ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

কোরিয়ার সীমান্তে যা আছে দেখার

ভ্রমণ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৪:০৯ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০২২

ব্রি জে (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন

সকালে হোটেলে নাস্তা সেরে রওয়ানা হলাম। বেশ সুন্দর ঝকঝকে সকাল, স্বচ্ছ নীল আকাশ ও সূর্যের গোলাপি আলোতে চারদিক ঝলমল করছে। সিউল থেকে উত্তরে এই সীমান্ত এলাকা। সিউল শহর থেকে কোরিয়ার সীমান্তের দিকে আমাদের মাইক্রো চলছে। গন্তব্য বিএমজেড (কোরিয়ান ডিমিলিটারাইজড জোন)।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে এই স্থানে আসতে। সীমান্ত পূর্ব পশ্চিমে পেনিনসুলার বুক চিরে চলে গেছে। কোরিয়ার যুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা ৩৮ প্যারালাল বরাবর যতটুকু দখল নিয়েছিল সেখানেই সীমান্তের কাঁটাতারের বিভাজন।

শহরের বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা হান নদীর পাড়ে চলে এলাম। নদীর পাড় ঘেঁষে রাস্তা, নদী বেশ প্রশস্ত। নদীর ওপারেও দক্ষিণ কোরিয়ার জনপদ আছে। সেখানে যোগাযোগের জন্য নদীর উপর ব্রিজ আছে।

অনেক ট্রাফিক চলাচল করছে ব্রিজ দিয়ে। এক সময় নদী এঁকেবেঁকে উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে ঢুকে পড়ে। এদিকে বনায়ন ও গাছগাছালি থাকলেও ওপাশে উত্তর কোরিয়ার অংশের পাহাড়গুলো একদমই ন্যাড়া।

নদীর সমান্তরালে রাস্তা দিয়ে আমরা চলছি। এদিকে রাস্তার এখন ট্রাফিক কম। রাস্তা বাঁক নিয়ে নদীর কাছাকাছি ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। ব্রিজের গোড়াতে সীমান্ত প্রহরীদের চৌকি, সামনে নদী, নদীর উপর ব্রিজ।

jagonews24

ব্রিজে উঠতেই দেখলাম কোরিয়ান ও ইংরেজি অক্ষরে লেখা দুই কোরিয়া একত্র হওয়ার বিষয়ে প্রেষণামূলক ব্যানার। এখানে আমাদের পাসপোর্ট চেক করলো, আমরা মাইক্রোতেই বসেছিলাম। আমরাও প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ব্রিজের উপর উঠলাম।

নদীর ওপারে এখন আর উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত পিলার নেই, তা একটু দূর দিয়ে গেছে। আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার সীমানার ভেতর দিয়েই নদী পার হয়ে এগিয়ে চলছি। চেক পোস্টে কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এদের অনেকেই বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী বা মেরিন কোরে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী মাস্টার্স বা উচ্চতর পড়াশোনা করার আগে কমপক্ষে ২২ মাস বাধ্যতামূলক এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়।

jagonews24

এই প্রশিক্ষণ ও দায়িত্ব পালন শেষে তারা আবার পড়াশোনাতে ফিরে যায়। তারা বেশ সুন্দর উচ্চারণে ইংরেজি বলেন। যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অনেকে দোভাষী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ডিএমজেডে এ রকম অনেক সৈনিকের সঙ্গে দেখা হলো। উত্তর কোরিয়াতেও সব যুবক-যুবতীকে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে কমপক্ষে ১০ বছর চাকরি করতে হয়। দুই কোরিয়াই তাদের যুদ্ধবস্থানে থাকার কারণে সব নাগরিকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা একটি ভবনের সামনে দাঁড়ালাম। সেখানে পর্যটকদের বাস রাখার জায়গা আছে। একেক দল করে ভবনের ভেতর নিয়ে যায়। বাকিরা বাসে অপেক্ষা করেন। প্রতিটি বাসে একজন সৈনিক গার্ড থাকেন। তার সঙ্গে বেতার যোগাযোগ রাখে ভবনের ভেতরের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র।

কিছুক্ষণ পর আমাদের ডাক এলো। লাইন ধরে অডিটোরিয়ামে গেলাম। সবাই বসার পর একজন সৈনিক এসে অভিবাদন জানালেন। আমাদেরকে একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এটি কোরিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত।

এই ছবিতে বর্তমানে কোরিয়ার অবস্থা ও দক্ষিণ কোরিয়া দুই কোরিয়াকে এক করার জন্য যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তা দেখানো হলো। তাছাড়া জাতিসংঘ বাহিনীর কার্যক্রম সম্বন্ধেও ধারণা দিলো।

তারপর কোরিয়ার যুদ্ধের উপর সুন্দরভাবে সাজানো মিউজিয়ামে নিয়ে গেলো। সেখানেখুব সুন্দরভাবে ডিজিটাল ও ছবি দিয়ে সাজিয়ে কোরিয়া যুদ্ধের সব বর্ণনা, ইউএন এর কার্যক্রম, যুদ্ধের পরবর্তী সব ঘটনা সুন্দরভাবে দর্শক ও পর্যটকদের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

jagonews24

এরপর বাইরে এসে আবার বাসে ওঠা। ডিএমজেড এর ভেতরে ঘোরার জন্য কোরিয়ার সরকারের নিজস্ব বাস আছে। পর্যটকদের গাড়িগুলো পার্কিংয়ে রেখে এসব বাসে উঠতে হয়। এই বাসগুলো সাধারণত দুটো একসঙ্গে চলে। প্রতিটি বাসে ওয়াকিটকি হাতে একজন সৈনিক গাইড থাকেন।

