যেখানে নারীর রাজত্ব, পুরুষের কাজ সন্তান উৎপাদন
‘আমরাই পরিবারের প্রধান। সম্পত্তি এবং পরিবারিক দায়বদ্ধতা আমাদের কাছেই। মায়ের পরিচয়ে আমরা পরিচিত হই। সন্তান লাভের আশায় আমরা ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’-এ বিশ্বাসী। অর্থাৎ আমরা ইচ্ছামতো পুরুষ সঙ্গীকে বেছে নিতে পারি। সেটা এক বা একাধিক হতে পারে। আমাদের রাজত্বে নারীর আদেশই শিরোধার্য- এমনটিই জানান ৬৯ বছরের আশা নুজা।
হিমালয়ের পাদদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এক স্থান ইয়ানুয়ানে বসবাস করে চীনের মোসুও আদিবাসীরা। এর পাশেই রয়েছে বিখ্যাত লুগা হ্রদ। মোসুও আদিবাসীরা বিশ্বের সর্বশেষ অর্ধ-মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত। জন্মের পর থেকেই মোসুও কন্যাশিশুরা মা, নানি ও খালাকে দেখে পরিবারের হাল ধরতে শেখে। তারা যৌথ পরিবারেই আজীবন বসবাস করে।
পরিবারের হাল ধরতে শেখে নারীরা: একজন মোসুও নারী আমৃত্যু পরিশ্রম করেন। তারা বড় হতেই ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আগুনের ব্যবহার, রান্না করা, কাঠ সংগ্রহ, গবাদি পশুকে খাওয়ানো, ফসল কাটা, চাষাবাদ এবং কাপড় বুননসহ সব ঘরের কাজ শিখতে শুরু করেন।
৭৩ বছর বয়সী পেমা লামুও ক্ষেতে কাজ করে উপার্জন করেন। তিনি বলেন, ‘পুরুষদের উপর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই এ সমাজে। শুধু তারা সন্তান জন্ম দেওয়ার কাণ্ডারি। এরপর তাদের দায়িত্ব শেষ। যদি কোনো বাবা তার সন্তান বা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে দেখা করতে চায়, তবে সে মাঝে মধ্যে সুযোগ পায়।’
পুরুষের কাজ কী: মোসুও সমাজে পুরুষের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাদের কোনো চাকরিও নেই। সারাদিন বিশ্রাম নিয়েই দিন কাটায়। অবশ্য রাত জেগে এলাকা পাহাড়া দেওয়ার কাজ করে থাকেন। তবে মোসুও পুরুষরা ভালোমতো বাচ্চা লালন-পালন করতে পারেন। বোনদের সন্তান, এমনকি চাইলে নিজের সন্তানকেও লালন-পালন করতে পারেন। এ ছাড়া বাড়ি-ঘর তৈরি, পশুপালন, পশু জবাই এবং মাছ শিকারও করে থাকেন।
জীবন-যাপন: পরিবারে পুরুষ শক্তিধর হিসেবে বিবেচিত না হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষরাই সর্বেসর্বা। জানা গেছে, জি জে এ চে নামের এক ব্যক্তি লুওশুই গ্রামের রাজনৈতিক নেতা। তবে একটি নিবন্ধ অনুসারে, একসময় না-কি মোসুওদের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন নারী।
অবাক করা বিষয় হলো, মোসুও জনগোষ্ঠী আধুনিকভাবে জীবন-যাপন করে থাকে। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো তারা বিচ্ছিন্ন বা আলাদা নন। তাদের পোশাক, খাবার-দাবার, বাসস্থান, জীবন-ধারণ সবকিছুতেই আধুনিকতার ছাপ দৃশ্যমান।
নারীর স্বাধীনতা: মোসুও সম্প্রদায়ের নারীরা যেভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করেন; সে সুযোগ হয়তো বিশ্বের কোনো স্থানের নারীরা পান না। তাদের মধ্যে নেই কোনো ভেদাভেদ, সবাই সমান। নারীরা পছন্দসই প্রেমিক বা স্বামীকে বেছে নিতে পারেন। প্রয়োজন হলে একাধিক পুরুষের সঙ্গেও সম্পর্ক করেন এ সম্প্রদায়ের নারীরা।
‘ওয়াকিং ম্যারেজ’-এ থাকা নারীরা কিন্তু তাদের স্বামীর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন না। প্রয়োজনে পুরুষরা নারীর বাড়িতে সন্ধ্যায় বা রাতে গিয়ে থাকেন। আবার সূর্যোদয়ের আগেই পুরুষরা স্ত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এমনটিই না-কি নিয়ম তাদের সমাজে।
