কেমন আছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মভিটা কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত রবীন্দ্র মিউজিয়ামে গেলে। আমার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ধারণার অপূর্ণতা কেটে গেল সেখানে গিয়ে। সংগ্রহশালাটি পরিপাটি ও চমৎকার। রবীন্দ্রসংগীতের তালে তালে সংগ্রহশালাটি দর্শন করা যায় অনায়াসে। আর ঘুরতে ঘুরতে তার বহুমুখী প্রতিভার প্রকাশ ও বিশ্ব সম্পর্কে ধারণার ব্যাপকতা দেখে মুগ্ধ হই ও বাঙালি হিসেবে গর্ব করতে বাধ্য হতে হয়।
বিশ্বভারতীর গেট পেরিয়ে সবুজ আঙিনা। গেটের সাথেই টিকিট কাউন্টার। ২০ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এখন ক্যাম্পাস হিসাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। লাল বিল্ডিং। চোখ ধাঁধানো। মিউজিয়ামের প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকলাম। মূল বাড়িটি আয়তাকার। মিউজিয়ামে ঢুকলে অনেক কিছুর সাক্ষী থাকা যাবে। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে বামদিকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। আর ডানদিকের বাগান পেরিয়ে সারি সারি ঘর। এখানে বিশ্বভারতীর ক্লাস বসে। গেটের দু’পাশে দাঁড়িয়ে পিতা ও পুত্রের মর্মরমূর্তি। রবীন্দ্রনাথ ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের। দালানটির নির্মাণকৌশল ভালো। ইন্দো-ভারতীয় নির্মাণ চমৎকার। ভেতর দিকে ছোট্ট সবুজ আঙিনা। চারিদিকে দালান। যা মিউজিয়ামেরই অংশ। তিনতলা বিশিষ্ট এ দালান। প্রতি তলার বিভিন্ন অংশে গাইড কাম তত্বাবধায়ক আছেন। সাউন্ড সিস্টেমে অবিরত রবীন্দ্রসংগীত বেজেই চলেছে। রবীন্দ্রসুরে মাতোয়ারা হয়েই এক এক করে সব রুমই দেখলাম।
এরপর দোতলায় উঠতে হবে। উঠেই হাতের বামদিকে রবীন্দ্রনাথের খাবার ঘর, তার সাথেই কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর। এখানে রান্না-বান্নার বিভিন্ন জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে। পাশে সংগীতঘর। এখানে গান পরিবেশন করা হতো বা কবিগান গাইতেন। এরপরের ঘরটিতে কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই এ ঘরেই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’র ডিক্টেশন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাত দিন পর তিনি মারা যান। আরও রয়েছে বিশ্বকবির বংশতালিকার ওয়ালমেট। কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখে নিলাম। কবিপত্নীর রান্নাঘর ও ব্যবহৃত জিনিসপত্রও আছে কক্ষ ও বাইরে। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন চিত্রকর্ম, তৈলচিত্র, ল্যান্ডস্ক্যাপ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষিত রয়েছে।
চীন ও জাপান ভ্রমণের স্মৃতিময় সংগ্রহশালাও রয়েছে। এতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কাটিং ও আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বইপত্র, দেশ-বিদেশের পত্রিকার কবিসম্পর্কিত সংবাদ-লেখা, ম্যাগাজিন পেপার কাটিং দেখে অভিভূত হলাম। সযত্নে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আঁতুড়ঘর, প্রসবকালীন ঘর দেখে ইতিহাসেই হারিয়ে গেলাম। পাশেই পড়ার ঘর, সাহিত্যচর্চা বা লেখার ঘর, গান শোনার ঘর ইত্যাদি আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। গান লেখার পাশাপাশি গান গাইবার ঘরও আছে। কবির নিজের বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও ব্যবহৃত কাপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্রও দেখে নিলাম। জাপান ও চীন স্মৃতির জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। এখানে সে দেশের স্মৃতিগুলো ছবি আর লেখায় ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈলচিত্রে ব্যবহৃত উপকরণ, বংশের বিভিন্ন জনের ছবি আর ডায়াগ্রাম দেখে নিলাম।
এরপর বিভিন্ন গ্যালারি। চারটি ভবনের আঠারোটি গ্যালারিজুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। এখানে আলাদা দুটি নান্দনিক আর্ট গ্যালারি রয়েছে। একটি প্রাচ্য ধারার, অন্যটি পাশ্চাত্য ধারার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, নন্দলাল বসুসহ আরও অনেক শিল্পীর আঁকা ছবি আছে। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। নোবেল পুরস্কারের গ্যালারিটিও চমকপ্রদ। নোবেল পুরস্কার জয়ের গল্প লেখা আছে। জাপান ও চীন সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্যালারি দুটিও মনে রাখার মতো। মূল ভবনের পাশের ভবনটির নাম ‘বিচিত্রা’। দোতলায় ভিক্টোরিয়া হল। এখানে আছে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কিছু ছবি। বাংলাদেশের শিলাইদহে অবস্থানকালীন চৈত্রমাসের স্মৃতিবিজড়িত ও উপভোগ্য দিনের একটি চিত্রকর্ম দেখলাম। এ ছাড়া আরও অনেক চিত্রকর্ম দেখা যায়। তার সম্পর্কিত বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তির চিত্রকর্ম নিয়ে ‘স্মরণীয় কক্ষ’ রয়েছে। সৌভাগ্য যে, এখানে বাংলাদেশের দু’জন বরেণ্য চিত্রশিল্পীর (কাইয়ুম চৌধুরী ও হাশেম খান) চিত্রকর্ম শোভা পাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ যে তরীতে পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াতেন তার একটি চমৎকার প্রতিকৃতিও শোভা পাচ্ছে এখানে। বাংলাদেশ সরকার স্মারক উপহার হিসাবে দান করেছে।
তৃতীয় তলায় রয়েছে কবির নিজ বংশের বা পরিচিতজনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, চিত্রকর্ম আর তৈলচিত্র। গান শুনতে শুনতে একদিক থেকে ঢুকে পর্যায়ক্রমে সব দেখে শেষ করে বের হওয়া যায়। সাহায্যকারী হিসেবে এখানে প্রায় প্রতিকক্ষে গাইড আছে।
এ বাড়িতেই কবি তার শৈশবকাল কাটান এবং ৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে মারা যান। এটি আঠারো শতকে দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ) নির্মাণ করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন। মিউজিয়ামটি মহর্ষি ভবন নামে পরিচিত। মূল বাড়ির বাইরের দিকের একটি ভবনে আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত একটি গাড়ি। মিউজিয়ামের প্রতি কক্ষ ও আঙিনা ঝকঝকে ও সাজানো-গোছানো।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সপ্তাহের ৫ দিন (সোম-শুক্র) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ও শনিবার (দুপুর ১টা পর্যন্ত) দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ। প্রবেশ ফি ভারতীয় ২০ রুপি।
কলকাতা শহরের সেন্ট্রাল রোড তারপর রবীন্দ্র স্মরণিতে অবস্থিত বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। চলুন না ঘুরে আসি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এ পীঠস্থান থেকে। দেখে আসি করোনার ছোবলে কেমন আছে প্রিয় বাড়িটি? প্রতিবছর এখানে ঘটা করে পালিত হয় বাংলা বর্ষবরণ। কবির জন্ম ও মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এমএস