৪শ বছর আগের কালি মন্দির দেখতে চাইলে
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মোঘল আমলের দাশেরহাট কালি মন্দির। এটি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রাচীনতম ‘কালি মন্দির’ হিসেবে সুপরিচিত। মন্দিরটি কত সালে নির্মিত হয়েছিল তার কোনো তথ্য বা সাল কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।
নির্মাণশৈলী অনুযায়ী স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ধারণা করেন, আনুমানিক ৪শ বছর আগে মোঘল আমলে কোনো এক জমিদার নির্মাণ করেন। কালির প্রতিমার উচ্চতা প্রায় ১২ হাত এবং প্রস্থ প্রায় সাড়ে ৩ হাত। মন্দিরে কালির প্রতিমা ছাড়াও অর্ধকালি, অর্ধশিব, ভৈরব, ভৈরবী, ডাকিনি ও জুগুনির প্রতিমা আছে।
কালি মন্দিরসহ অন্য মন্দিরগুলো ২২ শতাংশ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। যা মন্দিরের নিজস্ব জায়গা। সরকারের কাছ থেকে মন্দির কমিটি দীর্ঘমেয়াদী লিজ নিয়েছে ৩৮ শতাংশ জায়গা। এতে মাঠসহ মন্দিরের মোট এলাকা ৬০ শতাংশ।
প্রাচীন মন্দিরটিতে আগে ১২ বছর পরপর পূজা হলেও বর্তমানে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। একসময় এখানকার পূর্বপুরুষরা মন্দিরে মহিষ বলি দিতেন। বর্তমানে পাঠা বলি দেন। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথির আগেই শনিবার অথবা মঙ্গলবার শুরু হয়ে ৮ দিনব্যাপী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রতিবছর উত্তরাঞ্চলের জেলাসহ ভারতের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর পূণ্যার্থীর সমাগম ঘটে।
একসময় এখানে একটি হাট বসতো। হাটে দাশ বেচাকেনা হতো। যা জমিদাররা কিনে নিতেন। তাই এ এলাকার নামকরণ করা হয়েছিল ‘দাশেরহাট’ নামে। হাটকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছিল কালি মন্দিরটি।
কলেজ শিক্ষার্থী মনোরঞ্জন জানান, মন্দিরটির নাম দাশেরহাট সার্বজনীন কালি মন্দির। বাপ-দাদার মুখে শুনেছি, এটি ব্রিটিশ আমলের মন্দির। এটি উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ কালি মন্দির হিসেবে পরিচিত। এ মন্দিরের নাম বই-পুস্তকেও উল্লেখ আছে। এখানে কালি মন্দির ছাড়াও আছে মহাদেব মন্দির, দুর্গা মন্দির ও পঞ্চতত্ত্ব মন্দির। মন্দিরে ষোলো প্রহর, কালি পূজা, দুর্গা পূজা, অমাবস্যা পূজাসহ অন্যান্য পূজা পালিত হয়। এর কার্যক্রম ব্রিটিশ আমল থেকে চলমান।
মন্দিরের ভক্ত শ্রীমতি রতেশ্বরী জানান, এটি বহুদিন আগের মন্দির। আগে এখানে ১২ বছর পরপর পূজা হলেও বর্তমানে প্রতিবছর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আগে জলধর কাকা এ মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে ছিলেন। তিন বছর ধরে আমি এ মন্দিরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছি। এখানে কালি পূজা, দুর্গা পূজা, মহাদেব পূজা, শীতলী পূজা, রাধা গোবিন্দ পূজাসহ হরিসভা পালন করা হয়।
গৃহবধূ শ্রীমতি শ্যামলী জানান, তিনি এলাকার গৃহবধূ হয়ে আসার পর থেকে এ বিশাল আকৃতির কালি মন্দিরটি দেখছেন। এখানে নানা ধরনের পূজা পালিত হয়।
দিনমজুর আনন্দ জানান, মন্দিরের পাশেই তার বাড়ি। এখানে ৬টি ঠাকুর আছে। বছরে দুর্গা ও কালি পূজা ছাড়াও অষ্টপ্রহর, লক্ষ্মী পূজা, অমাবস্যা পূজা, শীতলী পূজা, মহাদেব পূজাসহ শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালিত হয়।
মন্দিরের সভাপতি নীল মাধব সরকার বলেন, ‘মন্দির কমিটির প্রচেষ্টায় এর সংরক্ষণ, সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ পরিচালিত হয়ে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সহযোগিতা পেলে আরও জাঁকজমকপূর্ণভাবে ধর্মীয় উৎসবগুলো পালন করা যাবে। এছাড়া মন্দিরটি কুড়িগ্রাম জেলার একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণে মন্দিরটির অবকাঠামো ভেঙে যায়। পরে স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় পুনঃনির্মিত হয়। এ কালি মন্দিরকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য মন্দির পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করা হয়েছিল।’
উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘আমরা এটাকে একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে পারি। এতে হিন্দু পুণ্যার্থীদের এখানে আসার একটি সুযোগ তৈরি করে দিতে পারি। পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর আগমনে এলাকার কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।’
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘মন্দিরটির কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেবো। এটি যদি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে সংরক্ষিত করার মতো হয়, তাহলে সেটির উদ্যোগ নেওয়া হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হবে।’
মো. মাসুদ রানা/এসইউ/জেআইএম