নারী নভোচারী হিসেবে প্রথমবার চাঁদে পা রাখবেন তিনি
সাইফুর রহমান তুহিন
মহাশূন্যে রকেট উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত নুজউদ ফাহুম মেরেন্সি। একজন গর্বিত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান নুজউদ মার্কিন মহাশূন্য গবেশনা কেন্দ্র নাসা’র (ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এক্সপ্লোরেশন মিশন প্ল্যানিং অফিসের প্রধান।
তাদের দায়িত্ব হলো মহাশূন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থার মহাকাশ অভিযানের মানোন্নয়ন করা। সংবাদমাধ্যমকে নুজউদ বলেন, ‘আবার মহাকাশ যাত্রার বিষয়ে আমি রোমাঞ্চিত বোধ করছি।’
বর্তমানে নুজউদ আর্টেমিস প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছেন। এটি মহাকাশ মিশনের একটি সিরিজ। এর মাধ্যমে আশা করা হচ্ছে চাঁদে আবার মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার।
নুজউদ বলেন, ‘এটি অনেক বড় ও ঐতিহাসিক বিষয়। কারণ বিগত ৫০ বছরে কেউ চাঁদের মাটিতে পা দেয়নি। নাসা’র বিখ্যাত অ্যাপোলো মিশনের মাধ্যমে শেষবার মানুষের চাঁদে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৭২ সালে।’
নুজউদ ও তার সহকর্মীরা আশা করছেন যে, গ্রিক উপকথায় অ্যাপোলোর দুই যমজ বোনের নামে নামকরণ করা আর্টেমিস আবার তাদেরকে চাঁদে নিয়ে যাবে।
এই কর্মসূচির প্রথম পর্যায় হচ্ছে আর্টেমিস-১ এর উৎক্ষেপণ যেটি হলো মনুষ্যবিহীন পরীক্ষামূলক রকেট, যা একদিন মহাকাশচারীও নিয়ে যাবে। কারিগরি ত্রুটি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এই প্রচেষ্টা কয়েকবার বিলম্বিত হয়েছে।
নাসা’র চেষ্টা সফল হলে ২০২৪ সালে পরবর্তী অভিযানে তারা রকেটের সঙ্গে মহাকাশচারী পাঠাবে ও তারা চাঁদের মাটিতে অবতরণ করবেন বলে নাসা আশা করছে।
নিজের কাজের জন্য নুজউদ এমনিতেই সুপরিচিত তবে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও একজন সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমকে নুজউদ বলেন, ‘আমি একজন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান, আর আমার বাবা এসেছেন নাসরত থেকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন কলেজে পড়ার জন্য ও এরপর থেকে যান। এদেশেই আমার মায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর আমার জন্ম হয় এদেশে।’
নুজউদ তার শিকড় নিয়ে গর্ববোধ করেন ও চেষ্টা করেন পিতার জন্মভূমির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। যদিও তার নিজের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিাঞ্চলীয় ওয়াশিংটনে।
নুজউদ বলেন, ‘ফিলিস্তিনে আমার ঘনিষ্ঠ অনেকেই আছেন। চাচা-ফুফু, মামা-মামী, চাচাতো-ফুফাতো, মামাতো-খালাতো ভাই-বোন আছেন সেখানে। আর এ কারণেই আমি সেখানে ঘুরতে যেতে ভালোবাসি।’
২০১৯ সালে নুজউদের ফিলিস্তিনি পরিচয় অনেকটা ভাইরাল হয়ে যায়। নাসা’র একটি অফিসিয়াল পোট্রেট তিনি টুইটারে পোস্ট করেন, যেখানে তার পরনের ব্লেজারে ছিলো ফিলিস্তিনি অ্যাম্ব্রোয়েডারি কারুকাজ। অনেকেই অনলাইনে এটি শেয়ার করেন ও শুভেচ্ছাও জানান।
সম্প্রতি নুজউদ তার হ্যাশট্যাগ ‘ইয়ালা টু দ্য মুন’ চালু করেন আর্টেমিস-১ এর প্রথম উড্ডয়নকে সামনে রেখে গত ২৯ আগস্ট। ‘ইয়ালা’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হলো ‘চলো যাই’।
প্রযুক্তি বিজ্ঞানের দিকে তার ঝুঁকে পড়া ও শেষ পর্যন্ত নাসা’র সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার জন্য নুজউদ তার দক্ষ প্রকৌশলী বাবার অবদানের কথা স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে পরিচয়টা আমি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি।’
নাসায় তার কাজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি বেশ বড় রকমের ধাঁ-ধাঁ। অনেক আগেই এসব জিনিসের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব আমার বাবার।’
