জকিগঞ্জের তিন নদীর মোহনায় একদিন
মেহেদী হাসান তালহা
বাড়ির পাশেই দেশের অন্যতম বিখ্যাত একটি জায়গা তিন নদীর মোহনা। ভারত থেকে বয়ে আসা বোরাক নদী বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে দু’ভাগ হয়েছে। দু’ভাগ হয়ে সুরমা এবং কুশিয়ারা নামে দুটি নদী হয়ে সিলেট অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত চলে গেছে। সেখানে মিলিত হয়ে কালনী নাম গ্রহণ করেছে। এমন একটি স্থান, অথচ কখনো যাইনি। ছোটবেলা থেকে শুধু শুনেই আসছি, কখনো যাওয়ার সুযোগ হয়নি। যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়নি। হঠাৎ সেদিন ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’র ন্যায় আমার সামনে সে সুযোগ চলে আসে। সহজ কথায় বলতে গেলে, আমাদের ওমর ভাইয়ের একাকী জীবনের বিদায় অনুষ্ঠানই সে সুযোগ করে দিয়েছে। এ জন্য ওমর ভাই এবং নতুন ভাবিকে ধন্যবাদ।
শহুরে জীবনের নিষ্ঠুর ব্যস্ততা আর আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন আমাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কতদিন হলো আমরা একত্রিত হতে পারি না। কেউ চাকরি নিয়ে, কেউ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। কতদিন হলো আগের মতো আর ঘোরাঘুরি, আড্ডা, গান হয়ে ওঠে না। ইচ্ছে করলেও সেটি করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু সেদিন ওমর ভাইয়ের বিবাহের ঘরোয়া অনুষ্ঠান আমাদের সবাইকে এক করে দিয়েছিল।
সেদিন ছিল শুক্রবার। করোনা পরিস্থিতির কারণে ঘরোয়া পরিবেশে ওমর ভাইয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান হলো। জুমার নামাজ পড়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। একে একে উপস্থিত হলেন মানসুর, শামীম, গিয়াস, নাজমুল, ইব্রাহীম ভাইসহ আমাদের আত্মীয়রা। যথারীতি সাক্ষাৎ, অভিবাদন এবং ভোজপর্ব শেষে সবাই যখন বিদায় নিতে যাবো, ঠিক তখনই মামুন ভাইয়ের মাথায় ঘোরাঘুরি করার ভূত চাপলো। যেই ভাবা সেই কাজ। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলো জকিগঞ্জের তিন নদীর মোহনায় যাওয়া হবে। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত শুনে আমিও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার উপর অর্পিত কাজ ফেলে দিলাম মানসুর ভাইদের সাথে দৌড়। সবাই প্রাথমিক বিদায় নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে ছুটলাম তিন নদীর মোহনায়।
৮টি মোটরসাইকেলে আমাদের যাত্রা শুরু। আমি আর মঞ্জু ভাই এক গাড়িতে। গ্রামের ফাড়ি রাস্তা পার হয়ে যখন জকিগঞ্জ মহাসড়কে উঠলাম; তখন সড়ক একদম ফাঁকা। জকিগঞ্জ মহাসড়কই এশিয়ান হাইওয়ে নামে পরিচিত। মাঝেমধ্যে দু’একটা যাত্রীবাহী বাস অথবা সিএনজি-অটোরিকশা আমাদের চোখে পড়লো। ফাঁকা রাস্তায় বাতাসের গতিতে ছুটে চললো আমাদের দু’চাকার যানগুলো। একে একে সড়কের বাজার, আটগ্রাম বাজার, কালীগঞ্জ বাজার এবং নাম না জানা আরও কয়েকটি বাজার অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
