লেক-পাহাড়ে ঘেরা রাঙ্গামাটির জুরাছড়িতে আরও যা দেখবেন
নুরুল করিম
জুরাছড়ি- দুর্গম প্রান্তিক পাহাড়ে ঘেরা এক জনপদ। যেখানে সবসময় খুঁজে পাওয়া যায় নীরবতা, বুনোগন্ধ আর সরলতার খোঁজ। যারা দেশের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ান, তাদের অনেকের কাছেও নামটি অপরিচিত। কাপ্তাই লেকের কোলজুড়ে বসে থাকা জুরাছড়ির সৌন্দর্যের পুরোটাই প্রাকৃতিক। মানুষের হাতে তৈরি কৃত্রিম কোনো সৌন্দর্য এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না!
জুরাছড়ি যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌপথ। তাও রাঙ্গামাটি থেকে দিনে মাত্র দুটি লঞ্চ। আমরা প্রথম লঞ্চেই উঠে পড়লাম। সেটি রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় ছেড়ে যায়। আগেই থেকেই জানি, সাড়ে ৩ ঘণ্টার মতো সময় লাগে জুরাছড়ি যেতে। পথে পথে আমরা শুভলং, নতুন বাজারসহ কয়েকটা জায়গা দেখতে পাবো।
ফুরফুরে বাতাস আর মিষ্টি রোদ মাথায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম। তারপর যতই সামনে এগিয়েছি, কাপ্তাইয়ের প্রতিটা দিক আমাদের শুধুই মুগ্ধ করেছে, বিস্ময়ভরে তাকিয়ে দেখেছি। কখনও ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়েছি, আবার কখনও প্রকৃতি উপভোগ করে করে এগিয়েছি। অসাধারণ ছিল কপ্তাইয়ের বুক ফুঁড়ে উঠে দাঁড়ানো পাহাড়গুলো অতিক্রম করার প্রতিটি মুহূর্ত।
ছোট কাঠের লঞ্চেই চায়ের কাপে দিনের প্রথম চুমুক দিলাম। এক কথায় অমৃত! শহরের বড় বড় রেস্তোরাঁয়ও এত ভালো চা পাওয়া মুশকিল! এই চা হাতে লঞ্চের ভেতরে থাকা একেবারেই মাননসই লাগছে না। লঞ্চের ছাদেই নিজেদের জন্য জায়গা করে নিলাম। দোতলা লঞ্চের ছাদে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে এগিয়ে চলেছি।
লঞ্চ থামলো শুভলং বাজারে। ২০ মিনিটের বিরতি। আমরাও এই ফাঁকে বাজারটা ঘুরে দেখার জন্য নেমে পড়লাম। নেমেই দেখি, এখানে ফলের অভাব নেই। কাধি কাধি কলা, আনারসসহ নাম জানা, না জানা অনেক ফল। তাও আবার নামমাত্র মূল্যে! তবে সময় স্বল্পতার কারণে আমরা কয়েকটা ফল চেখে দেখে লঞ্চে উঠে পড়লাম।
শুরুতে হিমেল হাওয়ার প্রলেপ থাকলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোদের সঙ্গে প্রচণ্ড তাপদাহ সঙ্গী হয়। সবার মধ্যে অস্থিরতা আর এক অসহণীয় অবস্থা, বৃষ্টির জন্য কি যে হাহাকার! রোদ পড়ে সঙ্গে নিয়ে আসা সব ধরনের রসদ, এমনকি হাতে থাকা ডজনখানেক কলাও গরম হয়ে উঠেছে।
আমরা ৬ জন ছাড়া পুরো লঞ্চে আর কোনো পর্যটক নেই। অধিকাংশই স্থানীয় যাত্রী। জুরাছড়িতে বাঙালিদের বসবাস খুব কম। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী আর সরকারি চাকুরীজীবী ছাড়া তেমন বাঙালি বসতি নেই ওখানে। জুরাছড়ির ব্যবসায়ী এসব লঞ্চেই পণ্য পরিবহন করেন। মুরগি থেকে শুরু করে মুড়ি- সবই এই লঞ্চের নীচ তলায় আছে। এমনকি খবরের কাগজও জুরাছড়িতে যায় সকালের লঞ্চে।
পুরো পথে যেতে যেতে আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠবে আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘর, লেক পাড়ের পাহাড়জুড়ে জুমের আবাদ, মাছের ঘের। এখানকার বেশিরভাগ পরিবারের কাছেই ডিঙি নৌকা আছে। এর চেয়ে যাতায়াতের সহজ উপায় তারা ভাবতেও পারেন না।
ছোট পাহাড় আর দ্বীপে মোড়ানো কিছুটা পথ যেতেই আলাদা হয়ে যায় বরকল আর জুরাছড়ির পথ। বাঁক নিতেই সবুজ পাহাড় যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। পথের দু’পাশে আদিবাসীদের ঘর, প্রাচীন বৃক্ষ আর সবুজের সমারোহ। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পবর্তমালা। কিছুদূর আসতেই একটা গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মাথা কাস্তেচেরা পাখিদের ল্যান্ডিং করতে দেখা যায়। বাহ, কি অভূতপূর্ব দৃশ্য!
জুরাছড়ি সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে বসে আছে। উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে থানা কমপ্লেক্সের সংযোগ সড়কে সারিবদ্ধ নারিকেল, গর্জন ও জারুল গাছের হাতছানি উপেক্ষা করার মত নয়। এই সৌন্দর্যের নিবিড় ডাকে সাড়া দিলে জীবনটা হয়ে উঠবে উপভোগ্য! জুরাছড়িতে আছে ছোট বড় বেশ কয়েকটি বৌদ্ধবিহার, ঝরনা ও দীঘি। এখানেই নির্মিত হচ্ছে উপমহাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ বৌদ্ধ মন্দির। সেই গল্প বলবো আরেকদিন!
যাওয়া ও থাকা
জুরাছড়ি রাঙ্গামাটি সদর থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই উপজেলায় রাঙ্গামাটি হয়েই যাওয়া ভালো। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে লঞ্চ করেই জুরাছড়ি যেতে হয়। সারাদিনে মাত্র দুটো লঞ্চ জুরাছড়ি আসা-যাওয়া করে। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে ও দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে আরেকটি লঞ্চ জুরাছড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ফেরার লঞ্চের সময়- দুপুর দেড়টা ও রাত সাড়ে ৮টা।
জুরাছড়ি থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার জন্যও আধুনিক কোনো রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠেনি। তবে উপজেলা কমপ্লেক্সের পাশে মোহম্মদ আলী হোটেলে সুস্বাদু খাবার মেলে, দামও কম। যেহেতু থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, সেহেতু দিন যেয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে রাঙ্গামাটি শহরে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
যেহেতু পুরো জার্নিটাই নৌপথে, লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেয়া ভালো। যদি সাঁতার না জানেন তবে পানিতে নামবেন না। যাত্রাকালে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও পানি সঙ্গে রাখবেন। জুরাছড়ি দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে। এক রাত যদি থাকতেই চান; তাহলে খাবার হোটেলের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সম্ভব হলে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে যাবেন।
লেকের পানি খুবই স্বচ্ছ ও নীলাভ। পানিতে কোনো বোতল, প্যাকেট বা প্ল্যাস্টিক ফেলবেন না। প্রকৃতিকে সুন্দর রাখুন।
জেএমএস/এএসএম