একদিনেই নাপিত্তাছড়ায় দেখে আসুন ৪ ঝরনা
মাজহারুল ইসলাম শামীম
কর্মব্যস্তময় এই শহুরে জীবন থেকে ফাঁকি দিয়ে একটু সময় প্রকৃতির মাঝে নিজেকে উজার করে দেওয়ার নিমিত্তে ছুটে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাইয়ের অনিন্দ্য সুন্দর নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে।
ভয়ংকর সুন্দর এই ট্রেইলে ট্র্যাকিং করতে চাইলে আপনাকে প্রথমে মীরসরাই নয়দুয়ার বাজার যেতে হবে। তারপর নয়দুয়ার বাজার থেকে ১৫/২০ মিনিট পথ হাঁটলে পাহাড়ি রাস্তা শুরু হবে। সেই রাস্তা অনুসরণ করলেই কাজ শেষ।
প্রথমেই বলি নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে মোট ৪টি ঝরনা আছে- টিপরাখুম ঝরনা, কুপিটাকুম ঝরনা, বান্দরখুম ঝরনা ও বাঘবিয়ানী ঝরনা। ভয়ানক পাথরের রাস্তা আর এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা পেড়িয়ে যে অভিজ্ঞতা তা না দেখলে ভাষায় বোঝানো যাবে না।
আমাদের ভ্রমণ শুধু হয় ফেনী জেলা থেকে। ১১ জন বন্ধুরা মিলে শুক্রবার সকাল ৮টায় ফেনী থেকে মিরসরাই নয়দুয়ারি বাজারের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা হই আমরা। সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে প্রায় ঘণ্টাখানিক সময় লেগে গেল। তারপর বাস থেকে নেমে সবাই একত্র হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত নয়াদুয়ার বাজার এলাকায় এটির অবস্থান। মহাসড়ক থেকে নাপিত্তাছড়া ঝর্ণায় পৌঁছাতে ৫০-৬০ মিনিটের মত সময় লাগে।
ট্রেইল শুরুর আগে কিছু প্রস্তুতি দরকার হয়। প্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হচ্ছে পাথুরে পিচ্ছিল কিংবা পিচ্ছিল কাদামাটি পথ পাড়ি দিতে অবশ্যই এ্যাংলেট ও মোজা নিতে হবে। পতন এড়ানো কিংবা পানির গভীরতা মাপতে একটি লাঠি নিলাম। দুটোই নয়া দুয়ারী বাজারে ট্রেইল শুরুর আগেই কিনতে পাওয়া যায়।
এ্যাংলেট ৪০ টাকা ও বাঁশের লাঠির দাম পড়বে ২০ টাকা। জনপ্রতি ১ লিটার পানি ও দ্রুত শক্তি জোগাবে এমন কিছু শুকনো খাবার, বাড়তি একসেট জামাকাপড় নিয়ে রওনা দিলাম সেই কাঙ্খিত ঝরনার দিকে।
পুরো ট্রেইল হেঁটে দেখতে ৪-৫ ঘণ্টা লাগে, তাই সকালের দিকেই এ ট্রেইলে যাওয়া ভালো। আমাদের ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। পাহাড়-জঙ্গলে রাত নামে খুব তাড়াতাড়ি। আর তা হয় ভয়ংকর। ৪০-৫০ মিনিট হাঁটার পর টিকেট কাউন্টার পাওয়া যায়। নাপিত্তাছড়ায় প্রবেশ করতে ২০ টাকার টিকেট কাটতে হয়।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের কাছে পুরো ট্রেইলটি খুবই আকর্ষণীয়। পাথুরে ঝিরি,ট্রেইলের দুপাশে দুর্গম পাহাড়, ঝিরির স্বচ্ছ পানি মনে প্রশান্তি এনে দেয়। সব বন্ধুদের আগেও বিভিন্ন ঝরনা ও পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে বিধায় তেমন জটিলতা হয়নি আমাদের।
তারপরও নাপিত্তাছড়া ঝরনা কিছুটা ব্যতিক্রমী। সেখানে সম্পূর্ণ জায়গা কাদাময় ও পিচ্ছিল। পাশাপাশি খাঁড়া জায়গা। সবকিছু মিলে সর্তকতা ও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া ঝরনায় ওঠা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ।
তবে নাপিত্তাছড়া ঝরনায় যাওয়ার ট্রেইলটি অপেক্ষাকৃত সহজ ও নিরাপদ। তবে নতুনদের জন্য এর ২-৩ টি স্থান ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ট্রেইলটির কোনো কোনো স্থানে একেবারেই পৌঁছায় না সূর্যের আলো। যেখানে দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো পৌঁছায় না। শরীর ছমছম করে ওঠে। সেজন্য দিনের আলো থাকতেই ট্রেইলটি পার হয়ে আসা উচিত।
