টাঙ্গুয়ার হাওর ও নীলাদ্রি লেক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
মাজহারুল ইসলাম শামীম
অজানাকে জানার নেশায় ভ্রমণপ্রেমীরা দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেড়ালেও কোভিড পরিস্থিতিতে সেই ভ্রমণের স্বাদ গ্রহণে ভাটা পড়ে বেশ লম্বা সময়ের জন্য। স্থবির হয়ে পড়ে দেশের পর্যটন স্পট। তবে যাদের কাছে ভ্রমণ করা একমাত্র মনের প্রশান্তি তাদেরকে কি থামানো যায়!
আর সেই প্রশান্তির উদ্যম নিয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখে রওনা দিলাম ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য সিলেট বিভাগের অন্যতম দর্শনীয় জেলা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ও বাংলার কাশ্মীর খ্যাত নীলাদ্রি লেক। আমার বন্ধু আল মাহমুদ (আমজাদ) ও ইফাজ ইবনে কাদের রাফিসহ আরও ১৫ জন নিয়ে ‘ট্রাভেল লাক্সারি বিডি’ গ্রুপের মাধ্যমে ভ্রমণে গেলাম।
প্রথমে আমরা ফেনী থেকে অনলাইনে ১৮ জনের জন্য ট্রেনেট টিকেট কাটলাম। তারপর ১৪ তারিখ রাত ৯টায় সবাই ফেনী রেলওয়ে স্টেশনে হাজির হলাম। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো অবশেষে সিলেটগামী ট্রেন আসলো। আমরা সবাই ট্রেনে টিকেট অনুসারে সিট দখল করলাম। তারপর ট্রেন চলা শুরু হলো।
১৫ সেপ্টেম্বর সকাল সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায় আমরা। তারপর সুনামগঞ্জগামী বাসে করে সুনামগঞ্জ গেলাম। এবার বিভিন্ন লেগুনা করে তাহেরপুর উপজেলায় পৌঁছালাম। এরপর ২ দিনের জন্য একটি ট্রলার ভাড়া করি। তার আগে দু’দিনের জন্য কাঁচামাল জাতীয় খাবার ও ওষুধ সব কিনে নিলাম বাজার থেকে।
সবকিছুর প্রস্তুতি শেষ করে আমরা রওনা দিলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের বুকে। হাওরটি প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এই হাওর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিষ্টি পানির আধার। যেখানে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ৩০টিরও বেশি ঝরনা।
প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির সরিসৃপ ও ২০৮ প্রজাতির পাখির আবাস এই হাওরে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’। শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে প্রায় ২৫০ প্রজাতির।
বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতা ভ্রমণের আনন্দ কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল বটে, তবে প্রকৃতির বিস্ময়কর এই সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে। হাওরের মাঝে চলছে প্রথম দিনের সকালের দুপুরের খাবারের পর্ব। ভ্রমণ সঙ্গীদের মধ্যে আল মাহমুদ সহ আরো দুজন ব্যস্ত ছিলেন খাবার রান্নার কাজে।
হাওরের উপর দিয়ে চলতে থাকা অবস্থায় আশেপাশের সৌন্দর্য আমাদের মন ভরিয়ে তুলছিল। রীতিমত নৈসর্গিক! যতদূর চোখ যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির ধারা। আকাশ আর পানির মিলনের মাঝে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়।
মাঝে মধ্যে পানি এতটা স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল যে, আন্দাজে প্রায় ২০ ফুট গভীরের জলজ উদ্ভিদ খুব পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছিল। বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ছিল ছোট ছোট লাল শাপলা। এসবের মাঝেই একটি বিশেষ জায়গায় নিয়মিতভাবে প্রতিটি গ্রুপ যাত্রা বিরতি দেয়। এই অংশটি মূলত একটি জনপথ।
প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যার পানি হাওরের পানির সঙ্গে মিশে রাস্তাটি ডুবে যায়। এর সঙ্গে রাস্তার পাশের বড় বড় গাছপালা মিলে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এমনকি শীতকালেও হাওরের রূপ এরকম থাকে না।
