নুহাশপল্লীতে গিয়ে যা যা দেখবেন
তাহরিমা মাহজাবিন
সকাল ১০ টা। গাছে গাছে নতুন পাতা, সকালের মিষ্টি রোদ, কোকিলের কুহু ডাক, মৃদু হাওয়া, নবরুপে সজ্জিত প্রকৃতি যেন জানান দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। দিনটি ছিল চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি। যাচ্ছিলাম গাজীপুরের পথে, গন্তব্য নুহাশপল্লী।
যেখানে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ খুঁজে নিয়েছিলেন তার স্বপ্নের ঠিকানা। যেখানে লেখক নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে তুলেছিলেন তার নন্দনকানন। প্রিয়পুত্র নুহাশের নামে জায়গাটার নামকরণ করেছিলেন ‘নুহাশপল্লী’।
প্রায় ৪০ বিঘা জায়গা নিয়ে নির্মিত এই নুহাশপল্লীর পুরোটা জুড়েই আছে সবুজের সমারোহ। যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকেই শুধু সবুজের উপস্থিতি।
এখানে প্রায় ২৫০ প্রজাতির দূর্লভ ওষুধি, মসলা জাতীয়, ফলজ ও বনজ গাছ আছে। যেগুলো লেখক নিজেই সংগ্রহ করেছিলেন দেশ-বিদেশ থেকে। প্রতিটি গাছের গায়েই নাম পরিচিতি দেওয়া আছে। যা দেখে গাছ চেনা যায় সহজেই।
মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর একটি বড় রাস্তা চলে গেছে ভেতরের পথে। অবশ্য ফটক ঘেঁষেই আছে শ্বেত পাথরের মূর্তি। যেখানে আছে একজন মা তার সন্তানের কাঁধে হাত রেখেছেন এমন একটি অবয়ব।
রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে একে একে চোখে পড়বে ট্রি হাউজ, বৃষ্টিবিলাস, লীলাবতী দীঘি, পদ্মপুকুর, মৎসকন্যা, ভূত বিলাস বাড়ি ইত্যাদি। হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে থামলাম বৃষ্টি বিলাসের সামনে।
টিনের চালের এই পাকা দালান নুহাশপল্লীর অন্যতম আকর্ষণ। ঝুম বৃষ্টির শব্দ উপভোগ করার জন্যই লেখক এত আয়োজন করেছিলেন। বৃষ্টি বিলাসের সামনে যখন দাঁড়ালাম, মনে পড়ে গেল হুমায়ূন আহমেদের ‘নয় নাম্বার বিপদ সংকেত’ টেলিফিল্মের সেই বাড়ির কথা।
এই বৃষ্টিবিলাসেই শুটিং হয়েছিল টেলিফিল্মটির। বৃষ্টিবিলাসের সামনেই একটি গাছে তৈরি হয়েছে ট্রি হাউজ। বোনদের সঙ্গে ট্রি হাউজে গিয়ে বসলাম। সিঁড়িতে বসে তিন বোন মিলে গাইতে লাগলাম ‘চলো না যাই, কিছু কথা বলি’ গানটা।
ট্রি হাউজ থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। কিছু দূর এগিয়ে গেলেই দেখা যায়, বিশাল এক জায়গা জুড়ে আছে দীঘি লীলাবতী। হুমায়ূন আহমেদ তার মৃত কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে এই দীঘির নামকরণ করেছিলেন।
উপরের স্মৃতিফলকে লেখা, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’ শাঁনবাধানো এ দীঘির চারপাশে আছে নানা রকম গাছ। পুকুরের মাঝখানে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপটি বিশেষভাবে নজর কাড়ে সব দর্শনার্থীদের।
ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে সেই দ্বীপে গিয়ে ছবি সবাই ছবি তোলেন। আমরাও সেখানে গিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর এসে বসলাম সাদা চেয়ারগুলোয়। যেখানে বসে হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখি করতেন।
