কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য চুয়াডাঙ্গা
‘বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল-কুকুরে/সে কি বাস করলে তাড়া,/বলি থাম একটু দাঁড়া।’ কবিতাংশটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ থেকে নেওয়া। এটি চুয়াডাঙ্গার মাটিতে বসেই কবি লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি রাজনৈতিক বা লেটোর দলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি স্থানে এসেছেন। ময়মনসিংহ (ত্রিশালসহ), কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, বরিশাল বা চুয়াডাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। তিনি এসব স্থানে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। তার এসব সাহিত্যকর্মের মধ্যে অনেক রচনা অমরত্ব পেয়েছে। চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় (নিশ্চিন্তপুর) বেশ কয়েকবার এসেছেন। এখানেও তিনি কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল তরুণ বয়সে অনেকবার এসেছেন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ কার্পাসডাঙ্গায়। তার স্মৃতিধন্য খড়ের আটচালা ঘরটি এখনো সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ঘরটি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। লেখাটি কবির স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘরটি সংরক্ষণের তাগিদকে সামনে নিয়ে! কারণ কবি যে এ ঘরেই অনেক দিন-রাত কাটিয়েছেন, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত বা বিতর্ক নেই। তৎকালীন দামুড়হুদা উপজেলার ভৈরব নদের তীরবর্তী কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার সরকার পরিবার ছিল জ্ঞান-গরিমায় বেশ সম্ভ্রান্ত। এ পরিবারের সন্তান শ্রী মহিম সরকার চাকরির সুবাদে থাকতেন কলকাতায়। কলকাতা আমহার্স্ট স্ট্রিটে তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন। মহিম সরকারের সঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের খুবই সখ্য ছিল। তার বাড়িতে কবির আসা-যাওয়া ছিল আপনজনের মতো। তার দুই মেয়ে আভা রানী সরকার ও শিউলী রানী সরকার নজরুলগীতি চর্চা করতেন। তাদের গানের তালিম দিতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরবর্তীতে আভা রানী সরকারের গানের রেকর্ডও বের হয়।
প্রখ্যাত লেখক ড. আশরাফ সিদ্দিকী অনুসন্ধান করে নজরুলের কথা ও সুরে আভা রানী সরকারের ছয়টি গানের রেকর্ড-তথ্য পান বলে জানা যায়। আরও জানা যায়, মহিম সরকারের পারিবারিক আমন্ত্রণে একাধিকবার কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় এসেছেন। তবে ১৯২৬ সালে ২৭ বছর বয়সে কবি সপরিবারে এখানে বেড়াতে আসেন। এ সময় প্রায় দুই মাস কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থান করেন। তার সঙ্গে এসেছিলেন শাশুড়ি গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা ও বড় ছেলে বুলবুল। তারা কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে দর্শনায় নেমে ছয় মাইল গরুর গাড়িতে করে কার্পাসডাঙ্গায় আসেন।
কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার প্রয়াত শ্রী দ্বারিক নাথ ওরফে তেরেন সরকারের ভাষ্যমতে, কবি কলকাতা এবং কৃষ্ণনগর থেকে কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, কার্পাসডাঙ্গার বিপিন সরকার ও কবি একসঙ্গে বসে তাস খেলেছেন। পারিবারিক আমন্ত্রণে কবি নজরুলের কার্পাসডাঙ্গায় আগমন ঘটলেও স্বদেশী আন্দোলন বেগবান করার জন্য অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেছিলেন। দ্বারিক নাথ ওরফে তেরেন বাবুর ভাষ্যমতে, কার্পাসডাঙ্গা মিশন চত্বরে কয়েকটি ঝাউগাছ ছিল। সেই গাছে একদিন একটি বিষধর সাপ দেখতে পান দ্বারিক। সাপটিকে মেরে ফেলেন তিনি। পরে কবি নজরুল বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন। এ কারণেই কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মগোখরা’।
কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম নসকর আলী ১৯৮৭ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তখন জীবিত ছিলেন কার্পাসডাঙ্গার মহিম বিশ্বাসের মেয়ে আভা রানী সরকার ও শিউলী রানী সরকার। তাদের দুজনের সঙ্গে কথা বলেন নসকর আলী। আভা রানী ও শিউলী রানী নিশ্চিত করেন, নজরুল কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় গিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম কার্পাসডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কুড়ুলগাছির গাঙ্গুলী ও মজুমদার বাড়িতেও কয়েকবার এসেছেন বলেও জানা যায়।
