ব্রুনাই সুলতানের ১৭৮৮ কক্ষের সোনায় মোড়ানো প্যালেসে যা যা আছে
একটি বিশাল বাড়ি বা রাজপ্রাসাদে বাস করার স্বপ্ন দেখেন সবাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরকা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ ধনী ব্যক্তিদের বিলাসবহুল বাড়িগুলো সবাইকে হতবাক করে। তাহলে ভেবে দেখুন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও দামি বাড়িটি কেমন হবে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও দামি বাড়ির অবস্থান ব্রুনাইয়ে। প্রাসাদটির অবস্থান ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানের কাছাকাছি।
সোনায় মোড়ানো বাড়িটি রেকর্ড গড়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে। এই বাড়ির চাকচিক্য আপনাকে যেমন বিস্মিত করবে তেমনই করবে মুগ্ধ। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম এই বাড়ির নাম ‘ ইস্তানা নুরুল ইমান’।
এই বাড়ির মালিক কে?
ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহ এই রাজকীয় বাড়ি নির্মাণ করেন। ব্রুনাইয়ের ২৯তম সুলতান হাসানাল বলকিয়ার আবাসিক ভবন এটি।
বিশ্বের বৃহত্তম প্রাসাদ হওয়ার পাশাপাশি, ‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। সদ্য সমাপ্ত ২৮তম এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপিইসি) অর্থনৈতিক নেতাদের বৈঠক এই বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ পরিচিতি
১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ। যদিও সুলতান যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট থেকে ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষিত ব্যক্তি।
তিনি একজন বিদ্বেষপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর দীর্ঘতম রাজত্বকারী রাজা হলেন ব্রুনাহ সুলতান বলকিয়াহ। ২০১৭ সালে তার রাজত্বের সুবর্ণ জয়ন্তী (৫০ বছর) উদযাপিত হয়।
ব্রুনাই একটি ছোট দেশ হলেও, এ দেশের সুলতান অত্যন্ত শক্তিশালী ও ধনী একজন ব্যক্তি। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ফোর্বসের তথ্য অনুসারে, বলকিয়াহর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১.৪ লাখ কোটি (২০ বিলিয়ন ডলার) টাকা।
হাসানাল বলকিয়াহর খরচ সম্পর্কে ধারণা দিতে টাইমস ইউকে’র এক প্রতিবেদন উল্লেখ করে, সুলতান চুল কাটাতেই প্রায় ২০ হাজার ডলার (১৫ লাখ টাকা) খরচ করেন।
‘ইস্তানা নুরুল ইমানের’ ইতিহাস
উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের জেমস ব্রুক অপ্রত্যাশিতভাবে ব্রুনিয়ান সাম্রাজ্যের ৫০০ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটান। ব্রুনাই ১৮৪০-১৯৮০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসিত ছিল। পরবর্তী সময়ে জাপানি দখলদারিত্ব ও অবশেষে আবার ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৭০ সালের শেষদিকে স্বাধীনতা পায় দেশটি।
সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন তৃতীয় ও তার পুত্র (বর্তমান সুলতান, হাসানাল বলকিয়া) ব্রুনিয়ানদের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করার জন্যই দুর্দান্ত এই ‘জাতীয় প্রাসাদটি’ নির্মাণ শুরু করেন।
বলকিয়াহ ১৯৮১ সালে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে নতুন করে এটি আবাসিক প্রাসাদ হিসেবে তৈরি করেন। তখনো অবশ্য ব্রুনাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ছিল। ১৯৮৪ সারের ১ জানুয়ারি অবশেষে ব্রুনাই ইংল্যান্ড থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর পরপরই চালু হয় প্রাসাদটি।