নাসা’র সঙ্গে নুজউদের যাত্রা শুরু হয় প্রায় দুই দশক আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করার পরই। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে তিনি প্রথম কাজ করেন নাসার রকেটের উপরিভাগে থাকা ক্রাফট ওরিয়ন নিয়ে যা কি না একদিন মহাকাশচারীদের নিয়ে চাঁদে যাবে।
এক্সপ্লোরেশন প্ল্যানিং মিশন অফিসে নুজউদের বর্তমান ভূমিকা হলো আর্টেমিসের মিশনের মানোন্নয়নে কাজ করা। তিনি বলেন, ‘অফিসে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি টিম লিডার হিসেবে আমি সব কর্মসূচি নিয়ে ও আর্টেমিস উড্ডয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহনগুলো নিয়ে কাজ করছি।’
নাসা আশা করছে যে, আর্টেমিস মিশনগুলোর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো চাঁদে নারী নভোচারীর পা পড়বে। এ প্রসঙ্গে নুজউদ বলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়ে গেলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাকাশযাত্রা তুলনামূলক সহজ হবে।’
নুজউদ বলেন, ‘ষাটের দশকে মহাকাশচারীদের প্রায় সবাই ছিলেন ককেশিয়ান পুরুষ। তখন এটিই ছিলো খুব সাধারণ ব্যাপার। এখন নাসার মহাকাশচারীদের জাতিসত্তার দিকে ও আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমাদের আছে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সমন্বয় কারণ, নাসা বেছে নেয় যোগ্যদেরকেই।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘বৈচিত্র্যপূর্ণ মহাকাশচারী দল নিয়েই শুধু আমরা চাঁদের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছি না, আমরা চাঁদকে আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। এমন কিছু মানুষ নিয়ে যারা মানবতার সব শাখার প্রতিনিধিত্ব করে। আর এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
নুজউদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, সময়ের পথ পরিক্রমায় মহাকাশ গবেষণার খরচের বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে নতুন নতুন দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এক্ষেত্রে বেশ সক্রিয় হয়েছে।
ষাটের ও সত্তরের দশকে অ্যাপোলো মিশনগুলোর ব্যয় ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ফেডারেল বাজেটের মোট পাঁচ শতাংশ, যা ছিলো বিশাল ও অসাধ্য একটি অংক। এখন মার্স রোভার, আবহাওয়া বিষয়ক স্যাটেলাইটসমূহ ও অবশ্যই আর্টেমিস-১ সবকিছুই চলছে মোট বাজেটের এক শতাংশেরও কমে।
তুলনামূলক সহজলভ্য প্রযুক্তি অন্যান্য দেশকে সুযোগ করে দিয়েছে মহাকাশ গবেষণা কর্মসূচি হাতে নেওয়ার। এর মধ্যে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মহাকাশ অভিযান শুরু করেছে। আর এ কারণেই নাসা নিয়মিতভাবে ও পরিবেশবান্ধবভাবে মহাকাশে মহাকাশচারী পাঠানোর আশা করছে।
নুজউদ বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উদীয়মান আরও দেশকে মহাকাশ গবেষণায় এগিয়ে আসতে দেখে আমি রোমাঞ্চিত যেখানে তারা (সংযুক্ত আরব আমিরাত) মঙ্গল গ্রহে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। এটি বিস্ময়কর যে, বর্তমানে যা ঘটছে তা ৫০ বছর আগেও সম্ভব ছিলো না যখন শেষবারের মতো চাঁদে মানুষের পদচিহ্ন পড়েছিলো।’
সব কথার শেষ কথা হলো, শেষবার চাঁদে মানুষের পা ফেলার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। নুজউদ বলেন, ‘আমরা প্রায়ই বাবা কিংবা দাদাদের কাছে শুনেছি যে, নিল আর্মস্ট্রংকে তারা চাঁদের মাটিতে হাঁটতে দেখেছেন সাদাকালো টিভির পর্দায়। তবে আধুনিক প্রজন্মকে এটি বুঝানো একটু কঠিন। শেষবার মানুষ চাঁদে গিয়েছে ১৯৭২ সালে যেটি আমাকে সুদূর অতীতে নিয়ে যায়।’
‘এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আমি কাজ করেছি যারা আলাপ করতেন, অতীতে তারা কেমন ছিলেন ও কীভাবে তারা নিল আর্মস্ট্রংকে চাঁদের বুকে হাঁটতে দেখেছেন। আর আমি তো এগুলো পড়েছি বইপত্রে। সময় এখন আমাদের। আর কোনো ইতিহাস বই পড়া নয়, আমরা ইতিহাস গড়তে যাচ্ছি।’
সূত্র: দ্য নিউ আরব
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও ফিচার লেখক
জেএমএস/এএসএম