আবার কোনো মোসুও পুরুষ নিজ থেকে নারীকে প্রেম নিবেদন করতে পারেন না। সে অধিকার শুধু রয়েছে নারীদের। নারীর অনুমতি সাপেক্ষেই কোনো পুরুষ তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। সন্তান জন্মের পর পুরুষটির দায়িত্ব শেষ। এরপর তিনি যদি সন্তানের প্রতি যত্নশীল হন; তাহলে তো ভালোই। আর না হলে কোনো নৈতিক, সাংস্কৃতিক বা আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।
যদি কখনো কোনো মোসুও নারীর গর্ভে সন্তান জন্ম না নেয়; সেক্ষেত্রে অন্য পরিবারের কোনো শিশুকে দত্তক নিতে পারেন ওই নারী। শিশুটি বংশগতভাবে তার পালক মায়ের পরিচয়েই বড় হতে থাকে।
জীবন-ধারণ পদ্ধতি: মোসুও সংস্কৃতি মূলত কৃষিনির্ভর। পশুপালন (ইয়াক, জলমহিষ, ভেড়া, ছাগল, হাঁস-মুরগি) করেন তারা। এ ছাড়া মাঠে কাজ করে শস্য, আলু ও ফসল জন্মান। তারা ‘দিনে সাত ঘণ্টা এবং বছরে সাত মাস’ কাজ করেন।
যত পরিশ্রমই করুক না কেন, ঠিক সময়মতো খেতে ভোলেন না মোসুও জনগোষ্ঠীরা। তাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাংস রাখা চাই। যেহেতু তাদের কাছে ফ্রিজের ব্যবস্থা নেই; তাই লবণ দিয়ে শুকিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে মাংস সংগ্রহ করেন।
মোসুওরা শূকরের মাংসের জন্য বিখ্যাত। যা তারা ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করেন। শষ্যদানা দিয়ে তারা এক প্রকার মদ তৈরি করেন; যার নাম সুলিমা। অতিথি আপ্যায়নে, যেকোনো অনুষ্ঠান এবং উৎসবে তারা সুলিমা পান করে থাকেন।
মোসুও সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ৪০ হাজার। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। যদিও তারা নিজেদের ধর্মকে দাবা বলে থাকেন। মোসুও জনগণ ‘নক্সি’ সম্প্রদায়ের অধীনে হওয়ায় সরকারিভাবে তারা বৃহৎ ওই জনগোষ্ঠীর পরিচয়েই পরিচিত। তাদের বিভিন্ন এলাকায় এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি।
মোসুওদের বাড়িগুলো সাধারণত চারকোণা বা স্কয়ার আকৃতির দুই বা তিন তলার হয়ে থাকে। বাড়ির মাঝের অংশটি তারা উঠান হিসেবে ব্যবহার করেন। বাড়ির নিচতলায় মহিষ, ঘোড়া এবং মুরগিসহ গবাদি পশু বাস করে। এ ছাড়া রান্না, খাওয়া এবং অতিথিদের বসার ঘরসহ বাথরুম সাধারণত নিচ তলায় হয়ে থাকে। দ্বিতীয় তলায় তাদের বেডরুমসহ অন্যান্য রুমগুলো থাকে।
তেরোতেই বিয়ে: মোসুও কন্যাদের যখন ১৩ বছর বয়স হয়; তখনই তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বয়সেই তারা প্রথম ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ করার জন্য সঙ্গী নির্বাচন করে। এ অনুষ্ঠানের আগে মোসুও শিশুরা সবাই একই পোশাক পরিধান করে। ওইদিনের উৎসবে মেয়েদের স্কার্ট ও ছেলেদের ট্রাউজার দেওয়া হয়।
পর্যটকবান্ধব স্থান: মোসুওদের জীবন-ধারণ পদ্ধতি দেখতে বছরে লাখো মানুষ ভিড় জমায় চীনের সিচুয়ান প্রদেশ ও তিব্বতের শেষ সীমানায়। অন্যান্য পর্যটকবান্ধব দেশগুলোর মতোই মোসুও সম্প্রদায়ের মানুষও বছরে অনেক অর্থ উপার্জন করে থাকে। এ ছাড়া মোসুও নারীরা হস্তশিল্পে পারদর্শী। পোশাক, জুয়েলারি তৈরিসহ হস্তশিল্পে দক্ষতা থাকায় সেগুলো তারা আগত দর্শনার্থীদের কাছে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন।
উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে বছরজুড়েই পর্যটকরা যাওয়া-আসা করেন সেখানে। বর্তমানে মোসুও তরুণীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। পুরুষ মোসুওরাও পরিবার ছেড়ে শহরে গিয়ে নিজের মতো করে জীবন-যাপন করছেন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফি/দ্য গার্ডিয়ান/জেএমএস/এসইউ/জেআইএম