বলকিয়াহ তার দুর্গের নাম দেন ‘ইস্তানা নুরুল ইমান’। যার অর্থ ‘বিশ্বাসের আলোর প্রাসাদ’। ইংরেজিতে একে ‘দ্য লাইট অব ফেইথ প্যালেস’ বলা হয়।
বিশ্বের বৃহত্তম এই আবাসনে আছে যেসব সুযোগ-সুবিধা
‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ এর অবস্থান ২ লাখ বর্গ মিটার এলাকাজুড়ে। ১৭৮৮ কক্ষবিশিষ্ট এই প্যালেসে আছে ২৫৭টি বাথরুম, একটি ব্যাঙ্কুয়েট হল (৫০০০ মানুষের ধারণক্ষমতা), ১১০টি পার্কিং স্পেস।
আরও আছে ২০০টি পোলো ঘোড়ার জন্য একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আস্তাবল, ৫টি সুইমিং পুল, একটি হেলিকপ্টার ও একটি সুন্দর মসজিদ।
প্রাসাদের মসজিদে একসঙ্গে দেড় হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারবেন। ৩৮ ধরনের মার্বেল পাথরদিয়ে নির্মিত হয়েছে এই মসজিদের ৪৪টি সিঁড়ি।
জানা যায়, ‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ তৈরি করতে দুই বছর লেগেছিল। প্রাসাদটির বর্তমান আনুমানিক মূল্য ২,৫৫০ কোটি টাকারও বেশি।
যদিও ‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল, তবে এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়ি নয়। সেই সম্মান বাকিংহাম প্যালেসে যায়, যার মূল্য ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
লিওনার্দো লোকসিন দ্বারা ডিজাইন করা হয় এই বাড়ি। প্রাসাদের সম্মুখভাগ সাদা, সোনার গম্বুজ (প্রাসাদের গম্বুজ ২২ ক্যারেট সোনা দিয়ে ঘেরা) ও খিলানযুক্ত ছাদ ব্রুনাইয়ের ইসলামিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।
দুবাইয়ের বুর্জ আল আরবের অন্যতম ডিজাইনার খুয়ান চিউ প্রাসাদের অভ্যন্তরের নকশা করেন। বিশ্বের বৃহত্তম প্রাসাদ সাজানোর জন্য ব্যবহৃত প্রাথমিক উপকরণ হলো সোনা ও মার্বেল পাথর।
‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ এর অন্দরে যা আছে
এই প্রাসাদে সুলতানের ২০০টি লালিত ঘোড়ার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আস্তাবল আছে। সুলতানের দুর্বলতা শুধু ঘোড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
তিনি অটোমোবাইলও উপভোগ করেন, এই কারণেই তার বাড়িতে ১ বর্গ কিলোমিটারের একটি ভূ-গর্ভস্থ গ্যারেজ আছে। যেখানে ১১০টি যানবাহন রাখা যায়।
সুলতানের সংগ্রহে আছে ৭০০০ হাজার গাড়ি। এগুলো রাখার জন্য অবশ্য অন্যত্র ব্যবস্থা আছে। যার মধ্যে কিছু কিছু গাড়ি বিশেষভাবে শুধু সুলতানের জন্যই তৈরি করা। এর মধ্যে একটি হলো সুলতানের গোল্ড প্লেটেড প্রাইভেট জেট।
ডেইলি মেইলের তথ্যমতে, সুলতান একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান কেনেন, যার মূল্য প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মজার বিষয় হলো, এর সঙ্গে তিনি অতিরিক্ত ১২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের আনুষাঙ্গিক যোগ করেন। জানা যায়, বলকিয়াহ নাকি তার মেয়ের জন্মদিনে একটি এয়ারবাস ‘এ৩৪০’ উপহার দিয়েছেন।
ব্রুনাইয়ের সুলতান শিল্পকলার প্রতিও অনুরাগী। এই কারণে প্রাসাদে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্মের একটি অত্যাশ্চর্য সংগ্রহশালা আছে। যার মধ্যে আছে একটি রেনোয়ার পেইন্টিং। এটি সুলতান ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে ১৯৮০ সালে কিনেছিলেন।
সোনায় মোড়ানো বাসস্থান
ব্রুনাইয়ের শাসক বিলাসিতা ও কমনীয়তা উপভোগ করেন। এ কারণে সুলতান প্রাসাদটি স্বর্ণ দিয়ে সাজিয়েছেন মনের মতো করে। এর দরজা-জানালা থেকে শুরু করে টাইলস পর্যন্ত স্বর্ণখচিত। জানা যায়, তার পুরো বাসস্থানই সোনা ও মার্বেল পাথরে মোড়ানো।
আছে চিড়িয়াখানাও
ইনসাইডারের তথ্যমতে, সুলতানের প্রাসাদে আছে একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। যেখানে প্রায় ৩০টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আছে। এটি হাসানাল বলকিয়াহর দর্শনার্থীদের জন্য বিনোদনের অন্যতম সংস্থান।
চিড়িয়াখানায় ফ্যালকন, ফ্ল্যামিঙ্গো ও তোঁতাপাখি আছে। যারা বাস্কেটবল খেলতে, সাইকেল চালাতে, গান করতে, কথা বলতে ও অন্যান্য প্রাণীর অনুকরণও করতে পারে।
বিশ্বের বৃহত্তম বাড়ির দৈনন্দিন ব্যবহার
‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ এখন বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি রাজপরিবারের প্রধান বাড়ি। ব্রুনিয়ান সরকারের সরকারি আসন ও সালতানাতের সদর দপ্তর।
রাজপরিবারের অনেক সদস্যের সরকারি ভূমিকা থাকায় তারা এই প্রাসাদেই থাকেন ও কাজ করেন। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসও প্রাসাদে অবস্থিত। প্রাসাদটি প্রায়শই সুলতান বলকিয়াহ আন্তর্জাতিক নেতাদের স্বাগত জানাতে ব্যবহার করেন।
জনসাধারণের জন্যও প্রাসাদ উন্মুক্ত
রমজানের শেষের বার্ষিক অনুষ্ঠান (আইদিল ফিত্রি) চলাকালীন সুলতান বলকিয়াহ তার প্রাসাদ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন। জাতীয়তা বা বিশ্বাস নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারেন।
অতিথিদের আপ্যায়নে ব্রুনাইয়ের জাতীয় চিহ্ন’সহ সুন্দর রূপালি পাত্রে ঐতিহ্যবাহী খাবার ও মিষ্টি পরিবেশ করা হয়। রাতের খাবারের পরে সুলতান বলকিয়াহ ও রানি সালেহার সঙ্গে দেখা করার সুযোগও পান জনসাধারণরা। আবার প্রাসাদ থেকে বের হওয়ার হয় মিষ্টিসহ একটি উপহার প্যাকেজও দেওয়া হয় দর্শনার্থীদের।
কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন ব্রুনাইয়ে?
‘ইস্তানা নুরুল ইমান’ বন্দর সেরি বেগাওয়ানের শহরের কেন্দ্র থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। প্রাসাদটি ক্যাব বা ডার্ট (ব্রুনাইয়ের রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ) দ্বারা সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য।
বন্দর সেরি বেগাওয়ান প্রধান স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া পাবলিক বাসগুলোতে চড়ে সহজেই দর্শনার্থীরা রাজকীয় গেটে নামতে পারবেন।
ব্রুনাইয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণগুলোর মধ্যে আছে- আয়ার কাম্পং, জাতির মসজিদ, গাদং-এ নাইট মার্কেট, উলু টেম্বুরং জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি।
ব্রুনাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। বন্দর সেরি বেগাওয়ান ব্রুনাই এর রাজধানী। এটি একটি রাজতান্ত্রিক ইসলামী দেশ। এটি বোর্নিও দ্বীপের উত্তর উপকূলে অবস্থিত। এর উত্তরে দক্ষিণে চীন সাগর ও বাকি সবদিকে মালয়েশিয়া।
২০২০ সালে ব্রুনাইয়ের জনসংখ্যা ছিল প্রায় লাখ ৩৭ হাজার থেকে কিছুটা বেশি। যাদের মধ্যে প্রায় লাখখানেকই রাজধানী ও বৃহত্তম শহর বন্দর সেরি বেগাওয়ানে বাস করেন।
সূত্র: টাইমস প্রোপার্টি/জিকিউইন্ডিয়া
জেএমএস/এএসএম