ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

যেভাবে এলো নওগাঁর বিখ্যাত ‘প্যারা সন্দেশ’

আব্বাস আলী | প্রকাশিত: ০২:১৭ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

যুগ যুগ ধরেই বাঙালিরা অতিথি আপ্যায়নে মিষ্টান্ন পরিবেশন করেন। এমনকি শেষ পাতের খাবারে অতিথি আপ্যায়নে থাকে নানা মিষ্টান্ন। তার মধ্যে অন্যতম ‘প্যারা সন্দেশ’। বিচিত্র খাবারের মধ্যে শত বছরের সুখ্যাতি আছে ঐতিহ্যবাহী নওগাঁর ‘প্যারা সন্দেশ’।

শুরুতে পূজা মন্ডপে দেবদেবীর উপাসনার জন্য তৈরি হলেও এখন এটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকায় মিষ্টান্ন জগতে অনেক বড় একটি জায়গা করে আছে এ সন্দেশ।

তবে এর কারিগররাও সুষ্পষ্টভাবে বলতে পারেননি, ঠিক কখন থেকে প্যারা সন্দেশের প্রচলন শুরু হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্যারা সন্দেশ তৈরি হচ্ছে। তবে ধারণা করা হয়, প্রায় শত বছর ধরে নওগাঁ শহরে প্যারা সন্দেশ তৈরি হচ্ছে।

jagonews24

জানা গেছে, নওগাঁর শহরের কালীতলা এলাকার শ্রীশ্রী বুড়াকালী মাতা মন্দিরের পাশে ভোগের প্রয়োজনে শত বছর আগে দোকানে এই ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরি হতো। এগুলোকে বলে ভোগের দোকান। এই সন্দেশ পূজারীরা বিভিন্ন পূজামণ্ডপের দেবদেবীর উপাসনার জন্য মন্দিরে ভোগ দিতেন। বর্তমানেও প্রচলন আছে।

শ্রীশ্রী বুড়াকালী মাতা মন্দিরের প্রধান গেট সংলগ্ন ‘মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ’ এর দোকান। ওই দোকান থেকে প্রতিদিন সকালে সনাতন ধর্মাম্বলীরা সর্বনিন্ম ৫-১১টাকায় প্যারা সন্দেশ কিনে মন্দিরে ভোগ দেন। এই দোকান থেকে খুচরা ৩৪০ টাকা কেজি ও শহরের মিষ্টিপট্টিসহ অন্য দোকানে ৩৭০-৩৮০টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

প্যারা সন্দেশ এখন বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো বা নিয়ে যাওয়া মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্যারা সন্দেশ মিষ্টির জগতের অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে। স্বাদ আর পুষ্টিগুণে এটি মানুষের মুখে মুখে।

jagonews24

দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন- ভারত, কলকাতা, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের ক্রেতারা প্যারা সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছেন।

জনশ্রুতি আছে, ভারতের বিহারের কোনো এক নবাবের মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিলেন মহেন্দ্রী দাস। নবাব এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি প্রাণ নিয়ে এসে নওগাঁ শহরের কালীতলায় বসবাস শুরু করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরি করে বিভিন্ন মন্দিরে বিক্রি করতেন। পরে সেখানেই ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসেন।

শত বছর আগে তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। মহেন্দ্রীর পর তার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস দোকানের দায়িত্ব পান। তখন বিমল মোহন্ত নামে মিষ্টি তৈরির এক কারিগরের হাতের স্পর্শে ‘প্যারা’ সন্দেশের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রায় ৩০ বছর ব্যবসার পর দোকানটি সুরেশ চন্দ্র মহন্তের কাছে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান। এরপর সুরেস চন্দ্র মোহন্ত দোকানে নতুন মিষ্টির কারিগর নারায়ণ চন্দ্রকে আনেন। কারিগর নারায়ণ চন্দ্র প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেন।

jagonews24

আবারও ওই দোকানের মালিকানা পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দোকানের মালিক বৈদ্য রতন দাস। তিনিই এখন প্যারা সন্দেশ তৈরি করছেন। বর্তমানে নওগাঁ শহরে বেশ কয়েকটি দোকানে অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি প্যারা সন্দেশ তৈরি করছে। এর মধ্যে ‘প্যারা’ সন্দেশ এর সুনাম চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে।

শ্রীশ্রী বুড়াকালী মাতা মন্দিরের সেবায়ী মহাদেব মজুমদার বলেন, আমরা যতটুকু জানি মন্দির সৃষ্টির পর প্যারা সন্দেশ এর আগমন হয়। দেবীর আরাধনায় ভোগের জন্য মিষ্টান্নের প্রয়োজন হয়। মন্দিরের পাশে দোকান হওয়ায় সহজেই পূজারিরা সেখান থেকে ভোগ কিনে থাকেন।

কালীতলা মহল্লার বাসিন্দা সাগর কুমার বলেন, নওগাঁতে বেশ কয়েকটি প্যারা সন্দেশের দোকান হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে তার মধ্যে মন্দিরের পাশের দোকান ‘মা প্যারা সন্দেশ’টি বেষ্ট। ভোগের পাশাপাশি বাড়িতে খাবারের জন্য প্যারা সন্দেশ এখান থেকে কিনা হয়। এছাড়া দামও তুলনামুলক কম।

তবে বাজারের মধ্যে মিষ্টান্নের দোকানে কিছুটা হলেও দাম বেশি। প্যারা সন্দেশ দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও ভারতসহ কয়েকটি দেশে যায়। প্রায় শত বছর থেকে এই প্যারা সন্দেশ এর কদর চলে আসছে। দোকানের মালিকানা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হলেও তাদের দোকানের প্যারা সন্দেশ এর স্বাদ ও মান আছে সেই আগের মতই।

jagonews24

শহরের কালিতলার বিখ্যাত ‘মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ’ দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী বৈদ্য রতন দাস বলেন, ‘মহেন্দ্রী দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেছিলেন। তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি তেমন ছিল না। পর্যায়ক্রমে মহেন্দ্রীর পর এখন আমি দোকানের মালিক।’

