মুহুরী প্রজেক্ট ভ্রমণের আগে যা জানা জরুরি
এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
গৌরবগাঁথা বীর চট্টলার প্রবেশদ্বার প্রকৃতির রূপ মাধুর্য্যময় মুহুরী প্রকল্প সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে এই জনপদকে।
একদিকে পাহাড় আর অপরদিকে সমুদ্র নিকটবর্তী অরণ্য সর্পিল নদী, ঝরনা, বন্যপ্রাণী, প্রাকৃতির রূপ বৈচিত্র্যময় সম্পদে সমৃদ্ধময় আর কবির কথার মতো যেন শৈল করীটিনী নদী-মালিনী, বনানী কুন্ততা।
প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে ফেনী ও মুহুরী নদীর মোহনার সৃষ্ট মুহুরী প্রকল্প এলাকায়।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলা সীমান্তে অবস্থিত মুহুরী প্রকল্প দেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর অবদান বিশাল, পাশাপাশি মুহুরী সেচ প্রকল্প হতে পারে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ ও এর পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক অনাবিল নৈসর্গিক শোভা যে কোনো পর্যটককে আকর্ষিত করতে পারে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়নে গৃহীত যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি গড়ে তোলা যায় একটি অনন্য আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র রূপে। এর থেকে কর্পোরেশন প্রতিবছর পর্যটন খাতে আয় করতে পারে প্রচুর দেশি-বিদেশি বৈদেশিক মুদ্রা।
প্রকল্প পরিচিতি
একসময় মুহুরী প্রকল্পের স্থানে ছিল দেড় থেকে দুই মাইল প্রশস্ত নদী। এপার ওপার ছিল বিচ্ছিন্ন। ফেনী নদী ও মুহুরী নদীর দুই তীরকে সেচ সুবিধার আওতায় আনার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার সীমান্ত বরাবর বয়ে যাওয়া ফেনী নদী ও মুহুরী নদীর মোহনার কিছুটা ভাটিতে নির্মিত মুহুরী সেচ প্রকল্প। প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে ছিলো ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড। মুহুরী প্রকল্পের অধীনে আছে ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম থানার আংশিক ও মিরসরাই থানার উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা।
প্রকল্পাধীন এলাকার আয়তন ৪০ হাজার ৮০ দশমিক ৯২ হেক্টর। তার মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ৭৬ দশমিক ৯৩ হেক্টর ফসলি জমি। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বার্ষিক অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয় ৮৫ হাজার মেট্টিক টন। মুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে খরচ হয় ৯৫ হাজার ৬৮ হাজার ৬২৪ লাখ টাকা।
প্রকল্প পরিচালনায় বর্তমানে কর্তৃপক্ষের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভর্তূকির পরিমাণ ২১ হাজার ৩১৮ লাখ টাকা। আয় ব্যায়ের বার্ষিক হিসেবে লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ৩২ দশমিক ১৩। মুহুরী প্রকল্পে নির্মাণ কাজ ১৯৭৭-৭৮ সালে শুরু হলেও এর প্রাথমিক কাজ শেষ হতে সময় লাগে ৩ বছর ও সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে ১৯৮৫-৮৬ সাল পার হয়ে যায়।
যোগাযোগ ও ভ্রমণ
দেশের যে কোনো স্থান থেকে মুহুরী প্রজেক্টের সড়ক যোগাযোগ তথা যাতায়াত ব্যবস্থা যথেষ্ট সুবিধাজনক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে যে রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে সেটিই সহজতর ও একমাত্র রাস্তা।
জোরারগঞ্জ হতে প্রজেক্ট পর্যন্ত মাত্র আধা কিলোমিটার রাস্তাতেই পাবেন নিয়মিত সিএনজি অটোরিক্সা সার্ভিস। ভাড়া ট্যাক্সি বা ব্যক্তিগত গাড়িতেই ভ্রমণে সুবিধাজনক হয়। একাকী কিংবা দলবদ্ধভাবে মুহুরী প্রজেক্টে ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে। জোরারগঞ্জ হতে প্রজেক্ট রোডে আট কিলোমিটার চলার পর প্রকল্পের দীর্ঘ ড্যামের (বাঁধের) পূর্ব প্রান্তে পৌঁছাতে পারবেন।
সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে অথবা রিকশা করে ড্যামের পশ্চিম প্রান্তে সুদৃশ্যময় স্থান রেগুলেটর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাঁধের উত্তরের নীল জলরাশি আর দক্ষিণের দিগন্ত বিস্তৃত চর ও প্রাকৃতির নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত পরিবেশ, পাইন গাছের সারি, ঝাউ বন, প্রাকৃতিক কাশফুলে ভরা ঘাস প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত পরিবেশ যেকোনো পর্যটককেই আকর্ষণ করতে পারে।
দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণ চল্লিশ দরজা বিশিষ্ট সারিবদ্ধ রেগুলেটর। এছাড়া বাঁধের মূলগোড়া থেকে প্রকল্পে প্রবেশ না করে বেড়িবাঁধ দিয়ে সোজা দক্ষিণে গেলেই দেখবেন উপকূলীয় বনবিভাগ কর্তৃক সাজানো কৃত্রিম সুন্দরবন। বনের ফাঁকে ফাঁকে সর্পিল আকারে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী ও অনেক বন্য পশুপাখি।
এখানে পর্যটকদের জন্য উন্নত কোনো হোটেল রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা নেই। ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি রেস্টুরেন্ট তাই নিজ দায়িত্বেই খাবারের আয়োজনের জন্যে রেগুলেটরের উত্তর পশ্চিমের ছোট বনে রান্না বান্না ও ভোজের আয়োজন করা যেতে পারে। দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে ২/১টি অস্থায়ী ভাসমান চা দোকান বসে। তবে সেখানে রাত্রিযাপনের কোনো সুব্যবস্থা নেই।
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সম্ভাবনাময়
পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মুহুরী সেচ প্রকল্প একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। পর্যটন কর্পোরেশন এ যাবৎ কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। প্রতিদিন শত শত মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এখানে এসে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী দেখে রোমাঞ্চিত হয়। উন্নত ও আধুনিক ব্যবস্থাসহ রাত্রিযাপন ও খাবারের আয়োজন থাকলে এই স্থান আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিলেই পুরো প্রকল্প এলাকাকে সবুজ অরণ্যে রুপান্তর করা যায়। বাঁধের উত্তরপার্শ্বে ঝাড় পাইনসহ সুদৃশ্য গাছ লাগানো যেতে পারে, আর দক্ষিণে অন্তত ১ কিলোমিটার এলাকায় সৃষ্টি করা যেতে পারে সবুজের সমারোহ। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো প্রাকৃতিক উপাদান এখানে বিপুল পরিমাণেই বিদ্যমান।
মহিষ খামার, ভেড়ার খামার, হ্যাচারি, মৎস্য ঘের, চারণভূমি ইত্যাদির পাশাপাশি জলজ প্রাণীসমৃদ্ধ একটি আধুনিক মিউজিয়াম গড়ে তুললে এর আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর পার্শ্বের বিশাল লেকে স্পিডবোট ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
নৌপথে সহজ যোগাযোগের জন্যে বঙ্গোপসাগর থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে তথা প্রকল্প এলাকায় নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তবে স্থানীয় মাস্তানদের হাত থেকে পর্যটকদের রক্ষার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করতে হবে।
পর্যটন কর্পোরেশন যদি মুহুরী সেচ প্রকল্পকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে এটি হতে পারে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। যা থেকে কর্পোরেশন বছরে আয় করতে পারে প্রচুর দেশি-বিদেশি মুদ্রা।
এম মাঈন উদ্দিন/জেএমএস/এএসএম