ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

থাইল্যান্ড ভ্রমণ: আন্দামান সাগরের দ্বীপগুলো

ভ্রমণ ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৫৮ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০২২

কামরুল হাসান

আমি রোমান্সের জন্য ভ্রমণ করি, জানার জন্য ভ্রমণ করি এবং ভ্রমণ করি হারিয়ে যাওয়ার জন্য। মুঠোফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার জন্য। তৈরি হয়ে নিচে নামলাম ব্রেকফাস্ট করতে। হোটেল মেরিনার ব্যুফেট ব্রেকফাস্টটাও অসাধারণ। মনে রাখার মতো। নাস্তা সেরে অপেক্ষা করছিলাম রুমে এসে। তখনই কল এলো রিসিপশন থেকে, লবিতে আমাদের ট্যুরের গাইড অপেক্ষা করছেন। একদম ঠিক টাইমে হোটেল লবি থেকে তারা মাইক্রোবাসে আমাদের উঠিয়ে নিলেন। গাড়িতে আমরাই শেষে উঠেছি। বাকিরা আগেই বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠেছেন। গাড়ি নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে শহর পেরিয়ে এলো। প্রায় ৪০ মিনিট পর ফুকেট হারবারে এসে পৌঁছলো। গাইডকে অনুসরণ করে সবাই চলে গেলাম এজেন্সির অফিসে। হালকা ব্রেকফাস্ট ছাড়াও চা-কফির ব্যবস্থা ছিল কমপ্লিমেন্টরি। আমাদের রহস্যময় চরিত্রের গাইডের দিকনির্দেশনায় সবাই বুদ হয়ে ছিলাম ১০ মিনিট। তারপর এজেন্সির স্টাফের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হারবার টিকিট পুশ করে একে একে সবাই গিয়ে বসলাম নির্ধারিত স্পিড বোটে।

চারদিকে সমুদ্র, তার মাঝে দ্বীপ। নির্জনতার মাঝে প্রবাল পাথর আর ধুয়ে যাওয়া বালুরাশির ওপর সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে শুভ্র ফেনা তুলে। কখনো ধীরে, কখনো জোরে বয়ে যায় সমুদ্র ছুয়ে আসা বাতাস। সে বাতাসের সাথে ভেসে আসে সমুদ্রের গর্জন। এ যে এক অন্যরকম অনুভূতি। স্পিড বোটে চড়ে আন্দামান সাগরের ছোট ছোট দ্বীপগুলো ঘুরে দেখার জন্য যাত্রার ২ ঘণ্টা পরে আমাদের বোট এসে নোঙর করলো এখানে। মায়া বে-তে। নিঃসঙ্কোচে বলা যায় যে, মায়া উপসাগরে এসে এটাকে আমার কাছে স্বর্গের টুকরো মনে হয়েছে। চারদিকে পানি আর পানি। গাঢ় নীল আকাশ এখানে পানি ছুঁয়েছে যেন। সাগরের নীল পানি আর আকাশের নীলের মিতালিতে নীলে নীলে মিলেমিশে স্বপ্নীল এক দ্বীপ। এটি রঙিন প্রবাল এবং প্রচুর বিদেশি মাছে ভরা স্বচ্ছ পানির দ্বীপ। বোট থেকে নেমে সরু পথ ধরে লাইনে হাঁটতে হয়। একটি সবুজ পথ ধরে সুন্দর গাছ-গাছালির প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বিচের দিকে। ২০১৮ সালে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সাড়ে তিন বছর বন্ধ থাকার পর, মায়া বে ২০২২ সালে আবারও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে আবার।

