আসুন বাংলার দার্জিলিং
কিছু বিখ্যাত পর্যটন পয়েন্ট যা আপনি বৈসারানের পথে দেখতে পারেন তা হলো- কানিমার্গ, পেহেলগাম ওল্ড ভিলেজ, কাশ্মীর ভ্যালি পয়েন্ট, ডাবিয়ান ও ডিওন ভ্যালি পয়েন্ট। আপনি এখান থেকে পেহেলগাম শহর ও লিডার ভ্যালির মনোরম দর্শনীয় স্থানগুলি উপভোগ করতে পারেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের এই বিখ্যাত অফবিট পর্যটন স্থানটি যারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে শান্ত সময় কাটাতে চান তাদের জন্য দুর্দান্ত। এটি তুলিয়ান লেকে যাওয়া ট্রেকারদের জন্য একটি ক্যাম্প সাইট হিসাবেও কাজ করে।
বাইসারন ভ্যালিতে ভেসে আসছিলো মাগরিবের আজান, এ আজানের ধ্বনিতে যেন আল্লাহর নির্মোহ আহবান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪৩৮ মিটার উচ্চতায় এই আজান শুনে মনে হবে সৃষ্টিকর্তা আর আপনার মাঝে অন্য কেউ নেই।পেহেলগামে সন্ধ্যা নামে একটু দেরিতে, আজানের পরও সূর্য তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
পাশের ঘন পাইন বনে টুকরো টুকরো আঁধার জমাট বাঁধে, এক পশলা কুয়াশা এসে স্নান করিয়ে দেয় পাইন গাছের প্রতিটি পাতাকে। সারাদিনের ধুলো আর জীর্ণতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এখানকার জলীয়বাস্পে ভরা হিমেল হাওয়া।
সারারাত ধরে চলে এই নিবিড় কর্মযজ্ঞ, সারিয়ে তোলে প্রকৃতির ক্ষত। আর তাই তো ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই পেহেলগাম হয়ে উঠে অপরূপা, পৃথিবীর স্বর্গ।
লেখক: শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
জেএমএস/জিকেএস