‘প্রায় ৩৫ বছর ধরে প্যারা সন্দেশ এর ব্যবসা করছি। প্রতিদিন পাশের মন্দিরে ভোগ দেন পূজারীরা। যেখানে সর্বনিন্ম ৫ টাকা থেকে ১১ টাকায় ভোগ কেনে। এছাড়া ভোগের জন্য অনেকে চাহিদা অনুযায়ী বেশিও কিনে থাকেন। প্রতিদিন ভোগের জন্য প্রায় ৪ থেকে ৫ কেজি বিক্রি হয়।’

‘এছাড়া বিভিন্ন দোকানদাররা পাইকারি কিনে নিয়ে যান। আর কিছু দোকানে খুচরা বিক্রি করা হয়। দেশের বাহিরে বিভিন্ন দেশে যাদের আত্মীয়-স্বজন আছেন, তাদের জন্য অনেকে কিনে পাঠান। আমার অনেক বয়স হয়েছে এখন দোকানটি ছেলে সৈকত দাস পরিচালনা করছে।’

বৈদ্য রতন দাসের ছেলে সৈকত দাস বলেন, ‘আমরা বংশপরম্পরায় শহরের কালীতলায় মিষ্টির কারিগররা বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ তৈরি করে সরবরাহ করছি। বর্তমানে নওগাঁয় বেশ কয়েকজন প্যারা সন্দেশ তৈরি করলেও আমাদের দোকানের প্যারা সন্দেশ এর ব্যাপক খ্যাতি আছে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৬০-৭০ কেজি পর্যন্ত প্যারা সন্দেশ তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে পূজাসহ বিভিন্ন দিবসগুলোতে আরো বেশি পরিমাণ প্যারা সন্দেশ তৈরি করা হয়।

jagonews24

প্যারা সন্দেশ তৈরির কৌশল ও উপকরণ বিষয়ে সৈকত দাস জানান, ‘এর তৈরি পদ্ধতি খুবই সহজ। এক কেজি প্যারা সন্দেশ তৈরি করতে দরকার হয় প্রায় ৬ লিটার তরল দুধ এর সঙ্গে ১ কেজি চিনি যোগ করা হয়। প্রথম ধাপে তরল দুধের সাথে চিনি মিশিয়ে জ্বাল করে তৈরি করা হয় ক্ষীর।

অনবরত নাড়াচাড়া করতে হয়। একসময় ক্ষীর হাতায় জড়িয়ে আসে। তখন হালকা উষ্ণ ক্ষীর দু’হাতের তালু দিয়ে রোল করে সামান্য চাপ দিলেই তৈরি হয়ে যায়। প্রতিটি প্যারা সন্দেশ প্রায় আধা ইঞ্চি চওড়া ও দুই ইঞ্চি লম্বা করা হয়ে থাকে। প্রতি কেজিতে ৬০ থেকে ৬৫টি পিস হয়।

দুধ আর চিনি ছাড়া অন্য কোন উপকরণ না থাকায় স্বাভাবিকভাবে ১০ থেকে ১৫ দিন রাখা যায়। আর কৃত্রিম উপায়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এই সন্দেশ ভালো রাখা যায়। প্রতি কেজিতে দুধ, চিনি, মসলাসহ সব মিলে খরচ পড়ে ৩০০-৩১০টাকার মত। আর বিক্রি করা হয় ৩৪০ টাকা কেজি। প্রতিদিন ১০-১২টি পাইকারি দোকানদার কিনে নিয়ে যায়। আর কিছু পরিমাণ দোকান থেকে খুচরা ও পাইকারী বিক্রি করা হয়।

শহরের মিষ্টিপট্টি বাজারে ‘নওগাঁ মিষ্টান্ন ভান্ডার’ এর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক বলেন, অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় প্যারা সন্দেশের দাম তুলনামুলক বেশি। ক্রেতাদের কাছে সারা বছরই এ মিষ্টান্নের চাহিদা থাকে।’

‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ক্রেতারা নিয়ে যান। এছাড়া পূজা, ঈদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই শুধু নয়, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া হয় এই প্যারা সন্দেশ। স্বাদ ও মানের দিক থেকে এই প্যারা সন্দেশ মুখরোচক ও অতুলনীয়। স্বাভাবিকভাবে বেশ কয়েক দিন ধরে সংরক্ষণ করা যায়।’

কবি, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক আতাউল হক সিদ্দিকী বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায় সারা বছর বিভিন্ন পূজা অর্চনা করে থাকেন। দেবীর আরাধনায় প্রয়োজন মিষ্টান্নের। শত বছর পূর্বে শহরের কালীতলায় ছোট ছোট মিষ্টির দোকান বসত। এসব দোকান থেকে প্রয়োজনীয় মিষ্টান্ন কিনে পূজারীরা পূজা অর্চনা করত।’

‘তখনকার সময় মিষ্টির প্রয়োজনে ওই দোকানীর পূর্ব পুরুষরা প্রথম প্যারা সন্দেশ তৈরি করেন। তবে পরবর্তীতে এই সন্দেশ শুধু দেবীর আরাধনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে রসনাবিলাস খাবারের মধ্যে প্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন শহরের বিভিন্ন মিষ্টান্নের দোকানে প্যারা পাওয়া যায়।’

আব্বাস আলী/জেএমএস/এমএস

আরও পড়ুন