আমাদের বাসের সৈনিককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আছেন নাকি রেগুলার সৈনিক। তিনি জানালেন, কোরিয়াতে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন, এখন উচ্চতর প্রশিক্ষণে কানাডাতে যাবেন। এক মাসের মধ্যেই তার এই ট্রেনিং শেষ হতেই সেখানে চলে যাবেন।

বাসে বসে আমরা দুই কোরিয়ার সীমান্তের দিকে চলেছি। পথে চাষের জমি দেখলাম। এটি নো ম্যানস ল্যান্ড এর এলাকা। এখানে অর্ধেক ভাগ উত্তর কোরিয়ার ও অর্ধেক অংশ দক্ষিণ কোরিয়ার। গাইড জানালেন, এখানে নো ম্যানস ল্যান্ডে দুই কোরিয়ার দুটো গ্রাম আছে। গ্রামগুলোতে তাদের নিজের দেশের পতাকা ওড়ে।

উত্তর কোরিয়ার এই গ্রামে সবচেয়ে বড় ও উঁচু পতাকা উড়ায় তারা। গাইড আরও জানালেন, উত্তর কোরিয়ার গ্রামটির নাম প্রেপাগান্ডা। এখানে মানুষ থাকে না শুধু চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য ঘরবাড়ি বানানো আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গ্রামে বেশ কিছু পরিবার আছে। তারা এই এলাকায় জমি চাষ করে।

সরকার তাদেরকে এই জমি লিজ দেয়। তবে এই ফসল থেকে পাওয়া লাভে সরকারকে কোন ট্যাক্স দিতে হয় না তাদের। যে কোনো সময় মূল দেশে যেতে চাইলে যাওয়ার অনুমতিও আছে তাদের। এই গ্রামের পরিবারগুলো সব সময় বিপদের মধ্যে থাকে বলে তাদের কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না।

তাদের শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নেই। তবে তারা যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায় তবে তা পারবে। অনেক গ্রামবাসী এখানে থাকতে চায় কারণ এটা তাদের আদি নিবাস।

jagonews24

রাস্তা এঁকে বেঁকে চলছে দূরে আমরা উত্তর কোরিয়ার গ্রামের বাড়ি-ঘর দেখছিলাম। মানুষের চলাফেরা তেমন দেখা যায় না। কিছুক্ষণ পর আমাদের বাস একটা বড় ভবনের সামনে দাঁড়ালো। ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে সৈন্যরা অস্ত্র হাতে ডিউটি করছেন।

একটি রুম পেরিয়ে আরেক দরজা দিয়ে বাইরে এলাম। প্রথমে বারান্দা তারপর আবার সিঁড়ি নেমে গেছে রাস্তায়। রাস্তার অন্য পাড়ে একটু দূরে দূরে চারটি টিনের চালা দেওয়া ঘর। এই ঘরের অর্ধেক উত্তর কোরিয়াতে ও অর্ধেক দক্ষিণ কোরিয়াতে। মাঝের দুটো ঘর দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ও দু’পাশের দুটো ঘর উত্তর কোরিয়ার।

এই ঘরগুলোর ভেতর দুই কোরিয়ার মাঝে শান্তি আলোচনা বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হয়। আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার একটা ঘরে গেলাম। সেখানে একটা টেবিলে দক্ষিণের প্রতিনিধিরা বসে ও এই টেবিলের অন্য পাশে উত্তর কোরিয়া। জানালা দিয়ে বাইরে দেখলে দেখা যায় দুই কোরিয়ার সীমানা সিমেন্টের মোটা রেখা দিয়ে আলাদা করা।

উত্তর কোরিয়ার দিকের দরজায় আমরা গেলাম সেখানে একজন সৈনিক কর্তব্যরত। তাকে অতিক্রম করা যাবে না, এমনই সতর্কবার্তা লেখা আছে। এই ঘর থেকে বের হয়ে আশপাশের ছবি তুললাম। এই ঘরগুলোর ফাঁকে দেখা গেল, উত্তর কোরিয়ার অংশে প্রায় একই রকম বিল্ডিং আছে। সেখানে উত্তর কোরিয়ার সৈনিকরা পাহারারত।

তারা একে অপরের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন না, এমনই নির্দেশ তাদের জন্য। এসব নিয়ম কানুন ইউএন ও আমেরিকা দিয়ে রেখেছে। সরকারও তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী।

আমাদের মনে হয়, দুই কোরিয়াতেই যদি সুপার পাওয়ার চীন ও আমেরিকার উপস্থিতি না থাকতো তাহলে অনেক আগে তারা এক হতে পারতো। এই অবস্থা চললে তারা আরও বহু বছর এভাবেই বিভক্ত থাকবে। চলবে...

জেএমএস/এমএস

আরও পড়ুন