jagonews24

সরু কাঠের ট্রেইলে পাঁচ মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম বোট যেখানে নামিয়ে দিয়েছে ঠিক তার উল্টো পাশে। ‘দ্য বিচ’ মুভি দ্বারা সারা দুনিয়ায় বিখ্যাত হওয়া মায়া বে বিচে। এখন পর্যন্ত আমার দেখা অন্তত ৩৫-৪০টি বিচের মাঝে এতটা বিস্ময় নিয়ে কখনো কোনো সৈকতের পাড়ে দাড়াইনি। মায়া বে আন্দামান সাগরের থাইল্যান্ডের ক্রাবি প্রদেশের মালাক্কা প্রণালিতে অবস্থিত এবং হাট নপফরাত থারা-মু কো ফি ফি ন্যাশনাল পার্কের একটি অংশ। তিন দিকের আকাশচুম্বী ক্লিফ দ্বারা বেষ্টিত, উপসাগরে অনেকগুলো সৈকত রয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই ছোট এবং শুধুমাত্র ভাটার সময় দৃশ্যমান হয়। স্বচ্ছ নীল জলরাশির নির্মল শান্ত কাঁচের মতো জলে এ সৈকতের এপাশটায় কোনো নৌকা বা জাহাজ ভেড়ানোর অনুমতি নেই। এর অর্ধচন্দ্রাকৃতির সৈকতটি ছিল বিশুদ্ধ সাদা এবং আবর্জনামুক্ত। যে মুহূর্তে আমি মায়া বে বিচে পা রেখেছিলাম, অসম্ভব রকমের প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। বিচের বালি এত সাদা এবং এত সূক্ষ্ম, আর দুপাশের চুনাপাথরের পাহাড়ের দৃশ্য, স্বচ্ছ জলের লেগুনকে আলিঙ্গন করা, চোখ যেন বুজে আসছিল।

বেশ কিছু সময় এখানে কাটিয়ে ভিন্ন পথ ধরে এলাম বোটে। রৌদ্রতেজ বাড়ছে। বোটের কিছু কিছু নারী এবং বাচ্চা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার নিজের অস্বস্তি লাগছিল গরমে। দ্বিতীয় স্টপেজ ছিল অত্যাশ্চর্য পাই লেহ লেগুন। সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে ছোট উপসাগরে টেনে আনাকে জাদুকরী বলা যেতে পারে! সমুদ্রের মাঝের এই দ্বীপের ভেতরে গুহার মতো জায়গায় অন্য কয়েকটি বোটের সাথে আমাদের বোটটাকেও নোঙর করা হলো। প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম নিয়ে ৩০ মিনিট সময় বেঁধে দিলো এ ব্লু লেগুনে সুইমিং করার জন্য। এখানকার পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, আক্ষরিক অর্থে স্বচ্ছ নীল জল লেগুনকে আলোকিত করছে মনে হয়। সুইমিং শেষে বোটে উঠে এলেন একে একে সবাই। এখান থেকে আমরা যাচ্ছি কোহ ফি ফি ডনে। আর ফেরার পথে মাঙ্কি বিচ এবং লং বিচে নামলাম কিছু সময়ের জন্য। তবে মাথা থেকে আমার মায়া বে বিচ কাটছে না। মায়া বে বিচে দাঁড়িয়ে আপনার কেবল এটাই মনে হবে যে, অভিয়াসলি থাইল্যান্ড ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পার্ট ছিল মায়া বে বিচ ভ্রমণ।

jagonews24

সূর্য মাথার ঠিক ওপরে। প্রচণ্ড তাপদাহে ত্রাহিত্রাহি অবস্থা আমাদের। স্পিড বোট এত দ্রুত ছুটে চলছে যে, প্রচুর ঝাঁকির কারণে দু’পাশের দৃশ্য উপভোগ করা কিংবা ছবি উঠানো একটু মুশকিল! খোলা সমুদ্রে রোদের তেজ অনেক বেশি। সানগ্লাস এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করাটা খুব জরুরি। আমাদের বোট নোঙর করেছে ফি ফি আইল্যান্ডে। এখানে আমরা লাঞ্চ করে বিশ্রাম নেবো কিছু সময়। আমাদের গাইডের পথ অনুসরণ করে আমরা ফি ফি আইল্যান্ডের বিচের লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্টের তেতলায় উঠে গেলাম। ফ্রেস হয়ে আগে থেকে সাজিয়ে রাখা ব্যুফেটে লাঞ্চ সেরে নিলাম। কিছুটা সময় বসে নেমে এলাম নিচে। রেস্টুরেন্টের সামনে সৈকতের কোলে দোলনা বাঁধা। বসলাম সমুদ্রকে সামনে নিয়ে। পেছনের চাকেয়ার বন দ্বীপটিকে করেছে মোহনীয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে নীলের মাঝে এক চিলতে ফোটা, যেন সমুদ্রের কপালে একটি সবুজ টিপ। দ্বীপটা থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে ক্রাবি প্রভিন্সে পড়েছে। আন্দামান সাগরে অবস্থিত ফি ফি’র আশেপাশে আরও কিছু ছোট ছোট আকর্ষণীয় দ্বীপ আছে।