কালীগঞ্জ বাজার অতিক্রম করে একটু সামনে যেতেই চোখে পড়লো সড়কের দু’পাশে রেইন্ট্রি গাছের দীর্ঘ সারি। দেখলে মনে হবে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা যাত্রীদের গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রেইন্ট্রি গাছের নয়নাভিরাম সারি দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। তাই কয়েকটি ছবি তুলে আবার ছুটলাম। প্রায় আধাঘণ্টা চলার পর পিচঢালা পথ ছেড়ে প্রবেশ করলাম ইট দিয়ে মোড়ানো কাচা রাস্তায়। বর্ষাকাল হওয়ায় এ রাস্তা দিয়ে চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আরও মিনিট পাঁচেক চলার পর দেখতে পেলাম জেলা পরিষদের নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার, পাশেই মাটিতে খোড়া বিজিবির বাঙ্কার। বুঝতে পারলাম, আমরা আমাদের গন্তব্যে চলে এসেছি। মোটরসাইকেল থেকে নেমেই সাক্ষাৎ হলো বিজিবির টহলরত সদস্যের সাথে।
একটু সামনেই তৈরি করা হয়েছে আগত পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য যাত্রী ছাউনি। ছাউনি থেকে একটু সামনে চোখ বুলালেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কাঙ্ক্ষিত সেই তিন নদীর মোহনা। ভারত থেকে বোরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুশিয়ারা নাম নিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। একটু বাক খেয়ে উত্তর পশ্চিম দিক দিয়ে চলে গেছে সুরমা। তিন নদীর মিলনস্থল বর্ষার ভরা মৌসুমে তেমন একটা বোঝা যায় না। শীতের মৌসুমে এখানে একটি ছোট্ট দ্বীপ দৃশ্যমান হয়। তখন তিন নদীর মিলনস্থল স্পষ্ট হয়ে যায়। নদীর ওপারে নো ম্যান্স ল্যান্ড এরিয়া। সেখানে কিছু অংশ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে।
বলতে গেলে, সারাবছরই সীমান্তের এ অঞ্চল শান্ত থাকে। বিজিবি, বিএসএফের সদস্যরা নিয়ম করে তাদের সীমান্ত পাহারা দেয়। শুধু ২০০৬-২০০৭ সালে নদীর ওপারে বাংলাদেশ সীমান্তে জেগে ওঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আমলসিদ নামক এ সীমান্ত। তখন সারাদেশে আলোচনার জন্ম দেয় আমলসিদ সীমান্ত। তৎকালীন বিডিআরের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে ভারতীয় বাহিনী দখল করতে পারেনি জেগে ওঠা চরটি। সীমান্তের এখান থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে ২০০৯ সালে নির্মিত হয় বহুল আলোচিত টিপাইমুখ বাঁধ।
আমরা যখন যাত্রী ছাউনিতে এলাম। ঠিক তখনই মুষলধারে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই ইব্রাহীম ও নাজমুল ভাই যৌথকণ্ঠে গাওয়া শুরু করলেন সিলেটি ভাষার গান, ‘আমরার বাড়িরে ভাই সুরমা গাঙের পারে’। তাদের সাথে কণ্ঠ মেলালেন বন্ধু সুহেল, মওদুদ ভাই, নুরুজ্জামান ও তারেকসহ উপস্থিত সবাই। ক্ষণিকের জন্য গানের আসরে পরিণত হয়ে উঠলো সীমান্তের এ যাত্রী ছাউনি। দীর্ঘ বর্ষণের পর যখন বৃষ্টি থামলো, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পথে। তাই আমরাও মোটরসাইকেলে চড়ে বসলাম গন্তব্যে ফেরার উদ্দেশ্যে।
পথিমধ্যে কালীগঞ্জ বাজারে সবাই থামলাম হালকা নাস্তা করার জন্য। সেখানে পরিচয় হলো স্থানীয় ইট ভাটার মালিক আব্দুল আযীযের সাথে। তার কাছ থেকে জকিগঞ্জের অনেক অজানা ইতিহাস সম্পর্কে জানলাম। অতঃপর নাস্তা শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাগরিবের নামাজ পড়ে আবার বাইকে চড়লাম। সুনসান নীরবতায় আবৃত মহাসড়কে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে ৮টি দু’চাকার যান। উদ্দেশ্য, ব্যস্ততায় মোড়ানো কংক্রিটের শহরে ফিরে যাওয়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
এসইউ/এএ/এমএস