কখনও বা আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন। হুমায়ূন আহমেদ তার বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার এই চেয়ারগুলোতে বসেই দিয়েছিলেন। এছাড়াও সেখানে গেলে দেখতে পবেন হুমায়ূন আহমেদের আবক্ষ মূর্তি, পদ্মপুকুর, সরোবরে পাথরের মৎসকন্যা, প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের অনুকীর্তি।
আরও আছে অর্গানিক ফর্মে ডিজাইন করা সুইমিং পুল (যেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদ একসঙ্গে জলে নেমেছিলেন) দাবার গুটির ছকসহ দৃষ্টিনন্দন সব স্থাপত্য। এছাড়াও বড় একটা মাটির ঘরও দেখতে পাবেন সেখানে। একে একে সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমরা।
তারপর বসে বিশ্রাম নিলাম সবুজ ঘাসের উপর। চলে আসার আগে সম্পূর্ণ এলাকায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ফেরার সময় বারবার চোখ পড়লো লিচুতলায়। তীব্র এক হাহাকার আচ্ছন্ন করলো আমাকে।
কারণ এই লিচুতলাই শুয়ে আছেন বাংলাসাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ। এই পৃথিবীর বুকে নতুন কোনো উপন্যাস সৃষ্টি করতে আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না তিনি।
এসব ভেবে বিষন্ন মনে বাকের ভাইয়ের সেই বিখ্যাত ‘হাওয়া ম্যায় উড়তা যাইয়ে’ গানটা শুনতে শুনতে গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। সবশেষে লেখকের প্রতিকৃতিতে একবার স্পর্শ করে বেরিয়ে এলাম গেইটের বাইরে।
নুহাশপল্লীর পুরোটা জুড়েই আছে লেখকের নানা স্মৃতি। এখানে সর্বত্র অনুভব করা যায় লেখকের অস্তিত্ব। এছাড়াও সেখানে গেলে আপনি লেখক হুমায়ূনের স্বপ্ন ও কল্পনার জগত সম্পর্কে জানতে পারবেন।
এগুলো দর্শনার্থীদের অপার আনন্দ দেয়। অপরদিকে হুমায়ূনবিহীন নুহাশপল্লীতে গিয়ে কখনও কখনও ব্যাথিত হয়ে ওঠে পাঠকের হৃদয়।
যেভাবে যাবেন নুহাশপল্লী
হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে টেম্পু, রিকশা অথবা সিএনজিতে করে নুহাশপল্লীতে যাওয়া যায়। টেম্পুর ভাড়া লাগবে ৪০-৫০ টাকা।
রিকশা ভাড়া লাগবে ৫০-৬০ টাকা ও সিএনজি ভাড়া লাগবে ১২০-১৫০ টাকা। চাইলে নিজের ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়েও বেড়াতে যেতে পারবেন নুহাশপল্লীতে।
টিকিটের মূল্য ও দর্শনের সময়সূচী
নুহাশপল্লী সারা বছর দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। কোনো সাপ্তাহিক বন্ধ নেই। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বিশেষ অনুরোধে মাগরিবের আজান পর্যন্ত গেইট খোলা রাখা হয়।
নুহাশপল্লীতে ১২ বছরের উপরে জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য ২০০ টাকা। তবে লেখকের জন্ম (১৩ নভেম্বর) ও মৃত্যু দিন (১৯ জুলাই) নুহাশপল্লী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। এই দু’দিন ঢুকতে কোনো টিকিট লাগে না।
কোথায় খাবেন?
নুহাশপল্লীর ভেতরে খাবার খেতে চাইলে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হবে। বাইরে থেকেও খাবার নিয়ে যাওয়া যায়।
এছাড়াও মূল ফটকের বাইরে বিভিন্ন প্রকারের ভর্তা, ডিম ভুনা, ডালসহ ভাতের হোটেল পাবেন। কম খরচের মধ্যেই সেখানে খেতে পারবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
জেএমএস/জেআইএম