কার্পাসডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কোমরপুর গ্রামের কৃতিলেখক এম ইব্রাহিম। তিনিই নজরুলকে কার্পাসডাঙ্গায় প্রথম কাগজে-কলমে তুলে ধরেন। তার লেখা ‘নজরুল ও নিশ্চিন্তপুর’ (১৯৯০ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থে নজরুলকে নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বেশিরভাগ লেখাই চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দর্পণ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘নিশ্চিন্তপুর’ কার্পাসডাঙ্গার পূর্বপাড়ার নাম। নিকট অতীতে এখানে ছিল নীলকুঠি, জমিদারি কোম্পানির সদর দফতর। পরে মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির সদর দফতর হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালে একটি আটচালা ঘরে থাকার জায়গা হয়। যে খাটে তিনি ঘুমোতেন, যে আলমারিটা তিনি ব্যবহার করতেন, তা আজও অক্ষত অবস্থায় আছে। কবির গুরুত্ব অনুভব করে তার স্মৃতি লালন করে আসছেন বংশপরম্পরায় প্রকৃতি বিশ্বাস। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে মহিম সরকারের আমন্ত্রণে আসার পর এখানকার কংগ্রেস নেতা শিক্ষক হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে ভাব জমে ওঠে কবির। হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস ছিলেন বর্তমান ভারতের শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ফলে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে কবির বেশ খাতির জমে ওঠে। সেই সুবাদে আটচালা ঘরেই কবির থাকার জায়গা হয়।
কবি যতবার এসেছেন এ ঘরেই থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আটচালা ঘরটি প্রথমত হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের উদ্যোগেই সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের ছেলে বাবু প্রদ্যুত বিশ্বাস বাবার ভূমিকা পালন করে যান। বর্তমানে কবির স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ করে রেখেছেন হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের দৌহিত্র প্রকৃতি বিশ্বাস। প্রায় শতবছর ধরে বিশ্বাস পরিবার নিজ খরচে খড়ের ঘরটি সংরক্ষণ করে আসছে। কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার পেছনে এই বিশ্বাস পরিবারের অবদান একেবারে খাটো করে দেখা যায় না। এখন সরকার বাড়িটি উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে।
ইদানিং চুয়াডাঙ্গা জেলায় মাটির ঘর নেই বললেই চলে। যে কারণে কেউ খড়ের আবাদও করে না। কিন্তু এই বিশ্বাস পরিবারের সন্তান প্রকৃতি বিশ্বাস অনেক খুঁজে খড় জোগাড় করে প্রতি বছর ঘরটি ছেয়ে রাখেন। এজন্য তার যেমন ভোগান্তি তেমনি খরচও একেবারে কম হয় না। আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ ও দেখভালের জন্য একজন কেয়ারটেকার রাখার প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘরটি স্থায়ীভাবে প্রশাসনের হস্তগত করা। এ কারণে প্রকৃতি বিশ্বাস যাতে না ঠকেন, সেটিও সরকার দেখবেন বলে আমরা মনে করি। ঘরটির পাশেই চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নজরুলের স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যু দিনে এখানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রতিনিয়তই মুজিবনগরগামী পর্যটকরা এখানে স্মৃতিবিজড়িত ঘরটি দেখতে আজও ভিড় করেন।
কীভাবে যাবেন: দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন বা বাসে চুয়াডাঙ্গা বা দর্শনায় নামতে হবে। এরপর উভয় স্থান থেকে সড়কপথে ছোটগাড়িতে বা অটোতে ১০-১২ কিমি দূরের কার্পাসডাঙ্গা বাজার। এরপর দুই কিমি দূরে অটোতে কার্পাসডাঙ্গা-মুজিবনগর প্রায় মেইন রোড সংলগ্ন কবির স্মৃতিময় বাড়ি। মেইন রোডে সাইনবোর্ড দেখা যাবে। মেইন রোড থেকে নেমে চিকন হেরিংবন্ড রোড ধরে ২০০ গজ গেলেই বাড়িটি। পাশেই খ্রিস্টানদের গির্জা ও সিমেট্রি। কার্পাসডাঙ্গা বাজার থেকে ঢাকার গাবতলী, ফরিদপুর, খুলনা, রাজবাড়ী যাওয়া-আসার বাস পাবেন। ঢাকা যাতায়াতের জন্য এসি বাসও পাবেন। ভাড়া ক্লাসভেদে ৪৫০-১১০০ টাকা।
থাকা ও খাওয়া: কার্পাসডাঙ্গায় সীমিত পরিসরে থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে দর্শনা ও চুয়াডাঙ্গায় থাকা ও খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে। কার্পাসডাঙ্গায় মোটামুটি খাবারের ব্যবস্থা আছে।
এসইউ/এএ/এমএস