আপনি যদি সাঁতার না জানেন, তাহলে হাওরে ভ্রমণে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন। এরপর পানিতে আমরা কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে নিলাম। এরপর সবাই গেলাম আরও একটি নিয়মিত স্পট, ওয়াচ টাওয়ার দেখতে। সুউচ্চ এই টাওয়ার থেকে পুরো হাওরের একটি পূর্ণ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
টাঙ্গুয়ার হাওর প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এর আশপাশের প্রায় ৪৬টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের যোগান হয় এই হাওর থেকে। হাওরটি দেশের মৎস্য শিল্পে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সবাই প্রথমে ওয়াচ টাওয়ারে নেমে সেখানে লাইফ জ্যাকেট পরে পানিতে নামলাম।
এরপর সবাই আবার ট্রলারে উঠে গেলাম ট্যাকেরঘাটের উদ্দেশ্যে। এর মাঝে ট্রলারে আমরা দুপুরের খাবার সম্পূর্ণ করে নিলাম। আর ট্যাকেরঘাট পৌঁছাতে দূর থেকে দেখা যায় মেঘালয় পাহাড়ে মেঘের খেলা। যা মন ভরে দেখলাম সবাই। প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর আমরা ট্যাকেরঘাট পৌঁছালাম।
এরপর বিশ্রাম নেওয়ার পালা। এর মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসলো। রাতেও থাকতে হবে ট্রলারেই। একদিকে রাতে ভারতের সীমান্তের বাতি জ্বলতেছে আর অন্যদিকে হাওরের থৈ থৈ পানি। এর মধ্যে আবার হালকা হালকা বৃষ্টির ফোঁটাও পড়তেছে। এভাবেইর কাটলো রাত।
ভোর ৫টায় বাজতেই সবাই উঠে পড়লাম। চারপাশের সৌন্দর্য তখন দেখার মকো। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের দৃশ্য আর হাওরের সৌন্দর্য মনভরে উপভোগ করি সবাই। আমার চোখে প্রথমবারের মতো সকালের আলোয় ট্যাকেরঘাটের অপরূপ রূপ ধরা পড়লো। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, রীতিমত প্রেমে পড়ে গেলাম।
সবকিছু ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সেই সৌন্দর্য গোগ্রাসে গিলতে আর মুঠোফোন ভরে ছবি তুলতে। এরপর সকালের নাস্তা সম্পূর্ণ করে আমরা সবাই রওনা দিলাম নীলাদ্রি লেকের উদ্দেশ্যে। তবে আমাদের ভাগ্যে সেদিনও বৃষ্টি ছিলো। প্রকৃতির উপর যখন কারো হাত নেই তখন আর কি করার মেনে নিলাম বৃষ্টির দিনটা।
এভাবেই রওনা দিলাম নীলাদ্রি লেকের উদ্দেশ্যে। ট্যাকেরঘাট থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় নীলাদ্রি লেকে। অপরূপ নীলাদ্রি লেক, যা বাংলার কাশ্মীর নামেও পরিচিত। তবে এই লেকে সাঁতার কাটতে চাইলে সাবধান- কারণ এর স্বচ্ছ সবুজ পানি যেমন টানে, তেমনি এর রহস্যময় গভীরতায় প্রাণহানির ঝুঁকিও আছে।
২৫০-৩০০ ফুট গভীর স্বচ্ছ পানি দেখবেন নীলাদ্রি লেকে। চারদিকে সবুজ পাহাড়ের সমারোহ হওয়াতে এই লেকের পানিও সবুজ রং ধারণ করে। চারদিকে পাহাড় মাঝখানে লেকের অবস্থান। যা অত্যন্ত মনোরম এক দৃশ্য। তবে এই দৃশ্য ও বৃষ্টির জন্য ঠিকমতো উপভোগ করতে পারিনি।
তাই অল্প সময়ের জন্য ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা ভাড়া করে নিলাম। ডিঙি করে অপর পাশে গিয়ে আমরা মেঘালয় পাহাড়ের দৃশ্য আর লেকের সবুজ পানির দৃশ্য উপভোগ করলাম। সীমান্তবর্তী ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের পরিত্যক্ত স্থানে ১৯৪০ সালে চুনাপাথর সংগ্রহ শুরু করে।
এই চুনাপাথর সংগ্রহের পুরানো জিনিসপত্রগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন, স্থানটি অনেক কিছুর জন্য মূল্যবান। এরপর ফেরার পালা। আগের মতো সবাই ট্রলারে উঠলাম। ট্রলার ঘাটে এনে নামিয়ে দিলো। এরপর লেগুনা ও বাসে করে সবাই সুনামগঞ্জ থেকে আবার সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে ফিরে এলাম।
অগ্রিম টিকিট আগেই কেটে রাখা ছিল, এ কারণে আর ঝামেলা হয়নি। টিকিট অনুসারে ফেনীগামী ট্রেনে উঠে গেলাম। পরদিন সকালে ফেনী এসে পৌঁছালাম।
লেখক: ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ।
জেএমএস/এমএস