সিকিমের পথে মেঘের উপর দিয়ে উড়ছে গাড়ি
লতিফুল হক মিয়া
হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে টাইগার হিলে যাওয়ার গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বৃষ্টির বাধা উপেক্ষা করে প্রথমে গেলাম ‘পিস প্যাগোডা’য়। এটি অসাধারণ। কিন্তু বৃষ্টি ও কুয়াশায় সৌন্দর্য ভালো উপভোগ করতে পারলাম না। এরপর গেলাম সাড়ে ৮ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত টাইগার হিলে। যেখান থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। পরিতাপের বিষয়, বৃষ্টি ও কুয়াশার কারণে কিছুই দেখতে পেলাম না। তখন সেখানে প্রচণ্ড শীত। হিমাঙ্কের কাছাকাছি তাপমাত্রা।
বেশি সময় ব্যয় না করে ফিরে গেলাম হোটেলে। হোটেল ম্যানেজার আমাদের জানালেন, সিকিম যাওয়ার গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই আমাদের লাগেজ গুছিয়ে চলে এলাম হোটেলের লবিতে। ভ্রমণ প্যাকেজের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলাম হোটেল কর্তৃপক্ষকে। সেই সাথে অতিরিক্ত ২০০ রুপি দিতে হলো ক্যাবল কার এলাকায় গাড়ি পার্কিং বাবদ ও হোটেল থেকে পুলিশ স্টেশনে তথ্য সরবরাহের ফরমের জন্য মাথা পিছু ৫০ রুপি। যদিও ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল আমাদের কোনো অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে না।
যা-ই হোক, হোটেল কর্তৃপক্ষকে সব অর্থ পরিশোধ করলাম। আমাদের লাগেজগুলো জীপের উপরের ক্যারিয়ারে উঠানো হলো। পলিথিন পেপার দিয়ে লাগেজগুলো মুড়িয়ে দেওয়া হলো। আমরা উঠলাম গাড়িতে। শুরু হলো ১২৭ কিলোমিটার পথের সিকিম যাত্রা। এবার বৃষ্টিভেজা দিনের আলোয় দার্জিলিং শহর অতিক্রম করছে আমাদের গাড়িটি। গাড়ির গ্লাস ভেদ করে আমরা উপভোগ করছি পাহাড়ের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। আবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসছে আরেক পাহাড়ে। মনে হচ্ছে আমাদের জীপটি যেন মেঘের উপর দিয়ে উড়ছে। আবার কোথাও গাড়ি যাচ্ছে ঘন পাহাড়ি বনের মধ্যদিয়ে। পাইন গাছের বন। লম্বা লম্বা গাছ। ডাল-পালা ভূমি থেকে অনেক উপরে। গাছ আর ডাল-পালা ভেদ করে আসছে আলোক রশ্মি। যা দেখতে অপরূপ-অসাধারণ।
সিকিমের এই দীর্ঘ পথে মাঝে একটি জায়গায় বিরতি দিলো গাড়ি চালক। আমরা সেখানে প্রাকৃতিক কাজ ও হালকা নাস্তা করলাম। পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা রাস্তার সঙ্গে নিজেদের ফ্রেমবন্দি করলাম। কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো সিকিমের উদ্দেশে যাত্রা। এবার সেই তিস্তা নদীকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষে রাস্তা দিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। পানি এতটাই স্বচ্ছ ও নীল ছিল নদীর তলদেশে কি আছে সবই দেখা যাচ্ছিল। পড়ন্ত বিকেলে তিস্তা নদীর ব্রিজের উপর সামান্য সময়ের জন্য বিরতি দিলো গাড়ি চালক। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ছবি তুলতে।
বিরতি শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা। ‘রংপো’ যাকে বলা হয় সিকিম প্রবেশের গেট। সেখান থেকে সিকিমে যাওয়ার অনুমতি নিতে হয়। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে আমরা পৌঁছলাম রংপোয়। প্রত্যেকের জন্য ২ কপি ছবি, ভিসা ও পাসপোর্টের ফটোকপি নিয়ে যেতে হয় ইমিগ্রেশন অফিসে। কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র যাচাই করে পাসপোর্টে সিল দেয়। সাথে একটি কাগজেও অনুমতিপত্র দেয়। এটি দিয়েই সিকিমে রাত যাপন ও সংরক্ষিত এলাকায় ভ্রমণ করা যায়। ভিড় থাকায় ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছিল সব কাজ শেষ করতে।
রংপোর কাজ শেষ করে গাড়ি যাত্রা শুরু করল রাজধানী গ্যাংটকের দিকে। রাত ৮টার দিকে আমাদের জীপ পৌঁছলো পূর্ব হিমালয় পর্বতশ্রেণির শিবালিক পর্বতের ৪ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতার গ্যাংটক শহরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। জীপ চালককে অতিরিক্ত ২৫০ রুপি দিতে হলো অপেক্ষা মাশুল বাবদ। এখান থেকে ৩টি ট্যক্সিতে আমরা গেলাম আমাদের প্যাকেজের নির্ধারিত হোটেল ‘গ্যালাক্সি’তে।
এটি খুব সাধারণ মানের হোটেল হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো কমতি ছিল না। হোটেল কক্ষে লাগেজ রেখেই আমাদের গ্রুপের প্রত্যেকের ৩ কপি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ভিসার ফটোকপি, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং সিকিম প্রবেশের অনুমতিপত্রের ফটোকপি হোটেলের ম্যানেজারকে দিলাম। তিনি পরদিন সকালে আমাদের উত্তর সিকিমের ইউংথান ভ্যালি ভ্রমণের অনুমতি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেবেন।
আবহাওয়া অত্যন্ত খারাপ ছিল। তাই আমরা যেদিন গ্যাংটকে গিয়েছি, আমাদের যাওয়ার ৪-৫ দিন আগ পর্যন্ত কোনো পর্যটককেই ইয়ংথান ভ্যালি ভ্রমণের অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান ছিলাম যে, আমাদের দিয়েই শুরু করেছে ইয়ংথান ভ্যালি যাওয়ার অনুমতি। আর এ ভাগ্য কাজ করেছে প্রথম দার্জিলিং ভ্রমণে গিয়ে।
যা হোক, এসব কাজ শেষে করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম এমজি মার্গের একটি প্রসিদ্ধ রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারের জন্য। মাথাপিছু ২০০ রুপিতে সম্পন্ন হলো রাতের খাবার। দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তির কারণে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
চলবে...
এসইউ/জেআইএম