ফি ফি ডন ও ফি ফি লে মিলে এই আইল্যান্ড। এখানকার চারপাশের মনোরম পরিবেশ যে কোনো পর্যটকদের জন্য মনোমুগ্ধকর। যে কেউ এখানে গেলে এর নীলচে সবুজ পানির সৌন্দর্যে হারিয়ে যাবে। চাইলে ফুকেট সরাসরিও এখানে আসা যায়। ফুকেট থেকে প্রতিদিন ক্রুজ চলাচল করে এই আইল্যান্ডে। এখানে স্নোরকেলিং, সার্ফিং, ডাইভিং ইন শার্ক পয়েন্ট, এনেমনে রীফ এবং কিং ক্রুইসার রিফের মতো কিছু এক্সাইটিং ও রোমাঞ্চকর রাইডের অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। আমাদের গাইড ঘুরিয়ে দেখাল দ্বীপের কিছুটা অংশ। মার্কেট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট সবই রয়েছে এখানে। এখান থেকে আবার বোটে করে চলে গেলাম আরেকটা দ্বীপে। দ্বীপের এই অংশে সমুদ্রের মধ্যে সুইমিং এবং স্নোরকেলিংয়ের সুযোগ আছে। এর মধ্যে স্নোরকেলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট যেমন লাইফ জ্যাকেট, গগলস, পাইপ এসব দেওয়া হয়েছে। ক্যামেরাটা মারুফ ভাইয়ের হাতে দিয়ে সাতপাঁচ না ভেবেই বোট থেকে ঝাঁপ দিলাম পানিতে। স্নোরকেলিংয়ের অভিজ্ঞতাই অনেক ইন্টারেস্টিং। বিশেষ করে স্নোরকেলিং করে সমুদ্রের পানির নিচের প্রবাল, রঙিন মাছের ছোটাছুটি দেখতে অন্যরকম ভালো লাগা ও আনন্দ কাজ করে।

jagonews24

সারাদিন স্পিড বোটে করে আন্দামান সাগরে টইটই করে, ডি ক্যাপ্রিওর ‘দ্য বিচ’ মুভির বিখ্যাত মায়া বে, মাঙ্কি বিচে সুইমিং, ফি ফি আইল্যান্ডে ব্যুফে, খাই আইল্যান্ডে স্নোরকেলিং, ঘুরে টুরে বিকেলে হ্যাপি আইল্যান্ডে এসে থামলাম আবার। এখানে এসে ডাব খেলাম। জেটস্কি করলাম মন ভরে। শেষে ভালোভাবেই ট্যুরটা শেষ হয়েছিল। ট্যুরে পিক অ্যান্ড ড্রপ ব্যবস্থা থাকায়, রাত ৮টার দিকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেল। ফুকেটে গেলে এই ডে ট্রিপটা অবশ্যই করবেন। মাস্ট ডু থিং আরকি। ফাইন্যালি, হাতে যদি যথেষ্ট সময় থাকে তবে আমি সাজেস্ট করব আপনি ফুকেট, ফি ফি, ক্রাবি ঘুরে আসবেন। অবশ্যই সময় নিয়ে যাবেন ৩টা জায়গাতেই। ফি ফি আইল্যান্ডে কমপক্ষে একরাত থাকুন, একইভাবে ক্রাবি আইল্যান্ডেও। সম্ভব হলে ২-৩ রাত করেও কাটাতে পারেন। লং টেইল্ড কাঠের বোটে করে আশেপাশের স্পটগুলো ঘুরে দেখুন। সুইমিং, স্নোরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং, কায়াকিং করুন। যারা ফি ফি আইল্যান্ডে রাত কাটাবেন, তাদের জন্য আরেকটা ভালো সাজেশন হতে পারে আপনি যদি ফুকেট হয়ে যান, তবে ক্রাবি হয়ে ব্যাক করুন। আর ক্রাবি হয়ে গেলে ফুকেট হয়ে ব্যাক করুন। টাকা দিতে না পারলেও গ্যারান্টি দিচ্ছি, বোরিং হবেন না।

সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে কিছুটা সময় রেস্ট করলাম। সারাদিন অনেক ধকল গেল। কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। তবে হাতে সময় কম। শুয়ে থাকাও যাবে না। তাই রেডি হয়ে আবার বের হলাম। ফুকেট পাতং ঘুরে দেখবো আবার। তবে সবচেয়ে ভালো হতো একটা বাইক ভাড়া নিলে, যা এখানে সহজেই পাওয়া যায়। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারতাম ফুকেট ভিউ পয়েন্ট থেকে। ৩০-৪০ মিনিটের পথ বেশ অ্যাডভেঞ্চার আছে। একপাশে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা আর একপাশে সমুদ্র। রোমাঞ্চকর খুবই। চলে গেলাম হাতের কাছেই পাতং বিচে। বিচটা এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভাবাই যায় না। বিচের সাথেই বাংলা রোড। ফুকেটের নাইট লাইফ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এলো। ফুকেট জেগে উঠল। চাকচিক্যময় আলোর ঝলকানি চারদিকে। বিভিন্ন ধরনের ইভেন্টে পুরো সৈকত যেন বিনোদনের আবাসস্থল। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই, নেই কোনো বাধা-বিপত্তি। সবাই যার যার মতো উপভোগ করছে। রাতটা শেষ হয় এভাবেই। সন্ধ্যার পর পাতং যেন অন্য এক জগৎ। নাচ, গান, সুরের ঝংকার, খানাপিনা আর রং-বেরঙের আলোয় উৎসবের আমেজ। সন্ধ্যায় ফুকেট টাউনের দিকে গিয়ে পেলাম শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, স্ট্রিট ফুড। ঘুরতে ঘুরতে শপিং করে ফেললাম।

jagonews24

পরদিন খুব ভোরে ফুকেট থেকে ব্যাংককের পথে আমাদের ফ্লাইট। আগের সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কল করে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে রাখলাম। চমৎকার এ হোটেল মেরিনার ব্যুফে ব্রেকফাস্ট সেরে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। ফুকেট এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে একঘণ্টা জার্নির পর পৌঁছলাম ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট। আজ থেকে বিশ বছর পর আমি এই ভেবে হতাশ হতে চাই না যে, আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল, তা করতে পারিনি। তাই নতুন দেশ আর নতুন শহর আবিষ্কারের জন্য যাত্রা শুরু করছি। নতুন দেশের স্বপ্ন দেখছি এবং স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ছুটে চলছি। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে আমার এবারের যাত্রা কম্বোডিয়ার পথে। এবার যাচ্ছি কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। অপেক্ষায় থাকুন নতুন দেশের, নতুন শহরের, নতুন গল্পের।

চলবে...

লেখক: ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও, মেডিস্টোরবিডি ডটকম।

আগের পর্ব
১. থাইল্যান্ড ভ্রমণ: ব্যাংককের নানা রং
২. থাইল্যান্ড ভ্রমণ: ফুকেট ও পাতং সৈকতের রূপ

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন