সাজেক ভ্রমণে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন
মো. মঈনউদ্দীন
সাজেক শব্দটি মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেঘময় এক পৃথিবীর ছবি। এখানে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। কখনো তীব্র শীত আবার মুহূর্তেই বৃষ্টি। চোখের পলকেই চারপাশ ঘোমটা টানে সাদাকালো মেঘে। এ যেন মেঘের উপত্যকা, মেঘেদের রাজ্য আর নিজেকে মনে হয় মেঘের রাজ্যের বাসিন্দা। হয়তো মনের অজান্তেই খুঁজতে থাকবেন সাদা মেঘের পরি অথবা মেঘের মধ্যে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলা রাজপুত্রকে।
সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাহাড়। চূড়ায় উঠতে উঠতে দেখতে পাবেন মিজোরাম সীমান্তের পাহাড় আর সবুজের মিতালি। কংলাকের চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকালে সত্যি সত্যি ভুলে যাবেন, আপনি ছিলেন কোনো যান্ত্রিক নগরে দূষিত বাতাস, শব্দ এবং কর্কট সমাজে জন্ম নেওয়া মানুষ। আপনার মন, প্রাণ, দেহ পুলকিত হবে এক বিশুদ্ধ চিন্তা এবং অনুভূতিতে। সূর্যোদয় ও অস্ত দেখার সুখানুভূতি সারাজীবন মনে রাখবেন। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে অকবিও হয়ে ওঠেন কবি, অপ্রেমিকও হয়ে ওঠেন প্রেমিক, একজন সচেতনও অবচেতনে হয়ে ওঠেন উন্মাতাল। একজন বৃদ্ধও সবুজের সুরা পান করে হয়ে ওঠেন তেজোদীপ্ত তরুণ।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর এবং জনপ্রিয় স্থান সাজেক ভ্যালি। বাংলাদেশের বৃহত্তম ইউনিয়নটি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এ ইউনিয়ন ভারতের ত্রিপুরা-মিজোরাম সীমান্তবর্তী এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১৮০০ ফুট। অবস্থান রাঙ্গামটি জেলায় হলেও খাগড়াছড়ি থেকে এখানে যাতায়াত অনেক সুবিধাজনক। কারণ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। তাই ভ্রমণপিপাসুরা দীঘিনালা থেকেই সাজেক যেতে বেশি পছন্দ করেন। সময়-সুযোগ পেলে ঘুরে আসতে পারেন এ নৈসর্গিক উপত্যকায়। তবে সাজেক প্রকৃতির আসল রূপ দেখার জন্য সেরা সময় হচ্ছে বর্ষাকালের শেষদিকে এবং শীতকাল।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রুটে বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলাচল করে। গাবতলী, কলাবাগানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে পরিবহনগুলোর কাউন্টার। ঢাকা থেকে বাস ছেড়ে চট্টগ্রাম রোড হয়ে কুমিল্লা, ফেনী পার হয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাই হয়ে খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছায়। এতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টার মতো।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যেতে হবে খোলা জিপে, যা চান্দের গাড়ি নামেই পরিচিত। দুদিনের জন্য ভাড়া করলে আপনাকে গুনতে হবে ৬ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা। চান্দের গাড়িতে আসন সংখ্যা ১২টি। সাজেক যেতে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে দীঘিনালা। দীঘিনালা নেমে আধা ঘণ্টার জন্য ঘুরে আসতে পারেন হাজাছড়া ঝরনা থেকে। সাথে সেরে নিতে পারেন গোসলটাও। কারণ সাজেকে পানির খুব অভাব। তবে চিন্তার কিছু নেই, গোসল ও অন্যান্য কাজের জন্য দরকারি পানি প্রতিদিন ট্রাকে করে পৌঁছে যায় সাজেকে।
পানি ব্যবহারে সাজেকে আপনাকে মিতব্যয়ী হতে হবে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। দীঘিনালায় একটি সেনানিবাস রয়েছে। এরপর বাকি রাস্তা আপনাকে যেতে হবে সামরিক বাহিনীর এসকোর্টে। সম্প্রতি পাহাড়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনী এ পদক্ষেপ নিয়েছে। দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকোর্ট শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। তাই ওই সময়ের আগেই আপনাকে পৌঁছতে হবে খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায়। নইলে একবার সকালের এসকোর্ট মিস করলে আবার এসকোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে বিকেল অবধি।