ঝিরি ও পাহাড়ি পথ ট্রেকিং করে কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথমে এই ট্রেইলের টিপরা ঝরনার দেখা পাওয়া যায়। এর পানি কিছুটা ঘোলাটে। এখানেই অনেকে গোসল করেন। আর অন্য ঝরনাগুলো দেখতে একটু কষ্টসাধ্য হওয়ায় এখান থেকেই ফিরে নাপিত্তাছড়া ঝরনা দেখার গল্প করেন।
টিপরা ঝরনার উপরেই কুপিকাটা ঝরনা। পাহাড়ের কোল ঘেষে টিপরাখুম মধ্য দিয়ে এই ঝরনায় যেতে হয়। মূলত ত্রিপুরা আদিবাসীরা এখানে থাকে। তাই এর নাম হয় টিপরাখুম। টিপরার বাম পাশ দিয়ে এটিতে উঠতে হয়।
এটি বেশ গভীর। সাঁতার না জানলে দূর থেকে এর সৌন্দর্য দেখুন। তবে নামার চিন্তাও করবেন না। কুপিকাটা ঝরনার ডান পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠে আবার ঝিরিতে নামতে একটি পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ পড়বে।
তবে খুব সাবধানে এটি পার হতে হয়। ট্রেকিংয়ের সময় প্রত্যেক কদমই আপনাকে আত্মবিশ্বাসের সাথে ফেলতে হবে। এখানে ভুলের কোনো ক্ষমা নাই। অনেক সময় চড়া মূল্য দিতে হয়।
এ ঝিরি পথ ধরে আরও সামনে গেলে ইংরেজি বর্ণমালার Y বর্ণের মতো দুদিকে দুটো ঝিরি ভাগ হয়ে গেছে। হাতের বামে ঝিরি ধরে ৩০ মিনিটের মতো গেলে ঝিরির শেষ মাথায় বাঘবিয়ানী ঝরনা দেখতে পাবেন। অনেক সুন্দর এ ঝরনা।
এ ঝরনা দেখে আবার পিছনে এসে Y জাংশনের মাথা থেকে ডান দিকে গেলে ঝিরি পথে পড়ে কিছু অনিন্দসুন্দর ক্যাসকেড। এ ঝিরি ধরে ১০ মিনিট সামনের এগিয়ে গেলে ঝিরির শেষে দেখা মিলবে নয়নাভিরাম বান্দর খুম ঝরনার। এই বান্দরখুম ঝরনাই এই ট্রেইলের সবচেয়ে সুন্দরতম ঝরনা। এটিনাই ‘নাপিত্তাছড়া’ ঝরনা নামে পরিচিত।
উঁচু থেকে পাহাড়ের পাথর বেঁয়ে পানি নামার অবিরাম দৃশ্য, পাশে সবুজ গাছপালা, আছে ভয়ংকর কিছু পশুপাখির আওয়াজ, আছে শীতল পানির বাষ্প, আবার অনেকে ফুটবল ও খেলে সেখানে ঝরনার নিচে।
সব কিছু মিলে অনেক ভালো এক এডভেঞ্চার হয়। তবে নাপিত্তাছড়া ঝরনা পর্যন্ত আসার যে কষ্ট তা ঝরনার পানির অবিরাম পানির দৃশ্য দেখে যে কারো মন ভরে যাবে। এ যেনো এক প্রকৃতির রূপকথার গল্পের মতো।
পাশাপাশি এই ঝরনায় এলে দেখা যায় পাহাড়ি উপজাতি মানুষ ও সাধারণ মানুষদের বসবাস। পাহাড়ি মানুষদের সংগ্রামী জীবন এসব জায়গায় কেউ না আসলে কখনো কল্পনাও করতে পারবে না কেউ।
একেকটি ঘরবাড়ি কত উঁচুতে পাহাড়ের উপর। তাদের জীবন-জীবিকার তাগিদে সে উঁচু পাহাড়ের ঘরবাড়ি থেকে সমতলে নেমে এসে কাজকর্ম করে জীবন পার করতে হয়।
তাদের সেখানে খাবারের পানির উৎস ও অনেক কঠিন। হয়তো কাউকে পাহাড়ের ঝরনার পানি খেতে হয়, না হয় কাউকে সমতল ভূমিতে নলকূপ বসিয়ে, সেই কূপ থেকে পানির পাইপ লাগিয়ে তাদের পাহাড়ের উপর ঘরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে মানুষ রান্নাবান্না করার জন্য প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বিভিন্ন গাছ কেটে লাকড়ি তৈরি করেন।
দিন শেষে যখন তারা বাড়ি ফেরেন তখন এসব লাকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে ঝরনার এসব পিচ্ছিল পথগুলো পাড়ি দিয়ে উঁচু পাহাড়ে তাদের যে ঘরবাড়ি সেখানে পাহাড় বেঁয়ে উঠতে হয়। সেখানে নারীরাও দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেন।
এসব দৃশ্য একদিকে যদিও আনন্দ দেয়, অন্যদিকে এসব আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো বেদনা। পাহাড়িদের সন্তানেরা অসুস্থ হলেও চিকিৎসার জন্য তাদের নেই কোনো উন্নত হাসপাতাল, নেই অর্থ।
অবশেষে এসব দৃশ্য দেখার পর আমাদের যখন ভ্রমণের সব স্পট দেখা শেষ এবার আমাদের নেমে যাওয়ার পালা। তবে এই ঝরনায় নেমে আসার জন্য আরো একটা পথ আছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।
যদিও পথটা অন্ধকার ও গভীর জঙ্গল হয় তবে ঝরনাতে ওঠার পথের চেয়ে ঝুঁকি কম। তাই আমরা ফেরার সময় ওই পথ দিয়ে নেমেছিলাম।
লেখক: ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ।
জেএমএস/এমএস