কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে নীলকুঠি
নীলকুঠির ইতিহাস বহু পুরোনো। এখন নেই নীলকর বা নীল চাষের জমি। তবে তার স্মৃতি এখনো রয়ে গেছে। মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামে কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছ ব্রিটিশদের নীল কারখানার ধ্বংসাবশেষ। যা এখন ‘নীলকুঠি’ নামে পরিচিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের কিছুকাল পর তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুরের অংশ হিসেবে মাদারীপুরে নীল চাষ শুরু হয়। অঞ্চলটি নীল চাষের বিশেষ উপযােগী হওয়ায় ইংরেজরা নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা নিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিলেন।
আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন হিন্দু জমিদারের সহায়তায় ইংরেজ নীলকর ডানলপ সাহেবের কুঠিয়াল বাহিনী মাদারীপুরের আউলিয়াপুরে প্রায় ১২ একর জমির উপরে নীলকুঠি স্থাপন করেন। এলাকার কৃষকদের সেই সময়ে ধান, পাট, গম, সরিষাসহ অন্য ফসল চাষ বাদ দিতে হতো। শুধু নীল চাষে বাধ্য করা হতো।
যে জমিতে একবার নীল চাষ করা হতাে; সেখানে অন্য কোনো ফসল চাষ করা সম্ভব হতাে না। কৃষকদের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে নীল চাষে বাধ্য করা হতাে। নীল চাষে অনাগ্রহীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতাে। এ নির্যাতনের কারণে এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৪৫ সালে ঐতিহাসিক ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তার ছেলে পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়া নির্যাতিত কৃষকদের নিয়ে গড়ে তােলেন বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী। পরবর্তীতে হাজী শরীয়তুল্লাহ মৃত্যুবরণ করার পর তার ছেলে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে নীলকুঠি থেকে ৩ কিলােমিটার দূরে ‘রণখােলা’ নামক স্থানে নীলকর ডানলপ বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে দুদু মিয়ার লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণে পরাজিত হয়ে নীলকুঠির অধিকর্তা ডানলপ তার দলবলসহ নীলকুঠি ছেড়ে পালিয়ে যান। সেই থেকে ব্রিটিশদের অত্যাচারের নীরব সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশদের নীল কারখানার ধ্বংসাবশেষ। যা এখন ‘নীলকুঠি’ নামে পরিচিত। স্মৃতি হিসেবে আজও রয়ে গেছে ১২ কক্ষ বিশিষ্ট কুঠির ইটের দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ, মাঝামাঝি রয়েছে একটি চুল্লি ও পাশেই রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু চিমনি।
নীলকুঠিটি পার্শ্ববর্তী শরীয়তপুর সদর উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম মাহমুদপুর গ্রামঘেঁষে অবস্থিত। তাই মাদারীপুর জেলার পাশাপাশি শরীয়তপুরের মানুষও নীল চাষ করতে বাধ্য হতো। এখনো শরীয়তপুরের অনেকেই নীলকুঠিটি দেখতে আসেন।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি শেখ খলিলুর রহমান বলেন, ‘শরীয়তপুরের মাহমুদপুর ও মাদারীপুরের ছিলারচর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে তখন নীল চাষ হতো। মাদারীপুরের আউলিয়াপুর গ্রামে নীলকুঠির ইটের দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ, চুল্লি ও চিমনি এখনো রয়ে গেছে।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, ‘আমরা অনেকেই নীল চাষ সম্পর্কে জানি না। আজও সেই নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে। এখন তা দর্শনীয় স্থান। দেশ-বিদেশের অনেকেই স্থানটি দেখতে আসেন। তবে অযত্ন-অবহেলায় ইটের দেয়াল, চুল্লি ও চিমনি নষ্ট হচ্ছে। এটি সংরক্ষণে সবার সহযোগিতা দরকার।’
এসইউ/এএসএম