দীঘিনালা থেকে প্রথমে যেতে বাগাইহাট, তারপর মাচালং হাট হয়ে সরাসরি পৌঁছে যাবেন সাজেক। খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেক যেতে মোট সময় লাগবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলা এ ছোট জার্নিটি সাজেক ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণ। চারদিকে শুধু পাহাড় আর হরিতের সমারোহ আপনাকে ভুলিয়ে দেবে পথের ক্লান্তি।
ঘুরবেন যেভাবে: সাজেক পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া করার পর দীর্ঘ যাত্রার শেষে আপনাকে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে। এ ছাড়া সাজেকের কাঠফাঁটা দুপুরের রোদে না ঘোরাঘুরি করে রোদ পড়ার জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। বিকেলে জিপে করে আপনি ঘুরে আসতে পারেন সাজেক ভ্যালির আরও ভেতরে। সেখানে একটু উঁচু টিলায় উঠলেই উপভোগ করতে পারবেন সূর্যাস্ত। সাজেকের সন্ধ্যা নামে অপরূপ এক সৌন্দর্য নিয়ে। দেখবেন মেঘমুক্ত নীলাকাশ একটু একটু করে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আর মিটিমিটি করে জ্বলে উঠছে একটি দুটি করে তারা। দেখবেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে একটি-দুটি থেকে সহস্র তারা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠবে। হয়তো আপনি এরকম তারাভরা আকাশ জীবনেও দেখেননি।
সন্ধ্যার তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিলে আপনার হৃদয়ে যে অনুভূতি আসবে, সেটাই হতে পারে আপনার সাজেক ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আনন্দ। যারা তারা দেখতে ভালোবাসেন; তাদের জন্য সাজেক খুবই আদর্শ একটি জায়গা। এমনকি যারা এখনও মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ দেখেননি; তারাও সাজেক ভ্যালিতে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখা পেতে পারেন মহাবিশ্বে আমাদের আশ্রয়স্থল আকাশগঙ্গার।
ভোরে সূর্যোদয় দেখতে চাইলে হ্যালিপ্যাডে চলে যাবেন অবশ্যই। সে জন্য উঠতে হবে খুব ভোরে আর চলে যেতে হবে এক বা দুই নম্বর হ্যালিপ্যাডে। সাজেকে সূর্যোদয়ের সময় সোনালি আভা সাদা মেঘের ওপর যখন ঠিকরে পড়ে; তখন অসাধারণ এক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেন
• সঠিক সময়ে এসকোর্ট দেওয়া।
• সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ছবি তোলা যাবে না।
• স্থানীয় লোকজনের ছবি তোলার আগে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে নেবেন।
• ছুটির দিনে কটেজ পাওয়ার ঝামেলা এড়াতে বেশ কয়েক দিন আগে (এক মাস) বুকিং দিন।
• রবি, এয়ারটেল বা টেলিটক সিম সঙ্গে নিন।
• সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখুন।
• সঙ্গে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যান।
• জিপের ছাদে বা মোটরসাইকেলে সতর্ক থাকুন।
• দুই-তিন দিনের জন্য সাজেক গেলে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করার দরকার নেই।
• শুধু যাওয়ার জন্যই গাড়ি নিন। আসার সময় অন্য গাড়িতে আসুন।
• দীঘিনালা থেকে ফোন করেও গাড়ি নেওয়া যাবে।
আর যা দেখবেন: খাগড়াছড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আলুটিলা গুহা, রিছাং ঝরনা, দেবতার পুকুর, হর্টিকালচার পার্ক, তৈদুছড়া ঝরনা, বিডিআর স্মৃতিসৌধ, মায়াবিনী লেক ও শান্তিপুর অরণ্য কুঠির। সাজেকের পাশাপাশি এসব জায়গাও ঘুরে দেখতে পারবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএ/জেআইএম